শতাধিক অসহায় করোনা রোগীর ত্রাতা কোভিড কেয়ার নেটওয়ার্ক (Covid Care Network)

কোভিড কেয়ার নেটওয়ার্ক সম্পর্কে বলছেন ডা. অভিজিৎ চৌধুরী
কিছুদিন আগে খবরে জানা গিয়েছিল, এক সম্ভাব্য কোভিড আক্রান্ত ব্যক্তি আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে ছিলেন শোভাবাজারের কাছে। পরিবার এবং কর্মস্থল থেকে কোনো সাহায্যই পাননি। অসহায় অবস্থায় শুয়ে ছিলেন ফুটপাথে। এই ঘটনা যেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের কথা মনে করিয়ে দেয়। প্লেগ সংক্রমণে তখন এমনই অমানবিক হয়ে গিয়েছিল সমাজ। করোনার আক্রমণ ফের সেই প্লেগ মহামারির স্মৃতি ফিরিয়ে আনে। কিন্তু তখন শ্রীকান্ত এবং ইন্দ্রনাথের মতো সহৃদয় মানুষেরা ছিলেন, যাঁরা বিপদের পরোয়া না করে অসুস্থ অসহায় লোকেদের পাশে দাঁড়াতেন। এখনও তেমন মানুষ বিরল নয়। কোভিড রোগ থেকে সেরা ওঠা একদল কোভিড যোদ্ধা, চিকিৎসক এবং তাঁদের বন্ধুরা মিলে গড়ে তুলেছেন এক ফোরাম – ‘কোভিড কেয়ার নেটওয়ার্ক’ (সিসিএন)। করোনা সংক্রমিত রোগী এবং তাঁদের পরিবারের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন বিনামূল্যে। শত শত অসহায় কোভিড রোগীর ত্রাতা হয়ে উঠেছে এই ফোরাম।
একটি বৈঠক
ফোনে খবর দিলে ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করে দেয় সিসিএন, এমআর বাঙুর হাসপাতালের এমার্জেন্সি বিভাগে রোগীকে নিয়ে যাওয়া হয় দ্রুত। যদি দেখা যায় রোগীর কোভিড নেগেটিভ, অথচ টিবি-র লক্ষণ আছে, তাঁদেরও চিকিৎসার বন্দোবস্ত করা হয়। কোভিড নেগেটিভ অথচ করোনার উপসর্গ রয়েছে, এমন রোগীদের প্রতি নেওয়া হয় আলাদা যত্ন। প্রখ্যাত চিকিৎসক, পর্বতারোহী, মডেল, সঙ্গীতশিল্পী এমনকি ছাত্রছাত্রীরাও সিসিএনের সঙ্গে যুক্ত।
জরুরি উদ্ধার
বিশ্বের তাবড় তাবড় পর্বতশৃঙ্গ জয় করা বিখ্যাত পর্বতারোহী সত্যরূপ সিদ্ধান্ত এই ফোরামে সক্রিয়ভাবে রয়েছেন। মাসখানেক আগে তাঁর মামা হঠাৎই করোনায় আক্রান্ত হয়ে পড়েন। সেই বৃদ্ধের চিকিৎসার বন্দোবস্ত ও সেবার অভিজ্ঞতা এখন সত্যরূপ অন্যান্য কোভিড রোগীদের জন্য কাজে লাগাচ্ছেন। বিশিষ্ট মডেল মাধবীলতা মিত্রের মা গত মে মাসে অসুস্থ হয়ে দক্ষিণ কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন। মাঝরাতে জানা যায়, তাঁর শরীরে কোভিড পজিটিভ। এরকম যাঁরা কোভিড রোগীদের সংস্পর্শে এসেছেন, অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিচ্ছেন করোনা আক্রান্ত ও তাঁদের পরিবারের সঙ্গে।
সত্যরূপ সিদ্ধান্ত জানান, “পরামর্শ নেওয়ার জন্য আমি বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালের ডা. যোগীরাজ রায়ের কাছে গিয়েছিলাম। তিনি লিভার ফাউন্ডেশনের ডা. অভিজিৎ চৌধুরীর সঙ্গে আমার যোগাযোগ করিয়ে দেন। ডা. অভিজিৎও তখন ভাবছিলেন এমন ফোরাম তৈরির কথা। অনেক প্রখ্যাত ডাক্তার এগিয়ে আসেন। আমাদের সেবা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। এভাবেই আমরা সমাজসেবা করতে চাই”।
ওয়েবিনার এবং টেলি-কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যে কোভিড রোগী এবং তাঁদের পরিবারের কাউন্সেলিং করে সিসিএন। বাড়িতেও পৌঁছে দেওয়া হয় নানা পরিষেবা। পাঠানো হয় একটি অক্সিমিটার, কাজ মিটে গেলে আবার তা ফেরত নেওয়া হয়। টেলি-কনফারেন্স এবং ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ডাক্তাররা পরামর্শ দেন রোগীদের। সব কিছু হয় বিনামূল্যে। “হাল্কা উপসর্গের ক্ষেত্রে এরকম ব্যবস্থাই নেওয়া হয়। কিন্তু উপসর্গ বাড়লে ডাক্তাররা হাসপাতালে ভর্তি হতে পরামর্শ দেন। কোভিড হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজনীয় তথ্য আমরা রোগীকে জানিয়ে দিই”, বলেন সত্যরূপ।
সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে সিসিএন
ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করাই এই টিমের কর্মপন্থা। তাঁরা মনে করেন, একা একা কোভিডের মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। এমনই একটি মাত্র স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পক্ষেও নয়। সবাইকে একসঙ্গেই লড়তে হবে মহামারির বিরুদ্ধে। দুর্গম পর্বতারোহনের অভিজ্ঞতা থেকে সত্যরূপ যে প্রাণশক্তি লাভ করেছেন, তার থেকেই পাচ্ছেন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রেরণা।
করোনা রোগীর বাড়িতে সিসিএন টিম
সামাজিক এবং মানসিকভাবে কোভিড রোগী ও তাঁর পরিবারের পাশে দাঁড়ায় সিসিএন। এই কাজে যুক্ত রয়েছেন করোনা থেকে সেরা ওঠা ব্যক্তিরাও। কোভিড রোগীদের মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা ইত্যাদি কাটাতে সাহায্য করেন তাঁরা। গুজব এবং বিভ্রান্তি যাতে না ছড়ায়, তার জন্য ব্যবহার করেন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। দরকারে ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করা হয়। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রোগীর কাছে পৌঁছতে রয়েছে ২৪ ঘণ্টার হেল্পলাইন। হোম আইসোলেশনে থাকা রোগীদের বাড়িতে উপযুক্ত পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থাও করেন তাঁরা। এভাবেই ঐক্যবদ্ধ হয়ে করোনাযুদ্ধে জয়লাভ করার প্রতিজ্ঞা নিয়েছে সিসিএন।