সৌমিত্র কাকু থেকে সৌমিত্রবাবু — দেবজ্যোতি মিশ্রের স্মৃতিচারণে একটি জীবন কাহিনি

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা একেবারে আশির দশকের গোড়ার দিকে, ওঁর ছেলের সূত্রে। আমার এক কবি বন্ধু ছিল বিতান ভৌমিক, এবং সে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল তার আর এক কবি বন্ধুর সঙ্গে, নাম সৌগত। এবারে সৌগতর বাড়ি গিয়ে জানতে পারলাম যে, সৌগতর বাবার নাম হলো সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। দেখা তো হলো, কিন্তু কোনও হেরফের বুঝলাম না।
আমাদের বেড়ে ওঠার সময় দেখেছি দাদা-দিদিরা সব সৌমিত্র ভক্ত, আবার ওদিকে মায়েরা সব উত্তম ভক্ত। আরও একটা ব্যাপার ছিল, আমরা যেভাবে বড় হয়েছি সেখানে কবিতা, সাহিত্য, শিল্পের খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। বাড়িতে ‘এক্ষণ’ পত্রিকা আসত, তাতে নাম দেখতাম ‘সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়’। মনে হতো, “আরে এই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়? অভিনেতা? তিনিই?”
তারপর একদিন সৌগত বলল, “চল আমাদের বাড়িতে চল।” গেলাম, লেক টেম্পল রোডের সেই বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে উঠে ওর ঘরে বসে আছি, হঠাৎ উনি “আচ্ছা বুবু, তুমি ওই বইটা কোথায় রেখেছ?” বলে ঘরে ঢুকলেন। আমরা তো নিয়মমতো উঠে দাঁড়িয়েছি, বন্ধুর বাবার সম্মানে। মুশকিল হলো যে অন্যান্য বাবাকে দেখলে ‘মেসোমশাই’ শব্দটাই মনে হতো, কিন্তু এই বন্ধুটির বাবা যখন সামনে এসে দাঁড়ালেন, তখন তাঁকে কী বলে ডাকব কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না। সে যে কী অস্বস্তি! একজন নায়ককে কি মেসোমশাই বলা যায়? পরবর্তী সময়ে ভেবেচিন্তে ‘কাকু’ বলাই স্থির করলাম। আমার জীবনে যে কয়েকজনকে গুরু রূপে দেখেছি, যেমন আমার বাবা, সেই দলে কিন্তু উনিও সামিল হয়েছিলেন, সে কথায় পরে আসছি।
সৌগত খুব ভালো ভায়োলিন (বেহালা) বাজাত। ওয়েস্টার্ন ক্লাসিক্যাল ভায়োলিন বলতেই মনে পড়ে, ওর বাড়িতেই প্রথম শুনি বেঠোফেনের ‘স্প্রিং সোনাটা’, বা ‘কোরাল সিম্ফনি’। একটা পত্রিকা বের করতাম আমরা তখন, নাম ‘সেতু’। সেই পত্রিকায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কবিতা দিচ্ছেন, আর আমরা এমন একটা ভাব করছি যেন কিছুই না - “আরে হ্যাঁ হ্যাঁ, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তো? জানি জানি,” গোছের হাবভাব। ছেলেমেয়ের বন্ধুদের অসম্ভব গুরুত্ব দিতেন, স্নেহ করতেন। আর তারা যদি একটু গান বা কবিতা বা শিল্পের দিকে ঝোঁকে তবে তো কথাই নেই।
