দেশি ধানের চাষ ও বীজ সংরক্ষণ : সমস্যাটা কোথায়, সমাধানই বা কী?

উর্বর পলিবিধৌত সুন্দরবনে খরিফ মরশুমে কোনো রাসায়নিক সার-কীটনাশক ছাড়াই বেশ ভালো ফলন হতো নানারকম দেশি ধানের। উঁচু, মাঝারি, নীচু নানা ধরনের জমির জন্য বিভিন্ন দেশি জাতের নোনা ও বন্যা সহনশীল ধানের জাত ছিলো যা বংশপরম্পরায় হাতে রেখে মানুষ চাষ করতো। কিন্তু চাষিরা এতো স্বনির্ভর হলে কর্পোরেটের লাভ কোথায়? তাই আশির দশকে ‘কোম্পানী’র রাসায়নিক সার, বিষ ও বীজ বাজারে এলো। এটা একটা প্যাকেজ অর্থাৎ ওই হাইব্রিড বীজ কিনলে প্রচুর রাসায়নিক সার, বিষ, বীজ কিনতে হবে, প্রচুর ভৌম জলের প্রয়োজন হবে তাই সার, বিষ, বীজের সঙ্গে পাম্পসেট, পাইপ এগুলোও প্রচুর বিক্রি হবে। এইভাবে সুন্দরবনের কৃষিজমির মাটি নষ্ট হতে থাকলো আর কয়েক দশকেই প্রায় লুপ্ত হয়ে গেলো দেশি ধানের জাতগুলি।
প্রাকৃতিক দূষণ গত কারণ থাকলেও প্রচুর সার, বিষ ব্যবহার করার ফলে মাটির স্বাস্থ্যহানি হয়ে ধানের ফলনে টান পড়লো, আরেক দিকে চাষির চাষের খরচ এত বেড়েগেলো যে দেনার দায়ে তাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হলো, ওদিকে ধানের দামও ন্যায্য মূল্যের চেয়ে কম। এমতাবস্থায় অনেকেই চাষ ছেড়ে দিচ্ছে। বহু পরিবারের বর্তমান প্রজন্ম চাষে বিমুখ। আসলে এরকমটাই চেয়েছে আমাদের রাষ্ট্র। কৃষক আপনিই জমি ছেড়ে দিতে চাইলে তাকে দিয়ে নানারকম চুক্তি চাষ করানো যাবে যা ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে গ্রামে গ্রামে ব্রয়লার মুরগির পোল্ট্রি স্থাপনের মাধ্যমে। সুন্দরবনে চাষবাসের এই হাল হয়েছে বলেই প্রচুর মানুষ বাইরে চলে যাচ্ছে রোজগার করতে। এই ঘটনাকে “ইকোসিস্টেম রিফিউজি” বলা যায় অর্থাৎ যেখানে ইকো সিস্টেম পরিকল্পিত ভাবে নষ্ট হয়েছে বলে তার প্রভাবে মানুষকে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হতে হচ্ছে।
কিন্তু, ইয়াস বন্যার পরে দিনে রাতে মানুষের মুখে শুনছিলাম বিভিন্ন দেশি ধানের কথা। স্মৃতি রোমন্থন করে তাঁরা ধানগাছের উচ্চতা, ধানের রঙ, চালের রঙ, ভাত মুড়ি খইয়ের স্বাদ এর কথা বলতে থাকেন। তাঁরা এও বলছিলেন যে এই বন্যা পরবর্তী পরিস্থিতিতে কৃষককে একমাত্র সুরক্ষা দিতে পারে ওই দেশি ধানগুলিই। তাদের ফলন কম হতে পারে কিন্তু “তারা কখনো কৃষককে মারবে না”। এই কথাগুলো শুনতে শুনতে কয়েকজনের উৎসাহে আমাদের দেশি ধান সংরক্ষণ করার প্রচেষ্টা শুরু হলো।
