বঙ্গদর্শনের মুখোমুখি অভিনেত্রী শ্রেয়া ভট্টাচার্য

গোখেল মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল আর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী শ্রেয়া ভট্টাচার্য (Sreya Bhattacharyya), বর্তমানে বাংলা ছবি ও ওটিটির অত্যন্ত পরিচিত মুখ ও দক্ষ অভিনেত্রী। শ্রেয়ার প্রথম ছবি কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘জ্যেষ্ঠপুত্র’, যা দুটি জাতীয় পুরস্কার পায়। সেই শুরু। বাংলা সমান্তরাল ছবিতে শ্রেয়ার অভিনয়ে মুগ্ধ হয়েছেন তাবড় ব্যক্তিত্ব থেকে আমজনতা। সামাজিক মাধ্যমেও চর্চিত হচ্ছে শ্রেয়ার একাধিক কাজ। দক্ষিণ কলকাতার এক ক্যাফেতে গরম চা আর কালো কফিতে চুমুক দিতে দিতে শ্রেয়ার সঙ্গে আড্ডার পারদ উঠল তুঙ্গে। শ্রেয়ার সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছেন বঙ্গদর্শন.কম-এর এক্সিকিউটিভ এডিটর সুমন সাধু। ঘটনাক্রমে, দুজনেই দীর্ঘদিনের বন্ধু। সুতরাং আড্ডার সম্বোধনে রইল ‘তুই’।
______
সুমন: ২০১৩ সালে নান্দীকারে যুক্ত হওয়া। প্রায় পাঁচ-ছয় বছর টানা কাজ করেছিস। নান্দীকার তোকে কী শিখিয়েছে?
শ্রেয়া: ডিসিপ্লিন। শিল্পকে সঙ্গ করতে হলে এবং শিল্পকে নিয়ে বাঁচতে হলে সবার আগে নিয়মে থাকাটা জরুরি। তারপর বাকি সবকিছু। তাছাড়া, আজ আমি যতটুকু কাজ করতে পারছি, তার অনেকটা কৃতিত্ব নান্দীকারের। দলের প্রত্যেকে আমায় অনেককিছু দিয়েছেন।
সুমন: ২০১৮-তে প্রথম ছবি। জ্যেষ্ঠপুত্র। প্রথম ছবিতেই তাবড় অভিনেতাদের সঙ্গে কাজ। থিয়েটার আর সিনেমার তফাৎটা কী বুঝলি?
শ্রেয়া: সিনেমায় আরও বড়ো ক্যানভাসে কাজ হয়। সেইটা প্রথম চোখের সামনে দেখা। সুদীপ্তাদি (চক্রবর্তী), বেনিদি (বসু) - ছোটোবেলা থেকে যাঁদের কাজ দেখেছি, ওঁদের সঙ্গে সময় কাটানো। ঋত্বিকদা (চক্রবর্তী), যার অভিনয়কে আমি খুবই শ্রদ্ধা করি, তাঁর বিপরীতে অভিনয় করা। আর প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের মতো একজন পরিপূর্ণ শিল্পীকে নতুন করে আবিষ্কার করা। প্রথম ছবি আক্ষরিক অর্থেই মনে রাখার মতো। যে অভিজ্ঞতা আজীবন আমার সঙ্গে থাকবে। একটা ঘটনা বলি তোকে, জ্যেষ্ঠপুত্রের শ্যুটিংয়ে আমার ভ্যান আর ঋত্বিকদার ভ্যান ছিল পাশাপাশি। টিমের এক দিদি ঋত্বিকদাকে ডেকে বলল, “ঋত্বিকদা, এই হচ্ছে শ্রেয়া, রাইয়ের পার্টটা করছে।” ঋত্বিকদা সঙ্গে সঙ্গে আমায় বলল, “আরে কী খবর!” এর আগে কিন্তু আমাদের আলাপই ছিল না। এই যে প্রথমদিনেই আমার মতো একজন আনকোরাকে এতটা আপন করে নেওয়া, যেন আমার পুরো প্রেশারটা এক নিমেষে সরে গেল। সকলেই দেখলাম খুব ভালো। প্রত্যেকেই আমার কাছে ইন্সপায়ারিং সহ-অভিনেতা।
আমি মানুষের কাছে আমার কাজের মধ্যে দিয়ে পৌঁছাতে চাই। রিল বানানোটা আমার কাজ নয়। যদি অভিনয়টা কাজ না করে, তাহলে রিলের বাইরে বেরিয়ে হয়ত অন্য কিছু করব, হয়ত লিখব। রিলের চেয়েও সেইটা বোধহয় আমার কাছে অনেক বেশি কমফোর্টেবল – শ্রেয়া
নয় মাস নয় দিন এবং অন্তহীন ছবিতে শ্রেয়া
সুমন: রিল বানাতে না-পারা বা না-চাওয়া অভিনেতা অভিনেত্রীদের কি সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘন ঘন ছবি পোস্ট করে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে হয়, কী মনে হয় তোর?
