No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    চাষির ঋণমকুব কি অন্য ধরণের বৈষম্য তৈরি করছে না?

    চাষির ঋণমকুব কি অন্য ধরণের বৈষম্য তৈরি করছে না?

    Story image

    চাষিরা হঠাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছেন। চারিদিকে আন্দোলন, বা আন্দোলনের হুমকি। চাষিরা চান তাঁদের ধারদেনা যা আছে মকুব করে দেওয়া হোক। না–করে উপায়ও নেই। একে তো তাঁরা বিরাট সংখ্যক ভোটার। তার উপর আবার জাতির বিবেক নড়িয়ে দিতে চাষিদের আত্মহত্যার ঘটনা তো রয়েছেই। কাজেই তাঁরা আন্দোলন করলে বা করার হুমকি দিলে সরকারের মনে ভয় ধরবেই। নরেন্দ্র মোদি উত্তরপ্রদেশের ভোটের প্রচারে চাষিদের ঋণমকুবের কথা ঘোষণা করে দেন। জেতার পর প্রতিশ্রুতি তো রাখতেই হবে। তার ধাক্কা এবার পড়ছে নানা রাজ্যে। সর্বশেষ ঘটনা মহারাষ্ট্রের।

    কিন্তু এই ঋণমকুবের ঘটনা কি সমাজের মাঝামাঝি থাকা কিছু মানুষকে বাড়তি সুবিধা দিয়ে নতুন বৈষম্যের জন্ম দিচ্ছে না?

    চাষিদের সমস্যা বললে আমাদের সবারই চিত্তচাঞ্চল্য দেখা দেয়। যাঁরা আমাদের জন্য খাদ্য উৎপাদন করবেন, তাঁরা দুঃখে থাকবেন, তা তো হতে পারে না। এখানেই কতগুলো প্রশ্ন আছে। সেই প্রশ্নগুলোর ভিত্তি কিছু পরিসংখ্যান। সবাই ঋণমকুবের প্রসঙ্গে চাষিদের আত্মহত্যার প্রসঙ্গ টানেন। দেখা যাচ্ছে, একটা পরিসংখ্যান বলছে চাষিদের আত্মহত্যা কমছে, আর বাড়ছে কিশোর–কিশোরীদের আত্মহত্যা। সেই পরিসংখ্যান থাক। ২০১২ সালে, যখন চাষিদের আত্মহত্যা নিয়ে ব্যাপক হইচই হচ্ছিল, তখন ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরোর রেকর্ড বলেছিল, সে বছর দেশে মোট ১,৩৫,৪৪৫ জন আত্মহত্যা করেন। তার মধ্যে কৃষক ছিলেন ১৩,৭৫৫। শতাংশের হিসাবে ১১.‌২ শতাংশ। কিন্তু আমরা জানি এখনও দেশের অর্ধেকের বেশি মানু্ষ কৃষির উপর নির্ভরশীল। তাহলে আত্মহত্যার হার তো চাষিদের মধ্যে অনেক কম!কিন্তু সত্যিই কি তাই?

    না। কারণ আমাদের জানার মধ্যে কিছু গলদ আছে। চাষিবলতে যাঁরা নিজেদের জমি চাষ করেন তাঁদেরই ধরা হয়। এঁরাই ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নেন। ২০১১ সালের সেন্সাস বলছে, তাঁদের সংখ্যা ১১ কোটি ৮৯ লক্ষ। অর্থাৎ, দেশের জনসংখ্যার ৮ শতাংশ, এবং যাঁরা কাজ করেন (‌৪৮ কোটি মানু্য)‌ তাঁদের ২৪.‌৬ শতাংশ। কৃষকদের আত্মহত্যা ও সমস্যা নিয়ে যিনি অনেক কাজ করেছেন, সেই সাংবাদিক পি সাইনাথ মনে করেন, এর মধ্যে সাড়ে ৯ কোটি চাষি পুরোপুরি চাষের আয়ের উপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ এঁরা জনসংখ্যারও মোটামুটি সাড়ে ৭ শতাংশ। ধরেই নেওয়া যায় ঋণের দায়ে যাঁরা আত্মহত্যা করবেন তাঁরা এঁরাই। আত্মহত্যার সমীক্ষা বলছে মোট আত্মহত্যার মধ্যে ১১.‌২ শতাংশ চাষি। তাঁরা চাষি বলতে কাদের ধরেছেন, তা স্পষ্ট নয়। সব মিলিয়ে যা দাঁড়াচ্ছে তা হল, চাষিদের আত্মহত্যা হয় বাকিদের মতোই, না হলে বাকিদের থেকে সামান্য বেশি। কিন্তু আর একটি তথ্য বলছে, চাষিদের আত্মহত্যার প্রায় ৭৫ শতাংশ ছিল ৫টি রাজ্যে সীমাবদ্ধ:‌ মহারাষ্ট্র, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্নাটক, মঝ্যপ্রদেশ ও কেরালা। তাহলে কী দাঁড়াল? চাষিদের আত্মহত্যার হার এই রাজ্যগুলিতে অন্য পেশার মানুষের থেকে অনেক বেশি। এবং অন্যান্য রাজ্যে অন্যদের থেকে অনেক কম।