আলোচনার প্রেক্ষাপট সেলেমারী, সপ্তমুখীর তীরে দূর্বাচটি গ্রামপঞ্চায়েতের কামদেবনগর গ্রাম, দক্ষিণ সুন্দরবন। এঁটেল মাটি, গ্রামের বেশ খানিকটা অংশ নীচু, নোনা ও মিঠা জলের বন্যার জল অনেকাংশেই জমে থাকার ফলে চাষবাস নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। প্রাকৃতিকও মনুষ্যসৃষ্ট দুই কারণেই বিশ্ব পরিবেশ দূষণ খুব বেড়েছে। সমুদ্রের তাপমাত্রা বেড়েছে। তাই সুন্দরবনে বেড়েছে সাইক্লোন ও বন্যার প্রকোপ। তার ওপরে সুন্দরবনের দিকে সমুদ্রজলতলের উত্থানের পরিমাপ বিশ্বের অন্যান্য অংশের তুলনায় বেশি। আয়লার পরে কয়েকবছর ফাঁক দিয়ে এখন পরপর ঘটে গেছে ফনী, বুলবুল, আম্ফান, ইয়াসের মতো ভয়াবহ দুর্যোগ। ইয়াসে নোনাজলের বন্যার পর শুরু হলো অতিবৃষ্টি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব খুব দ্রুত প্রকট হয়ে উঠতে দেখা গেলো৷ কামদেবনগর, হরেকৃষ্ণপুর এর মতো অসংখ্য গ্রাম বেশ নিচু। উঁচু জমির পরিমাণ কম। সঠিক গ্রামবসতি পরিকল্পনা না থাকার কারণে অনেক গ্রামের জলনিকাশী ব্যবস্থা ভালো নয়, তাই নোনাজল ঢোকার পরে এইসব গ্রামে জল দাঁড়িয়েছিলো কোথাও পনেরো দিন, কোথাও একমাস, কোথাও দুইমাস!
এখন এইরকম পালটে যেতে থাকা জলবায়ুগত অবস্থানে কৃষকেরা যে হাই-ইল্ডিং বা উচ্চফলনশীল জাতের ধানের চাষ করছিলেন সেগুলো আর টিকতে পারছে না। আমন মরশুমে কোনোরকম তবু হয়। বোরোতে ভালো হয় না। ফলন কমছে। মাটির স্বাস্থ্য ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। কৃষকের রোজগারও কমছে। কেনো? এখানে বলি, হাই-ইল্ডিং কিন্তু হাই-রেস্পন্সিভও বটে। মানে এই বীজ চাষ করতে গেলে মাত্রাতিরিক্ত জল, রাসায়নিক সার ও বিষের প্রয়োজন হয়। তার ফলে মাটিতে থাকা অণুজীবসহ কেঁচোর মতো উপকারী প্রাণীর মৃত্যু ঘটে, সেচের জন্য প্রচুর ভৌমজল খরচ হয়। যেসব মাংশাসী পোকারা শাকাহারী পোকাকে খেতো তারা মারা পড়ে, ফলে ধানখেকো পোকার উপদ্রব বেড়ে উঠতে থাকে। আগে মোটামুটি চাষিরা জানতেন তিন রকম পোকার কথা। এখন সেটা বেড়ে হয়েছে প্রায় পঁচিশ ছাব্বিশ! কারণ আমরা মাঠের যে স্বাভাবিক বাস্তুতন্ত্র, তাকে ধ্বংস করে ফেলেছি। খাদ্য খাদক শৃঙখল ভেঙে দিয়েছি।
গাঙ্গেয় দক্ষিণবঙ্গে মানুষের প্রধানতম খাবার হলো ভাত। ভাত শক্তি দেয় উদয়াস্ত খাটার। সকালে পান্তা, দুপুরে ভাত, রাতে আবার ভাত। কিন্তু এমন চলতে থাকলে ভাতে মারার যোগাড় হবে। [রেশনের চাল? তাতে অনেক সমস্যা আছে। সেকথা অন্যত্র আলোচ্য]। কৃষক এ প্রশ্নও করতে পারেন, “জমি থাকতে রেশনের ওই পালিশ দেওয়া চাল খাবো কেনো?”
সে অধিকার তার আছে!
যাইহোক, নোনাজল মিষ্টিজলের বন্যা পরবর্তী টালমাটাল অবস্থা সামলাতে নোনাশ্রী ধান দেওয়া হলো। কামদেবনগরে ইয়াসের পর অনেকেই সে ধান নেয়নি। যারা নিয়েছিলেন তাদের জমিতে নোনাশ্রী এত খারাপ ফল করলো যে কৃষি দপ্তরে অভিযোগ দায়ের করতে হলো ( কোনো লাভ নেই জেনেও)। অনেক কৃষক ওই ধান নেনই নি। কৃষকেরা কয়েক দশক আগের স্মৃতি থেকে এইবার বুঝতে শুরু করলেন এই মর্মান্তিক পরিস্থিতিতে সুন্দরবনের দেশি ধানের জাতগুলিরই প্রয়োজন ছিলো।
ভুঁড়িশাল, নাঙলমুড়া, তালমুগুর!
কিন্তু এইসবের জাতের অনেকগুলিই তো আর নেই। দেশি ধান বলতে চাষিদের হাতে আছে মূলত দুধের সর, মরিচশাল(চমৎকার মুড়ি ও খইহয়)। আরো কিছু কিছু যেমন চামরমণি, সীতাশাল, রূপশাল, কামিনীভোগ থাকলেও তার সংখ্যা সীমিত। অনেকের কাছেই সেসব নেই। দুধের সর ফলন ভালো দেয়, সুন্দর সরু চাল, খেতেও বড়ো সুস্বাদু, তাই সবমিলিয়ে টিকে রইলো। দুধের সরের আরেকটা বিশেষত্ব ওর “ইলংগেশন রেশিও” অর্থাৎ চাল ভাতে বাড়ার ক্ষেত্রে দুধের সর এদেশের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জাত৷
এমতাবস্থায় আমাদের মনে হলো সুন্দরবনের নিজস্ব যে ধানগুলি হতো সেগুলি জোগাড় করে আমরা একটা আর্কাইভ বানাবো। সেই আর্কাইভেপ্রতিটি ধানের চরিত্রায়ন করে সমস্ত তথ্য লিপিবদ্ধ করা থাকবে।
কিন্তু এত কম ধানবৈচিত্র্য আর ওই উচ্চফলনশীল ধান দিয়ে বোরো মরশুম সামলানো যাচ্ছে না। কেউ বলতে পারেন বোরোতে ধান করবো কেনো? মাটির নীচের জল নষ্ট হয়! এখানেই দেশি ধানের মজা! হাতে অনেক সংখ্যক দেশি ধানের বিকল্প থাকলে ৬০-২০০ দিনের ধানের মধ্যে যেকোনো প্রজাতি বেছে নিয়ে চাষ করা যায়। হিসেব করে নেওয়া যায় বিঘাপ্রতি, কেজিপ্রতি ধানের জন্য জল কতটা লাগবে। বোরো মরশুমে পুকুরের জল দিয়ে দেশি ধানের চাষ করেন এখনো এমন কৃষক আছেন। মনে রাখতে হবে পরিবর্তিত এই পরিস্থিতিতে অনেক ক্ষেত্রে কৃষক কেনিজের খোরাকির জন্য ধান চাষ করতে হতেই পারে। তাছাড়া আরো নানা সমস্যা মিলিয়ে ধান এখনও এমন ফসল যা কম হলেও কিছু রোজগার কৃষককে দেয়।
তাহলে সমস্যা কী কী?
জলবায়ু পরিবর্তন, সময়ে বৃষ্টির অভাব, অসময়ে বৃষ্টি, প্রতিবছর সাইক্লোন, নোনাজলের বন্যা, অতিবৃষ্টির ফলে মিষ্টি জলের বন্যা, মাঠের মাটি লবণাক্ত থাকা, সেচের সমস্যা, বন্যার জল সরে যাওয়ার দীর্ঘদিন পরেও পুকুর, খাল, বিলের জল নোনা হয়ে থাকা।
এমতাবস্থায় আমাদের মনে হলো সুন্দরবনের নিজস্ব যে ধানগুলি হতো সেগুলি জোগাড় করে আমরা একটা আর্কাইভ বানাবো। সেই আর্কাইভেপ্রতিটি ধানের চরিত্রায়ন করে সমস্ত তথ্য লিপিবদ্ধ করা থাকবে। যাতে উঁচু, মাঝারি ও নীচু জমি অনুযায়ী, বৃষ্টি, সেচ, লবণাক্ততার সমস্যা অনুযায়ী, আউশ আমন বোরো মরশুম অনুযায়ী কৃষক ধান বেছে নিতে পারবেন ও নিশ্চিন্তে চাষ করতে পারবেন।
ফলন?
সংসদীয় গণতন্ত্রে যেমন সকলের পরিচয় “ভোটার”, পুঁজিবাদের এই ঘোরতর যুগে সকলের পরিচয় যেমন “ক্রেতা” , তেমনই সবুজ বিপ্লব পরবর্তী এ সময়ে কৃষিক্ষেত্রে একটাই কথা শোনা যায়, “ফলন, ফলন, ফলন”।
আরে বেশি ফলন খায় কে? বেশি ফলনের জন্য চাষিকে সঠিক দাম দেয় কে? বেশি ফলন ফলাতে গিয়ে মাটি মরে যাচ্ছে তার দায় নেয় কে? বেশি ফলনেও রোজগার কম বলে অনেক পরিবারের ছেলেমেয়েরা কৃষিকাজে বিন্দুমাত্র আগ্রহী নয়, এর দায় নেয় কে?
আর ফলন দিয়ে ধান মাপলে হবে?
দেশি ধান দেশি পদ্ধতিতে বা জৈব পদ্ধতিতে চাষ করলে একজন চাষি ধানের সঙ্গে পেতো শাক, গেঁড়ি গুগলি, নানারকম মাছ, কচ্ছপ। কী সুন্দর চিংড়ি হতে দেখেছি ধানক্ষেতে। ধানক্ষেত মাগুর মাছের প্রজনন ক্ষেত্র। এক বিঘা মাঠে যদি পঞ্চাশ কেজি মাছ ওঠে তো কম করে ১০০ টাকা কেজি দরে একজন চাষি ৫০০০ টাকা রোজগার করতে পারে। গভীর জলের ধানের মাঠে মাগুর হবে ভালো, সেখান থেকে রোজগার আসবে ভালো। রোজগারের আগে তার নিজের খোরাকি। ধানের মাঠ থেকে একটা কি একাধিক পরিবার বৈচিত্র্যময় খাবার পাচ্ছে প্রায় বিনামূল্যে। প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে বাজারের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে না! এই মাছের সবটাই না খেয়ে, না বেচে কিছু সে পুকুরে রেখেও দিতে পারছে৷
এরপরে যদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথায় আসি তো আজ মুখে মুখে মালাবতী’র নাম শুনি। দুধেরসরের মতোই তার ফলন। কিন্তু সে হাওয়ার ধাক্কায় মাটিতে পড়ে গেলেও ফলনে মার যাবে না। জল বাড়লে সেও ঠিক বেড়ে উঠে ফলন দেবে! আজ তার কথা ভেবে হাহাকার!
আমরা এবছর মালাবতী ধান জোগাড় করেছি। একে বাঁচাতেই হবে। এর চাষ বাড়াতেই হবে।
বন্যার নোনাজল তখনো নামেনি। সন্ধ্যের মুখে কৃষকদের কাছে শুনছি নাঙলমুড়ার কথা! কী জেদি সেই ধান। যত দুর্যোগ হোক। ফলন সে দেবেই। চাষিকে খালি হাতে ফেরাবে না। না খেয়ে মরতে দেবে না।
দুধেরসর মাঝারি বা উঁচু জমির ধান। তাহলে শুধু দুধেরসর দিয়ে কাজ চলবে? চলবে না। তালমুগুর, লাল গেতু, ঘেউস, মাতলা, হ্যামিল্টন, নোনাবখরা বা নোনবগড়া, ট্যাংরা, হোগলা, মালাবতী এই জাতগুলি দুধেরসরের চেয়েও বেশি লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে।
আবার পশ্চিম শ্রীধরকাটি জনকল্যাণ সংঘ থেকে বিষ্ণুদা, তাঁদের মাঠপর্যায়ের পরীক্ষালব্ধ ফল থেকে জানাচ্ছেন যে বন্যার পরে তালমুগুরের চেয়েও, এককাঠি চাষে কামিনীভোগ দুর্দান্ত ফলন দিয়েছে!
বিষ্ণুদা বলছেন, “একথা গবেষকরা বিশ্বাস নাও করতে পারে কিন্তু আমরা হাতেনাতে এরকমই দেখছি।”
শুধু নোনা সহনশীল ধানের জাত রাখলেই হবে না। হাতে রাখতে হবে অতিবৃষ্টি সহনশীল ধানের জাতও। যেগুলি বেশি জলেও দাঁড়িয়ে থেকে ফলন দিতে পারবে। আমাদের সংগ্রহে তাই আছে জলকামিনী, কবিরাজশাল, ঝিঙাশাল, আলতাপাটি, রূপশাল, সীতাশাল, দাঁড়শাল, রাবণশাল, খেজুরছড়ি সহ আরো কিছু ধান।
সবশেষে যুক্ত হয়েছে “বোরমাসা” ও “রক্তশালী”। দুটিই বেশি জল সহ্য করতে পারে। এর মধ্যে রক্তশালী অন্তত সাতশো বছরের পুরোনো ধান, যার উল্লেখ পাওয়া যায় নানা কবিরাজী পুঁথিতে!
