একালের বিগ বাজেটের বাংলা সিনেমায় ‘মগজ’-এর ব্যবহার কতটা?

কয়েক বছর আগে বাংলা সিনেমার বাজারে ‘চাঁদের পাহাড়’ ছবিটির আশাতীত সাফল্য সেই সময়ের বিনোদন দুনিয়ায় ছিল নিঃসন্দেহে এক আলোড়ন-তোলা ইভেন্ট । বাংলা গদ্যসাহিত্যের তিন দিকপাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্যতম, নির্জনতাপ্রিয় ভাবুক মানুষটি যখন প্রায় নিজস্ব কল্পনার ডানায় ভর করে ও কিছুটা বিদেশি ভ্রমণকাহিনি নির্ভর করে এই কিশোর উপন্যাস রচনা করেছিলেন, তখন হয়তো তিনি ভাবতেই পারেননি আগামী শতাব্দীতে তাঁর এই আখ্যান কীভাবে কল্পনাকে অতিক্রম করে প্রযুক্তিনির্ভর এক প্রবল বিনোদন-ফ্যান্টাসিতে রূপান্তরিত হয়ে যাবে, অনেকটা কাফকার নায়কের মতোই। তবে একথা দুনিয়া মেনেই নিয়েছে, সাহিত্যের আর চলচ্চিত্রের বর্ণপরিচয় সত্যিই আলাদা, আর, সাহিত্যভিত্তিক সিনেমায় পরিচালক তাকে নিজের মত করে গড়েপিটেই নেন। তবে ‘চাঁদের পাহাড়’-কে কেন্দ্র করে আমাদের চারপাশে যে সব আলোচনা বা উন্মাদনার বিস্তার ঘটেছিল সেখানে এই বদলের ভিত্তিটাই হল ‘বিগ বাজেট’ – পনেরো কোটিতে তৈরি বাংলা ছবি, যা নাকি বিরাট কোহলির মতোই সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে, সেই কারণেই বহু মানুষ সপরিবারে এই ছবি দেখতে গিয়েছিলেন। আর এই সাফল্যের সঙ্গে তাল রেখে তার পরেও বেশ কয়েকটি বাংলা ছবি নির্মিত হয়েছে – ‘ইয়েতি অভিযান’, ‘মিশর রহস্য’, ‘আমাজন অভিযান’ ইত্যাদি – যার সবটাই বিগ বাজেট।
আরও পড়ুন
আধুনিক বাংলা গান এত সমাজবিমুখ কেন?
আসলে একটা কথা বোধ হয় মেনে নেওয়া ভালো, অধুনা আমাদের মানসিকতায় ‘বিগ’ এর প্রতি এক অমোঘ মোহ-আবরণ ঘনিয়ে উঠেছে । পাড়ার ছোটো মুদির দোকান ছেড়ে যেমন আমরা বিগ রিটেলে কেনাকাটা করতে পছন্দ করি, ছাপোষা মাঝারি দোকানপাটের থেকে বড়ো বড়ো শপিং মলের অন্দরে আমাদের তৃপ্ত ঘোরাফেরা। এলাকার ছোটোখাটো সিনেমাহলগুলি ইতিমধ্যে বাদুড়, পায়রা কিংবা ভবঘুরেদের স্থায়ী আস্তানায় পরিণত, কোথাও কোথাও প্রোমোটারের চরণস্পর্শে সেগুলি ঝলমলে আবাসন বা এস্কেলেটারওয়ালা শপিং মল হওয়ার সংশয়ে শরতশেষের শিউলির মতোই কম্পমান। পরিবর্তে মাল্টিপ্লেক্সের মসৃণ শীতলতায় বড়ো মাপের ট্যাঁকের খড়ি খসিয়ে, আরামপ্রদ আসনে বসে ঠান্ডা পানীয়ে চুমুক দিতে দিতে চলচ্চিত্র আস্বাদনের এক ভিন্ন ব্যাকরণে আমরা ইদানীং মজে আছি। ওই বিলাসী আবহে পর্দাজুড়ে হতশ্রী গ্রাম বা দারিদ্রের আখ্যান অথবা নাগরিক জীবনের প্রান্তীয় মানুষদের জীবনযন্ত্রণার প্যানপেনে ছবি স্রেফ আমাদের পোষায় না। পোষায় না, অমন বি-শা-ল পর্দা জুড়ে ছোটোখাটো মামুলি জীবনযাপনের বেরঙ্গিন পা-তোলা পা-ফেলার লো-বাজেট তথা লো-প্রোফাইল, অলক্ষুণে ছিঁচকাঁদুনে ছেনালি, অথবা কোনও শানিত চেতনা-ফেতনার মেজাজ-খারাপ-করে-দেওয়া ভালগার অন্তর্ঘাত। তাই চৌষট্টি বছর আগের চলচ্চিত্রায়িত বিভূতিভূষণে কয়লার ইঞ্জিনে টানা রেলগাড়ি দেখার মৌলিক বিস্ময় আপাতত আফ্রিকার গহন জঙ্গলে নায়কের সঙ্গে পশুরাজের সম্মুখ সমরের লোমহর্ষক উত্তেজনায় পরিবর্তিত!
