সরকারি বাস পরিষেবার ৭৫ বছর

কলকাতা রাষ্ট্রীয় পরিবহণ নিগম বা ক্যালকাটা স্টেট ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশন (Calcutta State Transport Corporation) যাকে অনেকেই সিএসটিসি (CSTC) নামে চেনেন, সেই নিগমই ৭৫ পূর্ণ করলো। কলকাতা শহরের ইতিহাসে ১৯২০ সালে প্রথম সরকারি বাস পরিষেবা চালু হয়েছিল। তবে, ১৯৪৮ সালের ৩১ জুলাই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অধীনস্থ স্টেট ট্রান্সপোর্ট সার্ভিস (State Transport Service) গঠিত হয়েছিল। এই সংস্থাই পরে সিএসটিসি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ১৯৬০ সালের ১৫ জুন। তারপর ধীরে ধীরে সিএসটিসি শহরের গণ্ডি পেরিয়ে চালু করে দূরপাল্লার বাস পরিষেবা। ১৯৬৮ সালের ১৪ এপ্রিল কলকাতা-দীঘা রুট চালু হয়। ২০১৪ সালে সিএসটিসি’র সার্বিক পরিচালন পদ্ধতিতে বদল আনা হয়। বর্তমানে কলকাতা মেট্রোপলিটন এলাকার প্রধান সরকারি পরিবহণ মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে এই সংস্থা। ২৬ মে, ২০১৪ সালে সিএসটিসি-ই প্রথম AC Bus চালু করে। আধুনিক গণপরিবহণ ব্যবস্থায় যাবতীয় উপকরণ এখন সিএসটিসি’র বাসগুলিতে মিলছে, যার মধ্যে রয়েছে, অটোমেটিক টিকিট ভেন্ডিং মেশিন (Automatic Ticket Vending Machine), ভেহিকল ট্র্যাকিং সিস্টেম (Vehicle Tracking System) ইত্যাদি। উল্লেখ্য, এখন কিন্তু সিএসটিসি বলে কিছু নেই। CSTC, CTC আর WBSTC মিলিয়ে এখন একটাই নিগম গড়ে তোলা হয়েছে যার নাম WBTC।
১৯৪৮ সালের স্টেট বাস, পুরানো কলকাতার চালচিত্র ফেসবুক পেজ থেকে সংগৃহিত
২০১৪ সালে রাজ্য সরকার সিএসটিসি-কে কলকাতার প্রধান বাস পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থা হিসেবে ঘোষণা করে। পরে দূরপাল্লার পরিষেবা বন্ধ করে শুধু কলকাতা-কেন্দ্রিক পরিষেবায় মন দেয় সংস্থা। ওই বছরই নিগম প্রথম বাতানুকূল বাস এবং ভলভো বাসের পরিষেবা শুরু করে। আয়ের ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দেয় এই পরিষেবা।
৮০,৯০ সালের সরকারি বাস
৭৫ বছর পূর্তির পর
২০১৯ সালে CSTC বাংলায় গণপরিবহণে একপ্রকার বিপ্লব আনে। বিশ্ব উষ্ণায়নের কুপ্রভাবের কথা মাথায় রেখে পরিবেশ-বান্ধব জ্বালানির বাস নিয়ে আসে তারা। চালু হয় ইলেকট্রিক এসি বাস বা AC E-Bus। যদিও এই পরিবর্তনের মধ্যমণি ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee)। তিনিই কলকাতা এবং শহরতলির পাশাপাশি রাজ্যের অনান্য এলাকাতে পরিবেশ-বান্ধব ইলেকট্রিক এসি বাস চালানোর পথ বেছে নিয়েছিলেন। এখন সারা দেশের মধ্যে কলকাতাতেই সব থেকে বেশি AC E-Bus চলে। এবার আগামী দিনে কলকাতা ও শহরতলির বুকে সর্বোচ্চ সংখ্যার AC E-Bus চালিয়ে পরিবেশ সচেতনতায় নজির তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে WBTC। ধাপে ধাপে কলকাতা ও শহরলির রুটে ১২০০ AC E-Bus নামাতে চলেছে তাঁরা। ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে কলকাতা ও শহরতলির বুকে আরও বেশি সংখ্যক AC E-Bus চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে সেই বাস চালাবে WBTC।
তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের হাত ধরে কলকাতা এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার জন্য চালু হওয়া সেই পরিষেবার ৭৫ বছর উপলক্ষ্যে সোমবার সরকারি বাস পরিষেবা শুরুর সেই মুহূর্তই উদযাপন করেন কলকাতা রাষ্ট্রীয় পরিবহণ নিগমের কর্মীরা। বেলঘরিয়ায় সংস্থার প্রধান কার্যালয়ে একাধিক কর্মসূচির মাধ্যমে উদ্যাপিত হয় দিনটি।
২০২৩, ৩১ জুলাই নিগমের চেয়ারম্যান বিশেষ ভাবে সাজানো ১১টি ডিপোর ১১টি বাসের সূচনা করেন। এ দিন বিশেষ অবদানের জন্য ৩৫ জন কর্মীকে সম্মানিত করা হয়। বিদায় সংবর্ধনা দেওয়া হয় সদ্য অবসর নেওয়া ৩১ জনকে। অনুষ্ঠিত হয় রক্তদান শিবিরও।
সামনে ইঞ্জিন দেওয়া বাস থেকে দোতলা বাস, আরও পরে সিএনজি-চালিত বাস, বাতানুকূল ভলভো বাস এবং এখন ব্যাটারিচালিত বাস— নিগমের পরিষেবার এই সব পরিবর্তন এ দিন তুলে ধরেন পরিবহণ দফতরের প্রতিমন্ত্রী দিলীপ মণ্ডল ও রাজ্য পরিবহণ নিগমের ম্যানেজিং ডিরেক্টর রাজনবীর সিংহ কপূর-সহ একাধিক কর্তা। বিধানসভার ব্যস্ততায় উপস্থিত না থাকলেও শুভেচ্ছাবার্তা পাঠান পরিবহণমন্ত্রী স্নেহাশিস চক্রবর্তী। সন্ধ্যায় নিগমের চেয়ারম্যান মদন মিত্র বিশেষ ভাবে সাজানো ১১টি ডিপোর ১১টি বাসের সূচনা করেন। এ দিন বিশেষ অবদানের জন্য ৩৫ জন কর্মীকে সম্মানিত করা হয়। বিদায় সংবর্ধনা দেওয়া হয় সদ্য অবসর নেওয়া ৩১ জনকে। অনুষ্ঠিত হয় রক্তদান শিবিরও। নিগমের পক্ষ থেকে এ দিন বিভিন্ন ডিপোয় পাঠাগার তৈরির উদ্যোগের কথা জানানো হয়েছে, যা কর্মী এবং আধিকারিকদের সন্তানদের পড়াশোনার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে।
পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় বাস টার্মিনালের অবস্থান
পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় বাস ডিপোর অবস্থান
রাজ্য পরিবহনের অধীনে পশ্চিমবঙ্গে পাঁচটি ডিপো রয়েছে। সমস্ত এস.টি.ইউ.গুলি ডিপো এবং কারখানা সহকারে গঠিত। নীচে এস.টি.ইউ এবং তৎসংলগ্ন ডিপো ও কারখানার বিশদ বিবরণ প্রদত্ত হল:
কলকাতা রাজ্য পরিবহন নিগম:
নীলগঞ্জ, বেলঘরিয়া, পাইকপাড়া, মানিকতলা, সল্টলেক, কসবা, গড়িয়া, লেক, তারাতলা, ঠাকুরপুকুর ও হাওড়াতে ডিপোগুলি অবস্থিত।
বেলঘরিয়াতে অবস্থিত সি.এস.টি.সি.’র একটি কেন্দ্রীয় কর্মশালা আছে।
পশ্চিমবঙ্গ পরিবহন নিগম:
টালিগঞ্জ, খিদিরপুর, কালীঘাট, গড়িয়াহাট, পার্ক সার্কাস, রাজাবাজার, উল্টোডাঙ্গা, বেলগাছিয়া, বারাসাত, হাবরা ও জোকাতে ডিপোগুলি অবস্থিত।
পশ্চিমবঙ্গ ভূতল পরিবহন নিগম:
হাওড়া, সল্টলেক এবং সেক্টর-৫ এ অবস্থিত
উত্তরবঙ্গ রাজ্য পরিবহন নিগম:
কোচবিহার, শিলিগুড়ি, রায়গঞ্জ ও বহরমপুরে অবস্থিত এন.বি.এস.টি.সি.’র চারটি বিভাগ রয়েছে।
কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, মাথাভাঙ্গা, দিনহাটা, তুফানগঞ্জ, শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, ময়নাগুড়ি, মালবাজার, দার্জিলিং, কালিম্পং, ইসলামপুর, বহরমপুর, সিউড়ি, রানাঘাট ও উল্টোডাঙায় ডিপোগুলি অবস্থিত।
কোচবিহারে কেন্দ্রীয় কর্মশালা অবস্থিত। এছাড়াও কোচবিহার, শিলিগুড়ি, রায়গঞ্জ ও বহরমপুরে চারটি কর্মশালা রয়েছে।