জীবনের স্বাভাবিক নিয়মে এরপর আমরা যে যার মতো এগিয়ে চললাম। এবং ২০০২-০৩ সালে এল ‘পাতালঘর’, যেখানে উনি অঘোর সেনের চরিত্রটা করেছেন। আমাকে দেখেই বললেন, “তুমি মিউজিক করবে নাকি?” এদিকে আমি চারপাশে দেখছি, সবাই ‘সৌমিত্রদা সৌমিত্রদা’ করছে, আমার সমবয়সী, অথবা আমার চেয়ে ছোটরাও দাদা সম্বোধন করছে। সেখানে আমি কাকু বলি কী করে? আমি সঙ্কুচিত ভাবেই প্রসঙ্গটা তুললাম, দেখি ওঁর আদৌ কোনও অস্বস্তি নেই। বললেন, “যে নামে ডাকতে ইচ্ছে করে সেই নামে ডেকো।” এইভাবে কখন যেন কাজের মধ্যে দিয়েই উনি ‘সৌমিত্র কাকু’ থেকে ‘সৌমিত্রদা’ হয়ে ‘সৌমিত্র বাবু’ হয়ে উঠলেন। পরে ভেবে দেখেছি, উনি যখন যে চরিত্রটা করতেন, সেই অনুযায়ী বোধহয় আমার সম্বোধনের ভঙ্গী নির্ধারিত হতো। ওঁর যেসব কাজ আমার কাছে বিস্ময়কর মনে হতো, সেসব কাজের ক্ষেত্রে বোধহয় ‘সৌমিত্র বাবু’ বলে ভাবতাম, একটা দূরত্ব তৈরি হতো। মনে হতো, এমন কাজ যিনি করতে পারেন, আমি কি তাঁকে কাকু বলে ডাকতে পারি, কিংবা দাদা? তিনি তখন দূরের গ্রহ, ঠিক যেমন ‘সত্যজিৎ রায়’, অথবা ‘সলিল চৌধুরী’, তখন তিনি ‘সৌমিত্র বাবু’ হয়ে যান।
‘পাতালঘর’ করার সময় ওঁর চরিত্রের মুখে একটা গান ছিল। বললেন, “দেখো আমি শুরুটা গেয়ে দিচ্ছি, কিন্তু পুরোটা গাইব না, ওটা দেখে নিও।” তো আমরা শ্রীকান্ত আচার্যকে ডেকে বাকিটা করলাম, ওঁর বাচনভঙ্গী, কথা বলার কণ্ঠস্বরের সঙ্গে মেলালাম। এই ঘটনার উল্লেখ এই কারণেই, যে পরবর্তী কালে এই গান সংক্রান্ত আরও একটি ঘটনার কথা বলব পরে।
এরপর আরও বহু জায়গায় দেখা, কথা হতো, সামাজিক স্তরেই মূলত। ঋতুপর্ণ ঘোষ-এর ‘অসুখ’ ছবির মিউজিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছিল একবার, মনে আছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম ভাবে কথা হতো, কিন্তু কাজ করার সুযোগ ঘটল সুমন মুখোপাধ্যায়ের নাটক ‘রাজা লিয়ার’ (২০১১) করতে গিয়ে। এই নাটক সংক্রান্ত প্রেস কনফারেন্সে আমরা সবাই আছি, আমি আমার যেটুকু বলার ছিল বলেছি, হঠাৎ সৌমিত্রবাবু বলতে শুরু করলেন। বিষয়, ‘রাজা লিয়ার’-এর আবহসঙ্গীত। অনেকক্ষণ বললেন, এবং বললেন, “আমার মনে হয়, লিয়ার দেখা যায় শুধুমাত্র দেবজ্যোতির মিউজিক শোনার জন্য।” আমার ভেতরে কী যেন একটা বেজে উঠল, অদ্ভুত এক অনুভূতি। তার সঙ্গে ওঁদের বাড়ি যাওয়ার, ওঁকে অন্যভাবে অত কাছ থেকে দেখার কোনও সম্পর্ক নেই।
‘রাজা লিয়ার’-এর মিউজিক তৈরি হয়েছিল অনেকগুলো ধাপে। আজ কিছুটা হলো, হয়তো ১৫ দিন পর ফের কিছু যোগ হলো, বা পাল্টেই গেল। একদিন রিহার্সাল চলছে, উনি স্টেজ থেকে ডাকলেন, “দেবজ্যোতি এসেছ নাকি? গলা শুনতে পাচ্ছি।” আমি সাড়া দেওয়ায় উনি বললেন, “তুমি এখানে বোধহয় মিউজিকটা একটু চেঞ্জ করেছ না? আমাকে একটু দেখিয়ে দাও তো।” ব্যাপারটা হলো, উনি স্টেজে নিজের অবস্থান ঠিক করছেন মিউজিক অনুযায়ী, এবং আমার ওই সামান্য বদলের জন্যেও যে ওঁর অবস্থান পাল্টে যাচ্ছে, সেই বোধ থেকেই আমাকে ডাকা। সেদিন বলেই দিলেন, “আর চেঞ্জ কোরো না, কেমন? আমার মাপটা ঠিক থাকছে না, অসুবিধে হয়ে যাবে।” আমি শুধু ভেবেছিলাম, কী অসম্ভব পেশাদারিত্ব!