কিন্তু এই চারদিকের ‘বিগ’ ম্যানিয়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে ভয়ে ভয়ে দু-একটা প্রশ্নের বিনীত উপস্থাপন। বাংলা ছবিতে এত বড় বিনিয়োগ নিশ্চয়ই সিনেমা জগতের সকলের পক্ষেই এক আনন্দযজ্ঞের ইঙ্গিত, সুবাতাসের স্পষ্ট সমাচার। এতকাল হিন্দিভাষী ছবির আন্তর্জাতিক বাজারের কথা মাথায় রেখে প্রযোজকরা সেখানে দেদার টাকা ঢালতেন, এখন যদি সুনিশ্চিত ফেরত-লাভের ভরসায় এই বঙ্গের টলিউডেও তাঁরা কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা লাগান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির অর্থনীতির দিক থেকে ভাবলে সে নিশ্চয়ই খুব সুখের সময়। কিন্তু চলচ্চিত্র কথাটার ব্যঞ্জনার মধ্যে শুধুই নয়নাভিরাম দৃশ্য, চোখ ধাঁধানো প্রযুক্তির ব্যবহার বা লোমহর্ষক উত্তেজনার হাতছানি এইটুকুই তো শেষ সত্যি নয়, মগজ বলে একটা কিছু সিনেমায় থাকা বাঞ্ছনীয়, এটা প্রায় সারা পৃথিবীই স্বীকার করে নিয়েছে। পাশাপাশি, মনে করাও প্রয়োজন, বাংলা সিনেমাকে সেই যাত্রাপালার মগজহীনতা থেকে উদ্ধার করে যারা নতুন পথের শরিক করেছিলেন তাঁরা ঠিক বাজেটের নিক্তিতে নিজেদের ভাবনাকে গ্রথিত করতে চাননি। বরং ছবির বিষয়বস্তু ও তার অভিঘাতের দিকে তাকিয়েই বাজেটের ভাবনা আসত। আজকে একথা শুনলে হয়তো অনেকে অবাকই হবেন, যে ছবিটি পরিচালক মৃণাল সেন কে সর্বভারতীয় পরিচিতি দিয়েছিল সেই ‘ভুবন সোম’ ছবিটি মাত্র দুলক্ষ টাকা সরকারি অনুদানে তৈরি হয়েছিল। সত্যজিৎ রায় বা ঋত্বিক ঘটক সেই অর্থে খুব বড় বাজেটের ছবি করেননি। সেটা কোনও ঘোষিত নীতি নয় , ছবিটাকে তাঁরা কীসের বিচারে দেখছেন বিবেচনাটা আসলে সেখান থেকেই উঠে আসে। আর, এই ভাবনার গড়নেগঠনে একটা জোরের জায়গা যে ছিল সেটা আজ বারবার অনুভূত হয় । কেননা, বাংলা কেন, ভারতীয় সিনেমায় মননশীল পরিচালক হিসেবে যারা নাম কুড়িয়েছেন তাঁরা সবাই একবাক্যে স্বীকার করেন সত্যজিৎ, ঋত্বিক, মৃণাল সেনের ছবিগুলি তাঁদের শিক্ষার সহজপাঠ ও ব্যাকরণ কৌমুদী।
আরও পড়ুন
হিন্দি কি কেউ সাধে বলে নাকি?