    তাহলে কি চাষের সমস্যার প্রতিফলক হিসাবে চাষিদের আত্মহত্যার ঘটনা ধরা যায়? যদি ধরি, তা হলে পাঞ্জাব বা উত্তরপ্রদেশে কেন চাষির ঋণ মকুব করা হল? সেখানে চাষিদের আত্মহত্যার হার তো অন্যদের থেকে কম। এ কথা সত্যি, চাষের সমস্যা দেশের সর্বত্রই আছে। কিন্তু ব্যাপক আত্মহত্যার ঘটনা ৫টি রাজ্যে সীমাবদ্ধ। অর্থাৎ, পাঞ্জাব বা উত্তরপ্রদেশের চাষের সমস্যা প্রসঙ্গে আত্মহত্যার প্রসঙ্গ টেনে আনা কার্যত ধান ভানতে শিবের গীতের মতো। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, এই ৫ রাজ্যের চাষিদের সঙ্গে বাকিদের তফাতটা কোথায়? প্রশ্নটার কোনও সহজ উত্তর নেই। উত্তর খোঁজা দরকার। ওই প্রসঙ্গে আর একটা পরিসংখ্যান উল্লেখ করা যায়। অর্থনৈতিক উদারীকরণের পর থেকে শহুরে মানুষের আয় বেড়েছে গ্রামীন মানুষের থেকে বেশি। ২০৯৩–৯৪ সালে শহরের মানুষের তুলনায় গ্রামীন মানু্যের মাসিক মাথাপিছু ব্যয় ছিল ৬০ শতাংশের মতো। ২০১১–১২ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৫৪ শতাংশে। এই বৈষম্য কি চাষিদের মনের উপর বাড়তি চাপ ফেলছে? তাই কি বাড়তি স্বাচ্ছল্যের জন্য তাঁরা ঋণমকুবের দাবি তুলছেন?

    মহারাষ্ট্রে, বিশেষ করে বিদর্ভ অঞ্চলে, আত্মহত্যার ঘটনা বেশ বেশি। সে রাজ্যে ৩৪ হাজার কোটি টাকার কৃষিঋণ মকুব হল। দেখা যাচ্ছে, এর ফলে উপকৃত হচ্ছেন ৮৯ লাখ কৃষক। দেশের মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশের মতো যেহেতু কাজের বাজারে আছেন, তাই গড়ে ধরতে পারি, জনপ্রতি কর্মী মানুষের ওপর নির্ভর করে থাকেন আড়াই জন মানুষ। তাহলে এই ঋণমকুবের ফলে লাভবান হবেন ২ কোটি ২৫ লক্ষ মানুষ। মহারাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যা ১১ কোটি ৪২ লক্ষ। অর্থাৎ মোটামুটি ২০ শতাংশ মানুষ লাভবান হলেন। এঁরা কিন্তু সমাজের মাঝামাঝি অংশে থাকেন। প্রান্তিক মানু্ষ, কৃষিমজুর, খুব ছোট চাষি, শহুরে মজুর এবং শহুরে নিম্নবিত্ত মানু্ষ এই ধরণের কোনও সুবিধা পেলেন না। চাষির ফসল বাজারজাত করার প্রক্রিয়ায় যুক্ত গরিব মানুষেরাও পেলেন না। আর ঋণমকুবের ক্ষতির দায় কিন্তু করদাতাদেরই বহন করতে হয়।

    এর ফলে এক ধরণের বৈষম্য তৈরি হচ্ছে, সংশয় নেই। তাই সরকারকে এবার ভাবতে হবে ঋণমকুবের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কী কী করা দরকার।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @