মুসলমানের গো-ভক্তি

মুসলমানের গো-ভক্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলে এখন চারিদিকে শোরগোল। বাসে, ট্রেনে, ট্রামে,বাজারে অলিতে-গলিতে কান পাতা দায়। হিন্দুদের একটা অংশ গোরুকে ভগবতী রূপে পুজো করেন ঠিকই, কিন্তু গ্রামীণ বাঙালি মুসলমানের গো-ভক্তি তার চেয়ে কম নয়। গোরু গর্ভবতী হলে তার যত্ন বাড়ে। প্রতিদিন রাতে ভাত খাওয়ার পর বাকি ভাতে জল দিয়ে রাখেন বাড়ির গিন্নি। সকালে সেই জল খাইয়ে দেওয়া হয় গোরুকে। গ্রামীণ মুসলমান এই জলকে বলেন, ‘আমানি’। আমানি খেলে গর্ভবতী গোরুর শরীরে শক্তি বাড়ে। গোরুর বাছুর হলে প্রথম দুধ দিয়ে ক্ষীর রান্না করেন গিন্নি। গোয়ালে যেখানে গাভীকে রাখা হয় ঠিক সেখানে খোঁড়া হয় উনুন। তার আগে মুসলিম বাড়ির গিন্নি সকালে উঠে স্নান করেন, তারপর গোরুকে ভাল করে সাবান দিয়ে স্নান করানো হয়। স্নানের আগে তার শিং, নাক, কান মাথায় মাখানো হয় সরষের তেল। তার গলায় পরানো হয় পিতলের ঘণ্টা, ফুলের মালা। এরপর রান্না হয় ক্ষীর। বাড়ির উঠোনে ডেকে সেই ক্ষীর খাওয়ান হয় পাড়ার লোককে। উঠোনে বাঁধা থাকে গাভী। তাকে সামনে রেখে তারই শুভকামনা ক'রে ভগবানের কাছে দোয়া চান পাড়ার লোক। এই ক্ষীর যায় পীরের থানে। যেখানে পীরের নজরগাহ্ নেই সেখানে ক্ষীর পাঠানো হয় মসজিদে। প্রথম দুধ মাটির পাত্রে করে রাতে রেখে আসা হয় বড় গাছের গোড়ায়। গিন্নি বলেন, সাপে পান করলে গোরুর মঙ্গল হবে। পুরাণ মতে সাপ মনসার বাহন।
কৃষককে যদি হিন্দু আর মুসলমানে ভাগ করি, তাহলেও গ্রামীণ বাংলায় দেখা যায়, বলদের প্রতি দরদ মুসলমানের কম নেই। নতুন বলদ কিনে বাড়ি নিয়ে এলে, শুদ্ধ কাপড়ে মুসলমান গিন্নি গাড়ু ভর্তি জল নিয়ে আসেন, বাড়িতে বৌমা থাকলে সঙ্গে থাকেন তিনিও। শাশুড়ি - বৌমার মাথায় থাকে ঘোমটা। গোয়ালে দেওয়া হয় ধুপ -ধুনো,রান্নাঘর থেকে আসে মশলা বাটা নোড়া, গাড়ু ভর্তি জলে নোড়া ধুয়ে গোরুর চার পা ধুইয়ে দেন গিন্নি - মা। তারপর দেন পা মুছিয়ে। গোরু তখন লক্ষ্মী মা। গ্রাম বাংলায় সামাজিক রীতি হল অতিথি হলেন নারায়ণ। বাড়িতে অতিথি এলে দাওয়ায় চৌকি পেতে গাড়ু ভর্তি জল দিতে হবে, সঙ্গে দিতে হবে গামছা, বাড়ির কোনো সদস্য গাড়ু থেকে জল ঢেলে দেবেন, নতুবা অকল্যাণ হবে। গোরুকে সেভাবেই দেবতা রূপে কল্পনা করে বরণ করা হয়। আসলে সেই হল কৃষকের সংসারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সদস্য।
মুসলমান কৃষক খুব সহজে গোরু বিক্রি করতে চান না। যে গোরু পোষ মানে, মাঠে মনিবের সঙ্গে শঠতা করে না, আমৃত্যু সে কৃষকের গোয়ালে থাকে। এমনকি বহু বাড়িতে মৃত্যুর পর তাকে কবর দেওয়া হয়। মুসলমান রীতিতে জীবিত থাকা অবস্থায় তার জন্য পাঠ করা হয় দোয়া-দরুদ। আর যে গরু পোষ মানে না, তাকে আদর -যত্ন করে, ভাল -মন্দ খাইয়ে তারপর মাঠের কাজের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেন কর্তা। না হলে অবশেষে বিক্রি। বিক্রি হওয়ার পর গোরু যখন গোয়ালের বাইরে আনা হয় তখনও তার গলায় পরানো হয় ফুলের মালা। ভাল করে সাজিয়ে তারপর তুলে দেওয়া হয় নতুন মালিকের হাতে। তখনও তার মঙ্গল কামনায় দোয়া চান মনিব।
বাঙালি মুসলমানের এই নিজস্ব ভগবতী বন্দনা আমাদের অনেকের অজানা।