খননের অপেক্ষায় দেবগ্রামের প্রত্নক্ষেত্র

গত সংখ্যায়(১৪ ই ফেব্রুয়ারি,২০১৮) লিখেছিলাম দেবগ্রাম প্রত্নক্ষেত্র আসলে আমার-আপনার বাংলার এক মুছে যাওয়া ইতিহাস যা অদ্ভুত ভাবে স্তরীভূত হয়ে আছে। সভ্যতা ও সমাজ বিবর্তনের চিহ্নস্বরূপ ভূপৃষ্ঠের সামান্য নিচেই চারটি সভ্যতার স্তর পরিষ্কার দেখা যায় এখানে। আগের সংখ্যায় পাল যুগের প্রত্নবস্তুগুলির উল্লেখ করেছি।
পালযুগে রাজশক্তির বদান্যতায় প্রভূত সামাজিক উন্নয়ন ঘটে। বিশেষ করে সামাজিক শিক্ষার প্রসারে পাল রাজাদের অবদান অনস্বীকার্য। প্রতিষ্ঠিত হয় বিক্রমশীলা, পাহাড়পুর মহাবিহার। উত্তর বাংলার কবি সন্ধাকর নন্দী রচনা করেন তাঁর অসাধারণ সৃষ্টি 'রামচরিতম'।
কিন্তু রামপালের(১০৮২-১১২৪ খ্রিস্টাব্দ) পরে ধীরে ধীরে পাল সাম্রাজ্যের সূর্য অস্তমিত হয়, কৈবর্ত প্রধান দিব্য দখল করেন উত্তরবঙ্গ।
কর্ণাটকি ব্রাহ্মণ সামন্ত সেনের পৌত্র বিজয় সেনের(১০৯৬-১১৫৯) হাত ধরে শুরু হয় সেন বংশের বাংলা শাসনের যুগ।
আগেই বলা হয়েছে, দেবগ্রামের স্তরীভূত সভ্যতার সবচেয়ে নিচের স্তর থেকে প্রাপ্ত প্রত্নবস্তুগুলি হচ্ছে গুপ্ত যুগ এবং পালযুগের। এর ঠিক উপরের স্তরে প্রাপ্ত প্রত্নবস্তুগুলি হচ্ছে সেনযুগের। সেনযুগের যেসব পুরাবস্তু পাওয়া গেছে তার মধ্যে আছে অসংখ্য মৃৎপাত্র - বেশ কয়েকটি অপূর্ব জলপ্রদীপ এবং হস্তধৃত প্রদীপ, অসংখ্য দোয়াত, ফুলদানি, বিগ্রহের অংশবিশেষ, এবং প্রচুর সংখ্যায় দৈনন্দিন ব্যবহারেরর থালা, বাটি, গ্লাস, জল ভরার ঘড়া ইত্যাদি।
এই প্রদীপগুলি দুটি প্রকোষ্ঠ যুক্ত ছিল। নিচের প্রকোষ্ঠ জলপূর্ণ করার জন্য একটি ছিদ্র রাখা আছে। এই ছিদ্রের মধ্য দিয়ে জল ভরে, জ্বলন্ত প্রদীপ হাতে নিয়ে আরতি করা হত। আগুনের তাপ হাতে লাগত না।
একটি অপূর্ব কৃষ্ণ বর্ণের অভগ্ন দোয়াত পাওয়া গেছে, যার গায়ে অপূর্ব সুন্দর কারুকার্য করা। দোয়াতটিকে বেড় দিয়ে আছে একটি খাঁজ কাটা মাটির পাতের মতন অংশ যাতে কয়েকটি ছিদ্র দেখা যায়। অর্থাৎ দরকার পড়লে দোয়াতটিকে সুতো বেঁধে হাতে ঝুলিয়ে নেওয়া যেত।
বেশ কিছু মৃত্তিকা নির্মিত অলংকার পাওয়া গেছে- মাটির পুঁতি, লকেট, কানের দুল ইত্যাদি। অসংখ্য মাটির গুলি পাওয়া গেছে যা বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করতে ব্যবর্হিত হত। বড় বড় গুলতি দিয়ে এগুলি সম্ভবত শত্রুপক্ষের দিকে নিক্ষেপ করা হত।
সেনযুগে প্রাপ্ত মৃৎপাত্রগুলি সাধারণত মেটে রঙের বা কৃষ্ণবর্ণের। সেখানে পালযুগে প্রাপ্ত মৃৎপাত্রগুলি প্রায় লাল রঙের। এই রঙের প্রভেদ প্রমাণ করে, পালযুগের মৃৎপাত্রগুলি অপেক্ষাকৃত উৎকৃষ্ট পলিমাটি দিয়ে তৈরি হয়েছিল। দেবলগড়ের সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে একটি অদ্ভুত লালমাটির নির্মিত চমৎকার কারুকার্য করা মৎসাকৃতির বড় ট্রে পাওয়া গেছে। সম্ভবত মাছের লেজটি ধরার কাজে এবং বাকি চওড়া অংশটি যজ্ঞের অগ্নিবহনে ব্যবহৃত হত।