খরা সহনশীল জাত এবারে সংগ্রহ করা হয়নি। তবে আমন মরশুম শেষহলেই সংগ্রহ করা হবে।
এই সমস্ত বীজ এসেছে নানা জায়গা থেকে নানাভাবে। বীজ দিয়েছেন হাতিয়া, রায়গঞ্জ থেকে FIAM, দূর্বাচটির আরেকটি গ্রাম থেকে সুধাংশু দে, স্যার অনুপম পাল (রক্তশালী, বোরমাসা), শ্রী হিমাদ্রী করদা (চমৎকার), শ্রী শৈলেন চন্ডী (জলকামিনী)।
আমরা এদের সকলের কাছে কৃতজ্ঞ। অবশ্যই আগে আমরা আমাদের উদ্দেশ্য নিয়ে আলোচনা করেছি, জানিয়েছি। তারপরে ধান পেয়েছি।
উদ্দেশ্য কী?
আমাদের মূল উদ্দেশ্য:-
১) মূলত সুন্দরবনের নানা জাতের ধানকে সংরক্ষণ করা।
২) এবছর যে যে ধানের বীজ পেয়েছি তা থেকে ৩-৫ কেজি করে বীজধান তৈরি করা।
৩) পাথরপ্রতিমা, সাগরদ্বীপ ও নামখানায় তিনটি কৃষিমন্ডলীর মাধ্যমে এই সব ধানের চাষ বিঘায় বিঘায় ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করা।
৪) যতদিন না চাষ ছড়িয়ে যাচ্ছে, যত্ন সহকারে সবকটা জাতকে বাঁচিয়ে রাখা।
৫) ধানের চরিত্রায়ন করে তার এমন একটা রেজিস্টার বানানো যাতে কৃষক তাঁর জমি বুঝে, ঋতু বুঝে পছন্দমতো ধান বেছে নিতে পারেন।
ধান মানে আসলে তো শুধু ভাত খাওয়া নয়! যাদের জমি আছে তারা এখনো কিছুটা ধান করেন ভাত খাবার জন্য, কিছুটা করেন খই বা মুড়ির জন্য, কিছুটা আবার পায়েসের জন্য।
বাঙালি ভোজনরসিক। সুন্দরবনে আবার খাবারের বৈচিত্র্যও দারুণ। তাই আমাদের সংরক্ষিত ধানের তালিকায় তুলসীমুকুল, গোবিন্দভোগ, কামিনীভোগ এর মতো ধানও রয়েছে। সুন্দরবনের কবি মুকুন্দ গায়েনের কবিতা থেকে পেয়েছিলাম ‘চিনিকানি’ ধানের কথা। অসাধারণ পায়েসের চাল। চিনিকানি ধানে নাকি গোলা ভরে উঠতো কৃষকের। সে ধান প্রায় বিলুপ্ত। কিন্তু এখনো কয়েক জায়গায় টিমটিম করে চাষ হচ্ছে। সে ধান হাতে পাওয়া সময়ের অপেক্ষা।
ধানের বিচার কি শুধু তার ফলনে? তাহলে মুকুন্দ গায়েনের কবিতায়, বিদ্যা নদীর ধারে বসে লেখা কৃষক কবি বিনোদ বেরার কবিতায়, জীবনানন্দ দাশের কবিতায় এমন করে ধান এর প্রসঙ্গ আসতোনা। ধানথাকতো শুধু চাল যোগাবার বাহন হয়ে।
ধান আমাদের প্রাণ। ধান আমাদের সাংস্কৃতিক সম্পদ। ধান আমাদেরসুখ দুঃখ। অম্বুবাচী থেকে হালপুণ্য, গোছপুণ্য, কাদাসারা, ধানকে সাধ খাওয়ানো বা মা লক্ষ্মীর বিয়ে, হালাকাটা/আগকাটা/ধান্যচ্ছেদন/মুড়িকাটা, বেনাকি পুজো, সারবীড়া, নেড়া পোড়ানো, রান্নাপূজা, নবান্ন, আউনি বাউনি পিঠে পুলি ইত্যাদি উৎসব, এসবই ধানকে নিয়ে উদযাপিত হয়।
একটা ধান হারিয়ে যাওয়া আসলে অনেক বছরের প্রাকৃতিক, জলবায়ুগত, সাংস্কৃতিক ইতিহাস নিঃশব্দে হারিয়ে যাওয়া। কতো মানুষের শ্রম, পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষানিরিক্ষা, প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি ও তার থেকে নতুন শিক্ষালাভ করা ও উৎসব, এই যাপনকে ঘিরে৷