শ্রেয়া: রিল বানানোটা অনেকের ক্ষেত্রে কাজ করে, অনেকের ক্ষেত্রে করেও না। আমি যেমন সত্যিই রিল বানাতে চাই না। হয়তো রিল-মেকাররা অর্থ বা খ্যাতি দুইয়ের পিছনেই ছুটছেন। তাতে কোনো অন্যায়ও নেই। কিন্তু আমি মানুষের কাছে আমার কাজের মধ্যে দিয়ে পৌঁছাতে চাই। রিল বানানোটা আমার কাজ নয়। যদি অভিনয়টা কাজ না করে, তাহলে রিলের বাইরে বেরিয়ে হয়ত অন্য কিছু করব, হয়ত লিখব। রিলের চেয়েও সেইটা বোধহয় আমার কাছে অনেক বেশি কমফোর্টেবল। শুধুমাত্র রিল বানিয়ে আমি আমার মতো কাজটা করতে পারব না, যেটা অভিনয় করে পারছি।
সুমন: তোর সঙ্গে যখনই দেখা হয়েছে, তুই বারবার বলিস যে আরও কাজ করতে হবে। প্রচুর কাজ করব। এই খিদেটা, এই তাগিদটা কোথা থেকে পেলি?
শ্রেয়া: সম্প্রতি আমি আমেরিকান টেলিভিশন সিরিজ ‘শার্প অবজেক্ট’ দেখলাম। সেখানে অ্যানি অ্যাডাম যেন পুরো খেলছেন অভিনয়টা নিয়ে। এই অসামান্য কাজগুলো যখন দেখি, বারবার মনে হয়, ইশ এই পার্টটা আমিও তো করতে পারতাম। আমাকে নিল না কেন? আমাকে কেনই বা নেবে! ওটা তো হলিউডের ছবি। শুধু বিদেশ কেন, আমার দেশেই তো এমন কত ভালো ভালো কাজ হয়েছে বা হচ্ছে, যেখানে কিছু চরিত্র আজীবন বিশেষ হয়েই থেকে যায়। বলতে পারিস, খিদেটা এইসব অভিনয় দেখেই তৈরি হয়ে যায়। মনে হয়, আরও কাজ করতে হবে, প্রচুর কাজ করে যেতে হবে।
বেলাইন ছবিতে শ্রেয়া ও তথাগত
শমীক রায়চৌধুরীর বেলাইন-এ যে চরিত্রটা আমাকে দেওয়া হয়, ওটাও সেইরকম স্বপ্নের মতো একটা চরিত্র। এইরকম চরিত্র পেলে কী যে আনন্দ হয় সুমন! তারপর সদ্য একটা ফিচার শেষ করলাম। গুসকরায় শ্যুটিং হল। বিস্তারিত এখনই বলছি না। সেখানেও একটা অসামান্য চরিত্রে অভিনয় করলাম। আরও যত এরকম কঠিন চরিত্র পেতে থাকব, কাজ করার তাগিদ এমনিই বাড়তে থাকবে।
সুমন: প্রতিযোগিতার বাজারে যেখানে তোর মতো অসংখ্য অভিনেতা অভিনেত্রী রয়েছেন, সেখানে নিজের জায়গাটা পোক্ত করা, নিজেকে বারবার প্রমাণ করার মাধ্যমগুলো তোর কাছে কী?
শ্রেয়া: আমাদের চারপাশে এত ভালো ভালো গল্প আছে এবং এত ভালো ভালো চরিত্ররা আমাদেরই চারপাশে ঘুরে বেড়ায়, সেসব দেখে মনে হয় দারুণ কিছু পেলে আমিও ভালো কাজ করতে পারব। এক শহর থেকে আরেক শহর, এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্য, এক দেশ থেকে আরেক দেশ - নিজের কাজ নিয়ে সর্বত্র পৌঁছে যাওয়া সম্ভব। আর এই জন্য চাই ধৈর্য আর নিজেকে তৈরি করার প্রস্তুতি।
সুমন: একদমই তাই। অভিনেত্রী সুদীপ্তা চক্রবর্তী একবার আমায় সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, কাউকে নকল কোরো না, নিজেই নিজের বেটার ভার্সেন হওয়ার চেষ্টা করো। একটা চরিত্র হাতে পেয়ে তুই কীভাবে সেটা স্টাডি করিস? চরিত্র হয়ে ওঠার জার্নিটা কেমন তোর?