আরও পাওয়া গেছে পিতল ও ব্রোঞ্জের ধাতুপাত্র এবং তিনটি অপূর্ব সুন্দর বিষ্ণু মূর্তি। এর মধ্যে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত মূর্তিটি রাখা আছে গাংনাপুর থানার হেফাজতে। এই মূর্তিটি কষ্টিপাথর নির্মিত, দৈর্ঘ্যে প্রায় চার হাত, বাম কাঁধে উপবীত, মস্তিষ্ক ভগ্ন, পায়ের নিচে দুদিকে দুটি ক্ষুদ্র মূর্তির অবস্থান। জানি না, বখতিয়ার খিলজির নদীয়া আক্রমণের সঙ্গে এই ভাঙা মূর্তিটির সম্পর্ক আছে কিনা!
একটি মূর্তি গ্রামবাসীরা মন্দিরে রেখে পুজো করে। কিন্তু যেভাবে মূর্তিটিকে কাপড়ে জড়িয়ে রাখা আছে, তাতে সামান্য মুখমণ্ডল ছাড়া আর কিছু বোঝার উপায় নেই। তাছাড়া পূজারী কিছুতেই মূর্তির ছবি তুলতে দিতে রাজি নন।
সেনযুগের সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট যে মূর্তিটি পাওয়া গেছে সেটি ত্রিবিক্রমরূপী বিষ্ণুমূর্তি। পিছনের ডানহাতে গদা, বামহাতে চক্র। সামনের ডানহাতে পদ্ম, বামহাতে শঙ্খ। উপরে মালা হাতে দুজন গন্ধর্ব, নীচে বামে ভূদেবী ও ডাইনে ভৃগু আবার কেউ কেউ মতামত দিয়েছেন কামদেব ও দেবী।
এই মূর্তিটির শিরোস্থান দাক্ষিণাত্যের চালুক্য ও হয়েসলা শিল্পরীতির ন্যায়। ভুললে চলবে না যে সেন বংশ আদিতে কর্ণাটকি ব্রাহ্মণ।
আমার ধারণা ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পৃষ্ঠপোষক সেন রাজাদের আমলে দেবগ্রামে পালযুগের বৌদ্ধ জনপদ বিলুপ্তির পথে এগিয়ে যায়। শুরু হয় বৌদ্ধ বিহার থেকে দেবালয়ের বিবর্তন। সেন জমানায় নির্মিত দেবালয়ের বহু নিদর্শন দেবলা পুকুর এবং নিকটবর্তী অন্য পুকুরগুলি থেকে পাওয়া গেছে। এর মধ্যে আছে বিশাল বিশাল মাকরা পাথরের চাঁই, স্ট্যাকর কাজযুক্ত অসম্ভব শক্ত পিলারের অংশ, প্রচুর পরিমানে ভাঙা ইঁটের টুকরো এবং বিভিন্ন আকারের প্রচুর আস্ত ইঁট। যে বিশালকায় কিন্তু সরু ইঁটগুলি পাওয়া গেছে(১৮" থেকে ২৪") সেগুলি সম্ভবত ব্যবহৃত হত ঘরের ছাদ তৈরিতে। আরো যে প্রচুর পরিমাণে ফিলাইট শিলা যত্র তত্র পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলি সম্ভবত ব্যবহৃত হত ঘরের বা দেবালয়ের মেঝে তৈরিতে, কারণ এই শিলাইট শিলা নমনীয় এবং সহজেই একে বিভিন্ন মাপে কাটা যেত।