সে সময় আমরা দুজনেই ছবিও আঁকি। মনে আছে উনি বলেছিলেন, “আমরা দুজনেই পাগলামি করে ছবি আঁকি। মানুষ যদি সিরিয়াসলি দেখে খুব ভালো হয়।” এই ধরনের কিছু একান্ত ব্যক্তিগত সংলাপ আমার সারা জীবন মনে থাকবে।
এরপর এলো ‘ময়ূরাক্ষী’ (২০১৭) ছবি। অতনু (পরিচালক অতনু ঘোষ) আমাকে বলেছিল, ছবির একটি দৃশ্যে সৌমিত্রবাবুর চরিত্রের মুখে একটা স্বতঃস্ফূর্ত গান আছে, কফিশপে বসে। তার আগে উনি বলছেন, “প্রতিটা জীবনেই কিছু ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক প্রয়োজন”, বা ওই জাতীয় কিছু সংলাপ। তা গানটার ডামি রেকর্ডিং আমি করে দিলাম, চরিত্রের জটিলতা অনুযায়ী তাতে সুরের নানা ওঠাপড়া। একবারও মাথায় এলো না, ৮৩ বছর বয়সে উনি গানটা গাইবেন কীভাবে। খেয়ালই ছিল না, অত উঁচুনিচু নোট উনি সামলাবেন কী করে।
ছবির ডাবিং শুরু হলো, এবার তো ওঁকে গানটা গাইতে হবে। উনি শুনে প্রথমেই বললেন, “এটা আমার হবে না।” অতনু পড়ল মহা মুশকিলে। সৌমিত্রবাবুর চরিত্র বা বয়সের সঙ্গে মানানসই প্লেব্যাক কণ্ঠ পাওয়া একরকম অসম্ভব, উনি না গাইলে গোটা দৃশ্যটাই ফেলে দিতে হবে। এ তো আর সেই ধরনের ছবি নয় যে মান্না দে এসে ‘হয়তো তোমারই জন্য’ গেয়ে দেবেন। অথচ দৃশ্যটা ফেলে দিলে ছবির বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। “ছবির বড়ো ক্ষতি” - এই কথাগুলো শোনামাত্রই যেন অন্য মানুষ হয়ে গেলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। বললেন, চলো কোথায় যেতে হবে। তবে যেদিন স্টুডিওতে এলেন, সেদিনও আমি বুঝতে পারছি, এখনও আশা করছেন যদি রেহাই পাওয়া যায়। সেটা বুঝেও আমিও যাকে বলে মৃদু অথচ দৃঢ়ভাবে ওঁকে গাওয়ার দিকেই ঠেলে দিচ্ছি। মাইকের সামনে দাঁড়ালেন, আমার ডামি গানটা চলতে থাকল, এবং অবিশ্বাস্য ভাবে, মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে উনি গেয়ে দিলেন। আজও ওই দৃশ্যটা দেখলে বুঝবেন, কী নিখুঁত ওঁর সেই পারফরম্যান্স।
শেষ করব ‘বরুণবাবুর বন্ধু’ (২০২০) দিয়ে। মনে আছে, সম্পূর্ণ অন্য কোনও কারণে আমরা একটা প্রেস কনফারেন্সে বসে, সেখানে আমাকে ডাকলেন। বললেন, “ছবিটা তো ভালোই হয়েছে, আমার কাজটাও মন্দ হয়নি, কী বলো?” নিজের কর্মজীবনের, খ্যাতির এই স্তরে দাঁড়িয়েও যে অভিনেতা নিজের কাজ সম্পর্কে এত সজাগ, এত চিন্তাশীল, তাঁকে অনুপ্রেরণা ছাড়া আর কী বলা যায়?
এ ছাড়াও ওঁর আরও একটা দিক চিরকাল মনে থাকবে। শিল্পী হিসেবে নিজের সামাজিক কর্তব্যের প্রতি অবিচল নিষ্ঠা, অসুস্থ অবস্থায়ও উনি পৌঁছে গেছেন প্রতিবাদী আওয়াজ তুলতে, নিজের কবিতা দিয়ে, অভিনয় দিয়ে, শুধুমাত্র উপস্থিতি দিয়েই আরও জোরালো করে তুলেছেন প্রতিবাদের ভাষা। মনে পড়ে ‘শাখা প্রশাখা’ ছবিতে খাওয়ার টেবিলে বসে প্রশান্তের টেবিলের ওপর বারবার সজোরে চাপড়। প্রশান্তের চরিত্রটা হয়তো সত্যজিৎ রায় গড়েছিলেন সৌমিত্রবাবুর আদলেই। এমন একজন মানুষ যিনি ব্রাহমস শোনেন, বাখ শোনেন, এমন কিছু মূল্যবোধ নিয়ে চলেন যার সঙ্গে বর্তমান দুনিয়া মানিয়ে নিতে পারে না; সেই মানুষটাই ফুটিয়ে তুলেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
অনুলিখন - যাজ্ঞসেনী চক্রবর্তী