শ্রেয়া: ধৈর্য আর প্রস্তুতির কথা তো বললামই। তাছাড়া পরিপূর্ণ ভাবে একটা চরিত্র হয়ে উঠতে গেলে পড়াশোনা, পৃথিবী জুড়ে নানান কাজ দেখা এবং শান্ত মনে মনোনিবেশ করা খুব জরুরি। চারপাশ এখন খুব ফাস্ট হয়ে গেছে, মানুষের স্থিরতা কমেছে। আমাদের শিল্পমাধ্যমও দিন দিন বদলে যাচ্ছে। দেখার চোখ পাল্টাচ্ছে। এই এতকিছু মাথায় রেখেই আমাদের সবাইকে কাজ করে যেতে হবে। ধর, পুরুলিয়ার এমন একটা প্রত্যন্ত গ্রামে শ্যুট হচ্ছে যেখানে নেটওয়ার্ক প্রায় নেই বললেই চলে। একদিক থেকে ভালো লাগে যখন মনে হয়, যাক, অন্তত দুটো দিন এই নির্জনে একটু শান্তি পাব, ফোন আসবে না। পরক্ষণেই আবার মনে হয়, ফোন না এলে তো কাজও আসবে না। এই যে একজন শিল্পীর ক্রমাগত দ্বন্দ্ব, এটা নিয়েই আমাদের বেঁচে থাকা। আর এই সবকিছুই কিন্তু অভিজ্ঞতা।
আমি বিষয়টাকে পরিচিতি-অপরিচিতি দিয়ে ভাবতে চাই না। তাহলে নিজেই খুব সংকটে পড়ে যাব। সিনেমা বা ওটিটি থেকেও কিন্তু প্রচুর মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। খোলামকুচি বা উলটপুরাণ-এর মতো ওয়েবসিরিজ দেখেও মানুষ আমার কাজ ভালোবেসেছেন – শ্রেয়া
খোলামকুচি ওয়েব সিরিজে শ্রেয়া ও অনিন্দ্য
সুমন: তুই এই মুহূর্তে এমন একজন অভিনেত্রী যে একইসঙ্গে থিয়েটার, সিনেমা, সিরিয়াল, ওটিটি এতগুলো মাধ্যমে কাজ করেছিস। কিন্তু কী মনে হয়, একমাত্র সিরিয়ালই তোকে পরিচিতি দিল?
শ্রেয়া: আমি একটাই সিরিয়াল করেছি। মেয়েবেলা (স্টার জলসা)। এবং এটা ঠিক যে, ওই একটা সিরিয়ালই আমাকে যথেষ্ট পরিচিতি দিয়েছে। আসলে সিরিয়াল মাধ্যমটাই তো খুব জনপ্রিয়। শহর, গ্রাম সমস্ত জায়গার মানুষ সিরিয়াল দেখেন। তাই সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানো যায় সহজেই। তবে আমি বিষয়টাকে পরিচিতি-অপরিচিতি দিয়ে ভাবতে চাই না। তাহলে নিজেই খুব সংকটে পড়ে যাব। সিনেমা বা ওটিটি থেকেও কিন্তু প্রচুর মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। খোলামকুচি বা উলটপুরাণ-এর মতো ওয়েবসিরিজ দেখেও মানুষ আমার কাজ ভালোবেসেছেন।
আমি আবার থিয়েটার করছি নিজের মতো করে। তাছাড়া সিনেমা, ওটিটি তো চলছেই। সিরিয়ালের কাজ এই মুহূর্তে কিছু করছি না, ভালো চরিত্রের জন্য অপেক্ষায় আছি।
জ্যেষ্ঠপুত্র ছবিতে ঋত্বিক ও শ্রেয়া
সুমন: নতুন কী কী কাজ আসছে?
শ্রেয়া: গম্ভীরা লোকশিল্পের ওপর একটা ছবি ‘নানা হে’-তে কাজ করলাম। অমিতাভ চট্টোপাধ্যায়ের ছবি ‘আদিম’ এই মুহূর্তে ফেস্টিভ্যালে ঘুরছে। মৈনাক পালের ‘অজান্তে’ ছবিতে অভিনয় করলাম। এছাড়া, শ্যুটিং শুরু হবে চন্দ্রাশিস রায়ের ‘বিজয়নগরের হীরে’, এটা কাকাবাবু সিরিজের নতুন ছবি।
সুমন: ২০২৪-এ যা যা কাজ করেছিস, অনেক উল্লেখযোগ্য পুরস্কারে সেরা অভিনেত্রী হিসেবে তুই মনোনীত হয়েছিস। তোর ছবি বাংলার বাইরে সারা দেশে, এমনকি বাইরের অনেক দেশেও ঘুরেছে। এখন মনে হয় স্বপ্নকে ছোঁয়া যাচ্ছে?
শ্রেয়া: স্বপ্নকে তো মাপা যায় না। স্বপ্ন এমন একটা জিনিস, যার ক্যানভাস দিন দিন বাড়তেই থাকে। সবে কাজ করা শুরু করেছি। এখনও অনেক কাজ করতে হবে। আপাতত এটাই বিশ্বাস করি।