দেবলগড়ের চতুর্দিকে মাটির পাঁচিল দিয়ে ঘেরা এবং চার কোনায় চারটি উঁচু গম্বুজ ছিল, যার মধ্যে একটি ভগ্ন গম্বুজ এখনো দাঁড়িয়ে আছে। আমার মনে হয় সেন বংশের শেষের দিকে যখন মুসলিম সুলতানদের আক্রমণের সম্ভাবনা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছিল তখন এই দেবলগড় রাজপ্রাসাদ, দেবলা পুকুর ইত্যাদিকে বেষ্টন করে এই পাঁচিল এবং গম্বুজ তৈরি করা হয়েছিল। গম্বুজগুলি আসলে ছিল ওয়াচ টাওয়ার। বর্তমানে যে একটি মাত্র গম্বুজের ধ্বংসাবশেষ এখনও দাঁড়িয়ে আছে, তার ধ্বংসপ্রাপ্ত ঢিপির উচ্চতা কম করে ৫০/৬০ ফুট। তাহলে কল্পনা করুন ১০০০ বছর আগে এটি কত উঁচু ছিল। এখানে গেলে, এই পাঁচিল ঘেরা গাংনাপুর সংরক্ষিত বনের অংশটির সঙ্গে আপনি 'রক্ত মৃত্তিকা বিহার' বা 'বানগড়' প্রত্নক্ষেত্রের মিল পাবেন।
বিজয় সেনের পুত্র বল্লাল সেন নিঃসন্দেহে পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। দানসাগর এবং অদ্ভুত সাগর রচনা তার প্রমাণ। কিন্তু সেই তিনিই আবার ব্রাহ্মণ্যবাদীদের হাত শক্ত করতে হিন্দু সমাজে কঠোর কৌলিন্য প্রথা চালু করে সমাজের মধ্যেই বিভাজনের বীজ বপন করেন, যা পরবর্তীতে বাংলায় মুসলিম শাসনের পথকেও প্রকারান্তরে সাহায্য করেছিল। কত হিন্দু মেয়ের জীবন যে এই কঠোর কৌলিন্য প্রথায় শেষ হয়ে গেছিল, সাহিত্যে তার অনেক নমুনা আছে, পথের পাঁচালির ইন্দিরা ঠাকরুন বা শ্রীকান্তের রাজলক্ষ্মী। পথের পাঁচালিতে বিভূতিভূষণ তো একটি অনুচ্ছেদের নামই দেন- বল্লালি বালাই।
বল্লাল সেনের পুত্র লক্ষ্মণ সেনের সময়কালের তাম্রফলক আবিষ্কৃত হয়েছে দেবগ্রামের আনুলিয়ায়। লক্ষ্মণ সেনও শিল্প-সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁরই সভাকবি ছিলেন গীতগোবিন্দ লেখক জয়দেব এবং পবনদূত রচয়িতা ধোয়ী কবি।
বখতিয়ার খিলজীর(১২০৪-১২০৫) নদীয়া আক্রমণের মধ্য দিয়েই বাংলায় মুসলিম বা সুলতানি যুগের সুচনা হয়। ব্যাপক হত্যালীলা, লুটপাট এবং ধ্বংসকাণ্ড চালিয়ে প্রচুর ধনসম্পদ লুট করে, অসংখ্য মানুষকে বন্ধক বানিয়ে, বখতিয়ার খিলজি আরো উত্তর পশ্চিমে অগ্রসর হন। এই ধ্বংসকাণ্ডের বিবরণী লেখা আছে (১২৬০ সালে রচিত) 'মিনহাজ-উস-সিরাজ' এর 'তাবকাৎ -ই-নাসিরী' তে।
স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, তাঁরা দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করেন- তখন দেবগ্রামের স্থানীয় শাসকের নাম ছিল দেবপাল, তাঁর রাজধানী ছিল দেবগ্রাম বা দেবলা। বহিরাগত মুসলিম সুলতানের সঙ্গে সংঘর্ষে এই রাজবাড়ির সঙ্গে বর্ধিষ্ণু জনপদ দেবলা ধ্বংস হয়। রায় গুণাকর ভারতচন্দ্রের "অন্নদা মঙ্গল"-এ লেখা আছে যে দেবী অন্নপূর্ণার ক্রোধে দেবপালের পতন ঘটে।
