মরুভূমিতে ‘একা’ দৌড় আর এক চারপেয়ে বন্ধুর গল্প

প্রশ্নগুলো বারে বারেই আসে।
‘এত দৌড়স কেন?’
‘এত দৌড়ে কী পাস?’
ঠিকই তো, আমি দৌড়নোর জন্য কোনো টাকা পয়সা পাই না, চাকরির জন্যও দৌড়ই না। কিন্তু অদ্ভুত সব চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে দৌড়তে থাকি। আসলে নিজের সীমা ঠেলে নিজেকে ক্রমাগত ছাপিয়ে যাওয়ার মধ্যে যে আনন্দ রয়েছে, তা ঠিক লিখে বোঝানো সম্ভব নয়। দৌড় শেষে মুখে যে অনাবিল হাসিটা ভেসে ওঠে, তাকে জড়িয়ে ধরার জন্যই দৌড়ই। তবে একবার দৌড় শেষ করে আনন্দ পাওয়ার বদলে মনটা বিষণ্ণ হয়ে উঠেছিল। সেই গল্পই বলি।
আরও পড়ুন
একদৌড়ে সান্দাকফু মাত্র পৌনে ছ’ঘন্টায়
গত বছর ডিসেম্বর মাসে সপরিবারে রাজস্থান ঘুরতে গিয়েছিলাম এবং সেখানে গিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে জয়সলমিরের মরুভূমিতে একা একাই ২৯ কিমি দৌড়েছিলাম। জয়সলমির থেকে বেরিয়েছিলাম ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে, রাজস্থানে তখন অবশ্য গভীর রাত। প্রথম ১৬-১৭ কিমি ছিল মরুভূমির মধ্যে দিয়ে পাকা রাস্তা। সামান্য চড়াই উতরাই বেয়ে ভোর ৭টাতেই ভূতুড়ে গ্রাম কুলধারাতে পৌঁছে যাই। প্রায় ১৫০-২০০ বছর আগে গ্রামটি পরিত্যক্ত হয়ে যায়। তারপর থেকে সেই অবস্থাতেই পড়ে আছে। তবে এখন গ্রামটি এএসআই-এর অধীনে এবং বিখ্যাত ট্যুরিস্ট স্পট।
আমি যখন পৌছলাম তখনো সূর্যোদয় হয়নি। প্রায় অন্ধকারে তখন একা কেয়ারটেকার বসে আছে। গেট খোলে আটটা থেকে। আমি একটু অনুরোধ করতেই প্রবেশের অনুমতি দিয়ে দিল। আর তখন থেকেই পিছু নিয়েছিল কেয়ারটেকারের কুকুরটি। পুরো গ্রামটিই ঘুরে ঘুরে দেখালো আমায়। তারপর আমার মতলব বুঝে প্রাচীর গলে পেছন দিক দিয়ে মরুভূমিতে যাওয়ার রাস্তাও দেখিয়ে দিল।
এরপর ১১ কিমি নির্জন মরুভূমির মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছি। ঠান্ডায় যখন হাত পুরো জমে যাচ্ছে, বহুকাঙ্ক্ষিত সূর্যোদয় তখন ঘটছে। রাস্তা বলে কিছুই নেই, ম্যাপ দেখে বুঝতে পারছি দুটো ২০০ মিটার উচ্চতার বালিয়াড়ি আমায় টপকাতে হবে। জিপিএস আর সূর্য দেখে দিকনির্নয় করে এগিয়ে যাচ্ছি। যত দূর দেখা যাচ্ছে ধূধূ করছে বালি, কেউ কোত্থাও নেই। মাঝেমধ্যে দেখা যাচ্ছে বুনো উট ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমার কাছে পড়ে রয়েছে আর একটি চকোলেট বার আর এক বোতল জল। রসদ বলতে এইটুকুই। তারমধ্যেই পরের গ্রামে পৌঁছাতে হবে। কিন্তু বাধ সাধছে বালি, জুতোর মধ্যে ঢুকে সে এক বিশ্রী অবস্থা। কিছুতেই দৌড়নো যাচ্ছে না। আবার এত ছোটো ছোটো ঝোপঝাড়, জুতো খুলেও যাওয়া যাবে না, তাই যত দ্রুত সম্ভব হাঁটছি।
আর রয়েছে আমার সঙ্গী সেই কুকুরটি। কিছু নামে একটা ডাকতে হয় ওকে, নাম দিলাম থর। প্রথম দু’তিন কিমি বেশ সঙ্গে সঙ্গে গেলাম। চার-পাঁচ কিমি যাওয়ার পর বুঝলাম বডি রিফুয়েলিং-এর সময় চলে এসেছে। একটাই এনার্জি বার, আর আমরা দুজন। এনার্জি বারটার আমি অর্ধেক খেলাম, আর আমার সেই নির্জন প্রান্তের অচেনা বন্ধুটিকে অর্ধেক দিলাম। এবার চেষ্টা করলাম ওকে ফিরিয়ে দেওয়ার, কারণ আমি তো অন্যদিকের গাড়ি রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে যাব। কিন্তু ও ওই শুকনো গরম মরুভূমি দিয়ে একা ১০-১২ কিমি ফিরবে কী করে?
আরও পড়ুন
নুব্রা থেকে একদৌড়ে লে—মাত্র ১১১ কিমি
নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলাম আমি একাই চলে যাব, ওকে ফিরে যেতে হবে, কিন্তু ও কিছুতেই আমাকে নির্জন মরুভূমিতে একা ছাড়তে রাজি নয়। খানিক বাদে ভয় দেখানোর জন্য ঢিল ছুড়তে লাগলাম আশেপাশে, তাতে দূরত্ব বাড়িয়ে অনুসরণ করতে লাগল। খানিক বাদে বুঝেও গেল, ওর গায়ে একটাও ঢিল লাগবে না।
১১ কিমি বাদে যখন পরের গ্রামের দোরগোড়ায় উপস্থিত হলাম, ও দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে দেখতে লাগল আমায়। একবার দেখে আর ঘুরে তাকাইনি।
আরও পড়ুন
যে-সব গল্পের জন্ম হয় ম্যারাথনেই
কী ভাবছিল আমায়? বেইমান? অকৃতজ্ঞ? নাকি অচেনা একটি লোককে পরের গ্রামে নিশ্চিন্তে পৌঁছে দেওয়ার উল্লাস ছিল চোখেমুখে? নাকি ওকে জড়িয়ে ধরেছিল একাকী না ফিরতে পারার ভয় আর হতাশা?
ভালোবাসার ভাষা বোঝা কি এতটাই কঠিন? বোধহয় নয়। তবে আমরা কিনা অকৃতজ্ঞ জাতি, খুব সহজেই নানা যুক্তি সাজিয়ে চোখমুখ বুজে সব অপরাধ হজম করে ফেলতে জানি। আমরা উদ্ধত জাতি, আমরা জানি, প্রকৃতি শতকোটি বছর ধরে আমাদের জন্য সবকিছু সাজিয়ে দিয়েছে। তাই বাকি জীবজন্তুরা টিকে আছে স্রেফ আমাদের দয়ায়। আসলে আমরা বহুদিন হল প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন।
পুনশ্চ: এরপর যদি কেউ কুলধারা গ্রামে ঘুরতে যান, থর তার নিজের জায়গায় ফিরে যেতে পেরেছিল কিনা জানালে ভালো লাগবে...