আজ অটোমেশনের যুগে আমরা কোনোকিছুতেই প্রশ্ন করতে আগ্রহী নই, ইতিহাস জানতে চাই না, অনেক কিছুতেই বিস্মিত বোধ করি না। গ্রামের এই কৃষকেরা তো বিজ্ঞানী। যাদের গবেষণাগার হলো মুক্ত ধানক্ষেতগুলি। বিভিন্ন ধানের চরিত্র সহ, পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষালব্ধ সবতথ্য তাদের মনে থাকতো। আমাদের দেশে কমবেশি ৮২,৭০০ জাতের ধান ছিলো। এত বৈচিত্র্যের প্রয়োজন? বৈচিত্র্য আমাদের সুরক্ষা দেয়। বৈচিত্র্য হাতে থাকলে তখনই জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে লড়ে আরো অনেকটা দিন টিকে থাকা যায়।
আমাদের উদ্দেশ্যের কথা শুনে এ পথের অগ্রজরা নানাভাবে পাশে দাঁড়িয়েছেন। বোরো মরশুমে জৈব পদ্ধতিতে ধান চাষ, প্রাকৃতিক উপায়ে আগাছা নিয়ন্ত্রণ, মিশ্রচাষ সম্পর্কে তাঁদের দীর্ঘ মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতার ঝুলি খুলে দিয়েছেন। তাঁরা বলছেন অনেক জায়গায় যত্ন সহকারে সংরক্ষণের কাজ করতে হবে। আমরা তাই শুধু পাথরপ্রতিমার কামদেবনগরে বীজ রাখিনি। আমরা ছড়িয়ে দিয়েছি নামখানার তিনজন কৃষকের কাছে(৩টি জাত), সাগরদ্বীপের দুজন কৃষকের কাছে(৪টি জাত) ও পাথরপ্রতিমার কামদেবনগরে ৫ জন কৃষকের কাছে অন্তত ২২টি জাত। কমবেশি ২৯ টি জাতের দেশি ধান নিয়ে এবারে কাজ শুরু হয়েছে।
তার মধ্যে কামদেবনগরে শ্রী অমল সামন্ত’র একটি প্লটে ল্যান্ড শেপিং-এর মাধ্যমে ধান সংরক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে তিন চার রকমের মাছ, শাক, সব্জী, ফল ও মশলা চাষ করা হয়েছে। আশা করি মরশুমের শেষে ধানের সঙ্গে অমলদা প্রচুর শাক সব্জী ফল, কিছু মশলা, মাছ ও ধান পাবেন। এবং এরকম আরো নানা কাজ যাঁরাই করছেন জৈব পদ্ধতিতে, তাঁরা নিজেদের পরিবারে খেয়ে উদ্বৃত্ত ফসল কিছুটা বিক্রি ও কিছুটা বিনিময় করবেন। যেমনটা আমরা শীতকালে করেছিলাম ইয়াসের বন্যা আর অতিবৃষ্টি সামলে উঠে।
কৃষকেরা ক্রমশ একা হয়ে পড়ছেন। সমবায়গুলি কেবল টাকা ধার দেওয়ার প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। কৃষক বাড়ির ছেলেমেয়েরা দেখে মা-বাবা উদয়াস্ত খেটেও সংসারের খরচ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। তাই তারা কৃষিকাজ পরিত্যাগ করে অন্য জীবিকা গ্রহণ করছে। সরকারী দপ্তরবীমা, যোজনা, প্রকল্প এইসব নিয়ে ব্যস্ত। দেশি ধান সম্পর্কে সম্যক গবেষণা না করেই আবার ল্যাবরেটরিতে হাইব্রিড ধান আবিষ্কারের কাজশুরু হয়েছে যার