সেন যুগে নির্মিত দেবালয়ের ধ্বংস স্তূপের উপরই নির্মিত হয় সুলতানি যুগের রাজত্ব ও শাসন ব্যবস্থা। স্তরীভূত সভ্যতার সবচেয়ে উপরের স্তর থেকে প্রাপ্ত মৃৎপাত্রগুলি আকারে পূর্ববর্তী যুগের থেকে অনেক বড়। এই যুগে নির্মিত পাত্রগুলি প্রধানত বড় মুখের হাঁড়ি, গামলা, উঁচু কানাওলা থালা ইত্যাদি। আরো পাওয়া গেছে, সুরাপাত্র, হুঁকো ইত্যাদি। এই যুগের মৃৎপাত্রের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এগুলি প্রধানত কৃষ্ণ বর্ণের। সম্ভবত কাঠের আগুনে পোড়াবার জন্যই এই কালো রং। কিছু কিছু পাত্রের গায়ে সুন্দর নকশা দ্বারা সজ্জিত, আবার কিছু পাত্রের গা অতি মসৃণ। তবে প্রতিটি পাত্রের ভিতরেই একটি চমৎকার মসৃণ প্রলেপের আস্তরণ দেওয়া, বিশেষজ্ঞদের মতে এই প্রলেপ তৈরিতে ব্যবহৃত হতো কালো পলিমাটি, চুন, গুড়, সর্ষের তেল, ডিমের কুসুম ইত্যাদি। মৃৎপাত্রকে ভাঁটিতে কাঠের আগুনে পোড়ানোর পরেই এই জৈবিক আস্তরণ দেওয়া হত।
দেবগ্রাম প্রত্নক্ষেত্র থেকে সুলতানি যুগের আর একটি উল্লেখযোগ্য প্রাপ্তি হচ্ছে ৬৫৩ হিজরি বা ১২৫৫ খ্রিস্টাব্দের রৌপ্য মুদ্রা এবং ১২৩৭ হিজরিতে মুদ্রিত সম্রাট শাহ আলমের তাম্র মুদ্রা।
এরপরে অর্থাৎ ওপরের স্তর হওয়া উচিত ছিল কোম্পানির যুগ বা ইংরেজ যুগের। কিন্তু তা হয়নি। হয়তো কোনও ভয়াবহ বন্যা বা মহামারীর ফলে এই সমগ্র অংশটি পরিত্যক্ত হয়। পুরো এলাকাটি ঢেকে যায় এক ঘন অরণ্যে। এই পরিত্যক্ত জায়গায় তখন ছিল অসংখ্য বৃহৎ মহীরূহ যেখানে বিচরণ করত সুন্দরবনের বাঘ, হরিণ ইত্যাদি। এই স্তরে বাঘের দাঁত বা হরিণের শিং-এর মতন জীবাশ্ম প্রাপ্তি আমার কথার সত্যতা প্রমাণ করে।
সমগ্র দেবগ্রাম এবং তৎসংলগ্ন প্রত্নক্ষেত্র থেকে প্রাপ্ত সংগ্রহের উপর ডাঃ বিশ্বজিৎ একটি ক্যাটালগ তৈরি করেছেন যেটি আপনারা দেবগ্রাম সংগ্রহশালায় পাবেন। কিন্তু যাঁরা দেবগ্রাম প্রত্নক্ষেত্রকে বাঁচাবার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন, তাঁরা কেউ প্রত্নতাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞ নন। ক্ষুদ্র জ্ঞান নিয়ে, সম্পূর্ণ নিজেদের গাঁটের পয়সায়, চাকরি থেকে ছুটি নিয়ে, মিউজিয়াম চালানো থেকে ক্যাটালগ বানানো, ভিডিও এবং স্টিল ছবির ডকুমেন্ট করা, সবই করে যাচ্ছেন এই আশায় যে দেবগ্রামে একদিন বানগড়, চন্দ্রকেতুগড়, রক্ত মৃত্তিকা বিহারের মতন কর্মকাণ্ড শুরু হবে। বহুবার বহুজায়গায় আবেদন, নিবেদন সত্ত্বেও কোনো কর্তৃপক্ষ সেভাবে আজ অবধি এগিয়ে আসেনি।
যেভাবে JCP মেশিন দিয়ে ধানজমি এবং পুকুর খোঁড়া হচ্ছে, ১০০ দিনের কাজে-অবৈজ্ঞানিক ভাবে মাটি কাটার ফলে- এই ঐতিহাসিক স্থলের স্তরীভূত সভ্যতার বিনাশ হচ্ছে, তাতে খুব শীঘ্রই দেবলগড়ের অস্তিত্ব লোপ পাবে। এবং সেই দিন আসতে দেরি নেই।
আপনারা দেখুন, অনুভব করুন, ভাবুন- দেবগ্রাম কি কেবল একটি বিলুপ্ত জনপদের ভুলে যাওয়া ইতিহাস হয়েই থাকবে ?