দক্ষিণবঙ্গ রাজ্য পরিবহন নিগম:
দুর্গাপুর ও বেলঘরিয়াতে অবস্থিত এস.বি.এস.টি.সি.’র দুটি বিভাগ আছে
দুর্গাপুর, আসানসোল, বর্ধমান, আরামবাগ, কালনা, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বেলঘরিয়া, হাওড়া, হলদিয়া, দীঘা, মেদিনীপুর ও ফলতায় ডিপোগুলি অবস্থিত
দুর্গাপুর ও বেলঘরিয়ায় কেন্দ্রীয় কর্মশালা আছে।
প্রসঙ্গত, উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ নিগম বা North Bengal State Transport Corporation যাকে অনেকেই NBSTC নামে চেনেন, এবার সেই নিগমের অধীনে চুক্তিভিত্তিক প্রায় ৮০০ কর্মীকে নির্দিষ্ট স্ল্যাব অনুসারে ভাতা ও সেই সঙ্গে তিন শতাংশ করে বার্ষিক ভাতা বৃদ্ধি করেছে রাজ্য সরকার। নিগমের প্রায় ৮০০ চুক্তিভিত্তিক কর্মীকে বার্ষিক ৩ শতাংশ করে ভাতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। এঁদের নির্দিষ্ট স্ল্যাব অনুসারে বেতন আগেই বৃদ্ধি করা হয়েছিল।
কলকাতার সরকারি বাস আর আগের অবস্থায় নেই। বর্তমানে সরকারি বাস পরিষেবা আধুনিক হয়েছে।
পুরোনো লড়ঝড়ে সরকারি বাস আর চোখে পড়ে না। এখন যে সব সরকারি বাস রাস্তায় চলে, তার বেশিরভাগই গত কয়েকবছরের মধ্যে কেনা। প্রতিটি বাসই ‘লো-ফ্লোর’, অর্থাৎ যাত্রীদের উঠতে নামতে খুব একটা অসুবিধা হয় না। বাসের ভিতরেও আধুনিকীকরণের ছোঁয়া চোখে পড়ে। আসনগুলো বেশ বড়ো। পা রাখার জায়গাও অনেক বেশি। দাঁড়াবার জন্যেও পর্যাপ্ত জায়গা রয়েছে।
গ্রীষ্মকালের কলকাতায় শীততাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এখন আর বিলাসিতা নয়, নিতান্তই প্রয়োজনীয়। শহরে বেসরকারি বাস যা চলে তার মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটিই শীততাপ নিয়ন্ত্রিত। উল্টোদিকে, মহানগরীর রাস্তায় শীততাপ নিয়ন্ত্রিত সরকারি বাস রমরমিয়ে চলছে। বেশ কয়েকটি রুটে তো শীততাপ নিয়ন্ত্রিত বাস বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
রয়েছে স্মার্ট কার্ড, পথদিশা অ্যাপ পরিষেবা। সব মিলিয়ে সরকারি বাস পরিষেবার মান এখন যথেষ্ট উন্নত।
পরিবহন দপ্তরের দৃষ্টিভঙ্গি
সাশ্রয়কারী মূল্যে ব্যাপকভাবে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য জুড়ে যাত্রীদের পরিবেশ-বান্ধব, নিরাপদ এবং কার্য্যকরী উচ্চমানের বহুবিধ পরিবহন পরিষেবা দেওয়া।
উদ্দেশ্য
রাজ্যের সকল গ্রাম ও শহরে সংহত পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
পরিবহন সংক্রান্ত উন্নয়নের ক্রমবিকাশ।
ক্যারিয়ার এবং সাব ক্যারিয়ার প্রবর্তনের সাথে বহুবিধ পরিবহন ব্যবস্থা সংহত করা।
স্বল্প-কার্বন নির্গমনকারী পরিবেশ-বান্ধব পরিবহন ব্যবস্থায় উন্নীত করা।
পরিবহন ব্যবস্থায় ই-গভর্নেন্সে জোরদার করা।
সড়ক নিরাপত্তা।
পরিবহন দপ্তরে স্বনির্ভর কর্মসংস্থান প্রকল্পে উৎসাহদান।
আভ্যন্তরীণ জলপথ পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন।
আকাশপথ পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন।
তথ্যসূত্রঃ
https://transport.wb.gov.in/
ছবিঃ Kolkata Bus-O-Pedia