প্রয়োজনীয়তা এবং যুক্তি বোঝা যাচ্ছে না! কৃষক মন্ডলী বা সমবায় নেই বলে একলা কৃষক পড়ে যাচ্ছেন খোলা বাজারে দালালদের হাতে। কৃষক ঐক্যের পথে যে অন্তরায় তার সমাধান করবার মতো নেতৃত্বের অভাব। কৃষক, রোজগার কম হয় বলে, চাষ ছাড়া অন্য আর পাঁচটা কাজ করে সংসার চালানোর চেষ্টা করেন। পুঁথিগত শিক্ষা, বাজার রাজনীতি সম্পর্কে তেমন অবগতি না থাকার ফলে অনেক চক্রান্ত বুঝতে পারেন না। এমতাবস্থায়, শিল্পপতিদের বড়ো বড়ো স্টোরেজ গড়ে তুলতে দেখলে, সুন্দরবনের গ্রামে গ্রামে ব্রয়লার কোম্পানীর চুক্তিচাষ দেখলে ভয় হয়।
তাহলে কী পরের প্রজন্মের কাছ থেকে সমস্ত জমি চুক্তি চাষের জন্য নিয়ে শুধু অর্থকরী ফসল চাষ হবে?
বড়ো বড়ো মনোকালচার ফার্মে মাটির প্রচুর ক্ষতি হয়েছে। বেঁচে আছে প্রান্তিক চাষিদের এই দুই চার বিঘা করে জমি। যেগুলির সম্ভাবনা ও বৈচিত্র্য অনেক। এই সব জমি একত্রিত করে দেশি ধান মাছ শাকসব্জী পশুপালন সবটাই সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে করা সম্ভব এবং গ্রামকে গ্রাম ধরে বর্তমান পুষ্টির অভাব, খাদ্য নিরাপত্তার অভাব, অর্থাভাব, স্বাস্থ্যের ব্যাপক অবনমন থেকে গ্রামগুলিকে রক্ষা করা সম্ভব। এতে দেশি বীজের সংরক্ষণও হবে আবার চাষও হবে। মৃতপ্রায় গ্রামীণ অর্থনীতি তার বল ফিরে পাবে। পুঁজিপতিরা খাবারের দিকে খুব মন দিয়েছেন। খাবার থেকে তাদের লাভ হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। এ কথাটি আসলে বিপদজনক। সমঝদার মানুষ মাত্রেই বোঝে। পুঁজিপতিরা সমস্ত দেশি বীজের পেটেন্ট নিয়ে নেওয়ার আগে, সমস্ত জমি চুক্তিচাষের অন্তর্ভুক্ত করিয়ে নেওয়ার আগে, গ্রামে গ্রামে প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র গড়ে তুলে গ্রামের সমস্ত কিছু বাইরে নিয়ে চলে যাওয়ার আগে খুব দ্রুত আমাদেরকে মাঠে নেমে আসতে হবে।
সময় আর নেই!
(পুনশ্চ:- এই লেখাটা শেষ হতে হতে সব ধান উঠে গেছে। ৯ জন কৃষককে দিয়ে শুরু করে এবছর আমরা অন্তত ২০ জন কৃষকের হাতে নানা রকম দেশি জাতের ধান তুলে দেবো। মূলত তাঁরাই তাঁদের জমির চরিত্র অনুযায়ী ধানের জাত বেছে নিয়েছেন যেমন, পাথরপ্রতিমায় বিষ্ণুদা বেছেনিয়েছেন মালাবতী ও খেজুরছড়ি, সাগরদ্বীপে শুভাশীষ বেছে নিয়েছেন মৌলে, মানসীদি বেছে নিয়েছেন আমনের জন্য সীতাশাল ও বোরো’র জন্য চমৎকার। এইভাবে প্রতিবছর বিঘার পর বিঘায় দেশি ধানের চাষ বাড়িয়ে যেতে হবে। কৃষিক্ষেত্র রাসায়নিক সার বিষ থেকে মুক্তি না পেলে আমাদের ধ্বংসের আর বেশি বাকি থাকবে না!)
__________
লেখক দেশি ফসল চাষ ও বীজ সংরক্ষণ সংগঠন ‘পাথরপ্রতিমা রানার্স’-এর প্রতিষ্ঠাতা