রাম-ঝড়ে জাতীয় পতাকা, রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে ব্রিগেডে বামেরা

শপশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ব্রিগেড একটা মাপকাঠি। রাজ্য রাজনীতিতে জাতে ওঠার প্রথম সিঁড়ি ওই সবুজ ময়দান। গত ৭ জানুয়ারি ব্রিগেডে সভা করে ডিওয়াইএফআই (DYFI), বৃহৎ অর্থে সিপিএম এবং বৃহত্তর অর্থে বামপন্থীরা জানান দিলেন, আসন সংখ্যায় শূন্য হলেও তাঁরা আছেন এবং বেশ প্রাণবন্ত ভাবেই আছেন। যে থাকাটা রাজ্যের ভবিষ্যতের জন্যেও খুব জরুরি।
বাংলায় শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের পরে আর কোনও বড়ো মাপের হিন্দুত্ববাদী নেতা তৈরি হয়নি। ১৯৫২-এ ভারতের প্রথম যে লোকসভা ভোট হয়েছিল, সেখানে কংগ্রেস পেয়েছিল ৪৪.৯৯ শতাংশ ভোট। সিপিআই ৩.২৯ শতাংশ ভোট। ভারতীয় জনসঙ্ঘ (আজকের বিজেপি) ৩.০৬ শতাংশ, হিন্দুমহাসভা ০.৯৫ শতাংশ এবং মুসলিম লিগ ০.০৮ শতাংশ ভোট। বাকিটা অন্যান্যরা।
১৯৫২ সালের সেই ভোটে কলকাতা দক্ষিণ-পূর্ব আসন থেকে জয়ী হয়েছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। পরে ১৯৫৩ সালের ২৩ জুন কাশ্মীরের জেলে শ্যামাপ্রসাদের রহস্যজনক মৃত্যু হয়। ওই শূন্য আসনে উপনির্বাচন হয়। জনসঙ্ঘ উপনির্বাচনে প্রার্থী দাঁড় করায় মীরাট ষড়যন্ত্র মামলায় ভারতীয় বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে ইংরেজেদের হয়ে যে আইনজীবীরা মামলা লড়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম, ব্যারিস্টার যশোপ্রকাশ মিত্রকে। ওই মামলায় সাজা হয়েছিল কলিকাতা দর্পণের লেখক রাধারমণ মিত্র, মুজাফ্ফর আহমেদ, পি সি জোশী, এস এ ডাঙ্গে সহ মোট ১৮ জনের। শ্যামাপ্রসাদের জেতা লোকসভার সেই কলকাতা দক্ষিণ-পূর্ব আসনে উপনির্বাচনে শোচনীয় ভাবে হেরে গেলেন জনসঙ্ঘের প্রার্থী ব্যারিস্টার যশোপ্রকাশ মিত্র। জয়ী হয়েছিলেন সিপিআই প্রার্থী ব্যারিস্টার সাধন গুপ্ত। যিনি একজন দৃষ্টিহীন মানুষ ছিলেন। ভোট পেয়েছিলেন ৫৮ শতাংশের বেশি। যদি শ্যামাপ্রসাদের প্রভাব কাজ করত, যা হওয়া স্বাভাবিকও ছিল, তা হলে তাঁর মৃত্যুতে খালি হওয়া আসনে আবেগের প্রভাবে জনসঙ্ঘের প্রার্থী নিশ্চয় জয়ী হতেন। শুধু তাই নয়, জনসঙ্ঘ-প্রার্থী যশোপ্রকাশ মিত্র শুধু জেতেননি নয়, ভোট পেয়েছিলেন মাত্র ৫.৪৩ শতাংশ। বাকিটা পেয়েছিলেন কংগ্রেসের প্রার্থী রাধাবিনোদ পাল, যাঁর তখন বিচারপতি হিসেবে বিশ্বজোড়া খ্যাতি, কলকাতা হাইকোর্টে এখনও তাঁর আবক্ষ মূর্তি রয়েছে। এই বিষয়ে এত কথা বলার কারণ একটাই, বিজেপির পক্ষে অবস্থাটা এখনও খুব একটা বদলায়নি। গত ২০১৯-এ পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির জেতা প্রায় সব আসনই আসলে জিতেছিলেন নরেন্দ্র মোদী। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির এখনও ভোটে জেতানোর মতো কোনও নেতা নেই। দিলীপ ঘোষের মধ্যে সম্ভাবনা ছিল এই শূন্যস্থান পূরণের, কিন্তু তাঁকে তাঁর দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব যে কোনও কারণেই হোক আড়াল করে রেখেছে।
অবিভক্ত পার্টি সিপিআই একসময় ভারতের সংবিধানকে বলেছিল ‘ফ্যাসিস্ট ডিক্টেটরশিপ প্রতিষ্ঠার রূপরেখা (পার্টি চিঠি ১৪-০১-১৯৫০)’। যে রবীন্দ্রনাথের গান তাঁরা ব্রিগেডে গাইলেন, সেই রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎকার একসময় সেন্সর করেছিল স্তালিনের রাশিয়া (‘বলা যায়’, অমর্ত্য সেন, পৃষ্ঠা ৪৯)।
বাঙালি সিপিএমকে শাসন ক্ষমতায় টানা ৩৪ বছর দেখেছে। গণতন্ত্রে কোনও একটি দলের এত দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকাটা সব অর্থেই খুব খারাপ নজির। সিপিএমের এই দীর্ঘ যাত্রায় জ্যোতি বসুই একমাত্র নেতা, তার পর অনেকটা দূরে দ্বিতীয় স্থানে সুভাষ চক্রবর্তীর নাম করা যায়, এর বাইরে ৩৪ বছরে কোনও বড়ো নেতা তৈরি হয়নি এই মার্কসবাদী দলে। বরং এই সময়েই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জননেত্রী হয়ে উঠেছেন সিপিএমের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে।
এই রকম একটা পরিস্থতিতে ডিওয়াইএফআই বা বলা যায় সিপিএম, বহুদিন পর একজন মীনাক্ষী মুখোপাধয়ায়কে খুঁজে পেয়েছে। যার ‘নন-এলিট’ ভাব ভঙ্গী, কথা-বার্তা ইতিমধ্যেই তরুণ-তরুণীদের মন অনেকটাই জয় করেছে। চে-র ছবির মতোই তাঁর ছবি আঁকা টি-শার্টও পরতে দেখা যাচ্ছে সমর্থকদের। এই উন্মাদনাটা রাজনীতিতে অনেক সময়ই ‘এক্স ফ্যাক্টর’ হয়ে ওঠে।
এটা ঠিক, পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী এবং কংগ্রেসের জন্য কোনও পরিসর এখনও দেখা যাচ্ছে না। সবটাই হয় তৃণমূল কংগ্রেস নয়তো বিজেপি। তবে গণতন্ত্রে এই ছবিটাই চিরস্থায়ী এমন ধরে নেওয়ারও কোনও কারণ নেই। রাজনীতির ইতিহাসও তা বলে না।
ব্রিগেডে ডিওয়াইএফআই ব্রিগেডে নিজেদের সংগঠনের লালতারা আঁকা সাদা পতাকার থেকেও বড়ো মাপের এবং বেশি উচ্চতায় টাঙিয়েছিল তেরঙা জাতীয় পতাকা। উইশ্যাল ওভারকাম নয়, মঞ্চে গান হয়েছিল, বাংলার মাটি বাংলার জল। ‘বাঞ্চ অফ থটস’ বই-এ আরএসএসের গুরুজি, এম এস গোলওয়ালকার ভারতের জাতীয় পতাকা এবং সংবিধানকে নিয়ে ব্যঙ্গ করে নানা মন্তব্য করেছেন। অবিভক্ত পার্টি সিপিআই একসময় ভারতের সংবিধানকে বলেছিল ‘ফ্যাসিস্ট ডিক্টেটরশিপ প্রতিষ্ঠার রূপরেখা (পার্টি চিঠি ১৪-০১-১৯৫০)’। যে রবীন্দ্রনাথের গান তাঁরা ব্রিগেডে গাইলেন, সেই রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎকার একসময় সেন্সর করেছিল স্তালিনের রাশিয়া (‘বলা যায়’, অমর্ত্য সেন, পৃষ্ঠা ৪৯)। ব্রিগেডে জাতীয় পতাকা এবং রবীন্দ্র সংগীতের মধ্যে দিয়ে একটা জাতীয়তাবাদী পথ অনুসন্ধানের ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে বামপন্থদের পক্ষ থেকে। নানা ভাষা নানা মত-এর মানুষকে পাশে পেতে এটা খুবই ভালো ভাবনা। কারণ এক সময় কমিউনিস্টদের প্রসঙ্গে বলা হত, মস্কোয় বৃষ্টি পড়লে ওঁরা কলকাতায় ছাতা মাথায় দিয়ে হাঁটেন।
বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ৩২ বছর পর, রাম মন্দির উদ্বোধনের ১৫ দিন আগে, ব্রিগেডের সভায় জাতীয় পতাকা, রবীন্দ্রনাথের গানের মধ্যে দিয়ে সিপিএম নিয়ন্ত্রিত ডিওআইএফআই-এর জমায়েতে একটা খোলা বাতাসের ইঙ্গিত পাওয়া গেল, স্বাধীন চিন্তার লক্ষণ দেখা গেল। আর দেখা গেল কমবয়সীদের ঢল। অসাম্প্রদায়িক মানুষ, সকলের সমান অধিকারে বিশ্বাসী মানুষ, কিছুটা হলেও ভরসা পায় এই ধরনের জমায়েত দেখে। ডিওয়াইএফের ব্রিগেডের বার্তা এটাই। এই পথে তাদের যাত্রা অব্যাহত থাকবে কি? থাকলে বামপন্থীদের শক্তি বাড়তে বাধ্য।
*মতামত লেখকের নিজস্ব। কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে আঘাত করা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়।