কিন্তু একটা শিল্পের ( ইন্ডাস্ট্রি অর্থেই ) বিনিয়োগ মানে যদি শুধুই কিছু বিগ বাজেটের ছবির উৎপাদন হয়, তাহলে কোথাও যেন একটা স্থূলে ভুল হয়ে যায়। সিনেমা মাধ্যমটাকে যারা সৎ ও মননশীল ভাবে নির্মাণ করেছেন, যারা পথ দেখিয়েছেন প্রাগাধুনিক থেকে আধুনিকতার বৃত্তে, যারা সিনেমার মধ্যে দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন একটা সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারকে, এই বিপুল বিনিয়োগের বসন্তে তাঁদের প্রতি কিছু দায়পালনের ব্যাপার থেকে যায়। ঠিক কোন পথে তাঁরা এগোলেন, কীভাবে এগোলেন, শেষ পর্যন্ত তাঁদের ছবিগুলি ঠিক কেমন, এইসব অভিজ্ঞানগুলিকে উত্তরকালের কাছে সাজিয়ে ধরা এক রকমের ঐতিহাসিক দায়। আক্ষেপের কথা, ঠিক এই ধরনের কর্তব্যবোধের সামনে বিগ ইনভেস্টমেন্টকে আমরা প্রণত হতে দেখছি না। সত্যজিৎ রায় তবু একটা জায়গায় ভাগ্যবান যে মৃত্যুশয্যায় শায়িত হয়েও তিনি অস্কারের গায়ে হাত ছোঁয়াতে পেরেছিলেন, ফলে তাঁকে নিয়ে একটা তাক-লাগানো হুজুগ আমরা তার প্রয়াণের পর প্রত্যক্ষ করেছি। এর প্রতিক্রিয়ায় রাস্তার ফুটপাথে তাঁর ছবিওয়ালা পোস্টার যেমন শিবঠাকুর, লোকনাথবাবা কিংবা কালীপ্রতিমার পাশে পাশে বিক্রি হতে দেখেছি আমরা, তেমনই এর একটা ভালো দিক হল, সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে তাঁর ছবিগুলির যথাযথ সংরক্ষণ ও কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুনরুদ্ধার করা গেছে। মৃণাল সেনের ছবিগুলির ক্ষেত্রে এমন কোনও উদ্যোগের কথা আজও আমরা শুনিনি। তাঁর বেশিরভাগ ছবি নতুন প্রজন্মের দেখবার সুযোগ নেই। বাজারে তাঁর যে সব ছবি পাওয়া যায় তার অধিকাংশেরই প্রিন্ট বা সাউন্ড ট্র্যাকের অবস্থা শোচনীয়। ‘জেনেসিস’ বা ‘খন্ডহর’ এর মতো ছবি পাওয়াই যায় না। মৃণাল সেনের করা তথ্যচিত্র দেখবার কোনও সুযোগই নেই। ঋত্বিক ঘটকের ছবিগুলির অবস্থা আরও খারাপ । জীবদ্দশাতেই বাউন্ডুলে জীবনযাপনের ফলে তার বেশির ভাগ ছবিই ঠিকমতো বিপণন হয়নি, এখন উপযুক্ত সংরক্ষণের অভাবে সেগুলি লুপ্তপ্রায়। যেটুকু রয়েছে তারও গুণমান অত্যন্ত নিচু । কেউ কেউ হয়তো জানেনই না ঋত্বিক ঘটক কাহিনিচিত্রের পাশাপাশি রামকিঙ্কর বেজের জীবন নিয়ে বা পুরুলিয়ার ছৌ নাচ নিয়ে তথ্যচিত্র করেছিলেন। এমনকি যে উত্তমকুমারকে মহানায়কের আসনে বসিয়ে আপামর বাঙালি ও বাংলার ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির এত আহ্লাদ সেই অসামান্য অভিনেতাটির অজস্র ছবির মধ্যে মাত্র হাতেগোনা কয়েকটি সঠিকভাবে সংরক্ষিত, আর সব ছবির প্রিন্ট হয় কীটদষ্ট না হয় ছ্যাতলাপড়া বিবর্ণ যা প্রদর্শনের অযোগ্য।
পৃথিবীর সব দেশেই চলচ্চিত্রের মতো মাধ্যমকে কম বেশি সরকারি সাহায্য বা অনুগ্রহ নিতেই হয়। এই দেশের কেন্দ্র-রাজ্য উভয় সরকারই স্বাধীনতার পর থেকে চলচ্চিত্রের পৃষ্ঠপোষণা করে এসেছেন। তার মধ্যে যে তেমন একটা রক্তচক্ষু নিয়ন্ত্রণের ঝোঁক ছিল এমন বদনাম করা যাবে না। এখনও দুই সরকারের প্রযোজনায় দুটি বড়ো মাপের আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব হয়। আপাতত বেসরকারি পুঁজির জয়যাত্রার এই মহোৎসবে সরকারি বিনিয়োগ চলচ্চিত্রের পেছনেও বেশ স্তিমিত। আসলে আরও পাঁচটা ক্ষেত্রের মতো এখানেও সরকার বিনিয়োগের মূল ক্ষেত্রটা বেসরকারি হাতেই ছেড়ে রাখতে চান। তা রাখুন, সরকারের অগ্রাধিকারের আরও অন্য ক্ষেত্র থাকতেই পারে। কিন্তু চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন বা নানা পুরস্কার প্রদানের পাশাপাশি সরকারি উদ্যোগ যদি এই জরুরি সংরক্ষণের দিকটাতেও খানিক প্রসারিত হত তবে তাও হত একটা বড়ো কাজ। এমনকি কোনও ছুৎমার্গ না রেখেও বলা যায়, এই কাজটায় যদি কোনও বড় কর্পোরেট হাউসও এগিয়ে আসতেন সেটাও মন্দ কিছু হত না। বরং বিগ বাজেট জমকালো ছবি প্রযোজনার থেকে সে হত আরও এককদম জরুরি কাজ। তবে স্বভাবতই এই প্রয়াসে চটজলদি লাভের আশা তেমন নেই। হয়তো সেই কারণেই এখনও আমাদের প্রত্যাশার চিঁড়ে ভিজছে না।