কুমিল্লার লোকজ ঐতিহ্য জাদুঘর : প্রায় ১২ হাজার দুর্লভ সংগ্রহের ঠিকানা

গ্রামীণ এলাকার মাটির ঘরে গড়ে তোলা হয়েছে লোকজ ঐতিহ্য জাদুঘর
জাদুঘর বা সংগ্রহশালা একটি জাতির দর্পন স্বরূপ। এটি শিল্প, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সামাজিক বিবর্তনের রূপরেখাকে দর্শকদের কাছে উপস্থাপন করে। দেশের অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে শিক্ষা দানের পাশাপাশি জনগণকে তাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানান দেয়। লোকজ ঐতিহ্য জাদুঘর উদ্যোগের নেপথ্যে যে কয়েকটি স্বপ্ন আমাকে তাড়া করে বেড়িয়ে ছিল, তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে দেশ বিদেশের সম্মানিত গবেষকদের গবেষণার রেফারেন্স সূত্র, উপাদান, তথ্য ও তত্ত্ব সংগ্রহের একটি নির্ভরযোগ্য ঠিকানা তৈরি করা। সে চেতনাবোধ ও মূল্যবোধ থেকেই কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার সাওড়াতলী গ্রামে ১২ হাজার দুর্লভ জিনিসপত্র নিয়ে লোকজ ঐতিহ্য জাদুঘর গড়ে তুলি।
২০০৫ সালে হতে সারাদেশে বইপড়া আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিতে ঘুরে বেড়িয়েছি গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। যেখানেই গিয়েছি সেখান থেকেই সংগ্রহ করেছি ইতিহাস ও ঐতিহ্যের দুর্লভ জিনিসপত্র। একটি দুটি করে সংগ্রহের যাত্রা আজ ১২ হাজারে গিয়ে পৌঁছেছে। দেশ ছাড়িয়ে উপমহাদেশের লোকজ সংস্কৃতির বহু উপাদান আমার সংগ্রহ রয়েছে।
জাদুঘরের অভ্যন্তরে
তার মধ্যে ১৯২৭ সালের দুর্লভ গ্রামোফোন/কলের গানের মেশিন ও কয়েক শত দুর্লভ এলপি গানের ক্যাসেট, কবি নজরুল ইসলামের প্রথম কলেরগান রেকর্ড, সংগীতজ্ঞ গওহর জান, সংগীতজ্ঞ লতা মঙ্গেশকর, আশা বোসলে, হেমন্ত মুখোপ্যাধায়, কিশোর কুমার, গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, আহমেদ রাফি, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম গানের রের্কড।
২০০৫ সালে হতে সারাদেশে বইপড়া আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিতে ঘুরে বেড়িয়েছি গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। যেখানেই গিয়েছি সেখান থেকেই সংগ্রহ করেছি ইতিহাস ও ঐতিহ্যের দুর্লভ জিনিসপত্র। একটি দুটি করে সংগ্রহের যাত্রা আজ ১২ হাজারে গিয়ে পৌঁছেছে।
৪০০ বছরের পুরোনো সিন্দুক, ১২ শত বছরের পুরোনো কয়েন সহ বিশ্বের ২০০টি দেশের ৩ হাজার পিস দুর্লভ মূল্যবান মুদ্রা/টাকা, বিশ্বের অন্যতম সুপ্রাচীন ব্যাংকিং ‘দি কুমিল্লা ব্যাংকিং কর্পোরেশন’-এর দুর্লভ মূল্যবান স্মারক, ২২৫ বছর আগের ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দুর্লভ দলিল। ১৫০টি দেশের ৫০০০ প্রাচীন দুর্লভ ডাকটিকিট। কৃষিভিত্তিক সমাজে ব্যবহৃত প্রাচীন ৩০০-৪০০টি দুর্লভ যন্ত্রপাতি/উপকরণ, ভাষা আন্দোলন/স্বাধীনতা সংগ্রামসহ দেশের ইতিহাস ঐতিহ্যের ৫০০০ দুর্লভ আলোকচিত্র ও উপকরণ। মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত আর্টিলারি শেল, বুলেট, বন্দুক যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশে রিলিফের ৭ কোটি কম্বলের মধ্যে একটা কম্বল স্মারক স্মৃতি সংরক্ষণ।
মানব সমাজে ব্যবহৃত প্রাচীন তৈজসপত্র, প্রাচীন টাইপ রাইটার, ঘড়ি, কাঠ বক্স টেলিভিশন, রেডিও, ভিসিআর, বিভিন্ন মডেলের প্রাচীন ক্যামেরা, ভিডিও রেকর্ডার, বিভিন্ন মডেলের টেলিফোন, প্রেক্ষাগৃহে/সিনেমা হলে ব্যবহৃত সিনেমার রিল ক্যাসেট, প্রাচীন বিভিন্ন আমলের অডিও ভিডিও ক্যাসেট, বিভিন্ন মডেল-কোম্পানির মোবাইল। প্রাচীনকাল হতে ব্যবহৃত বিভিন্নরকম কলম, দোয়াত কলম ও বিখ্যাত সুলেখা কালি। প্রাচীন সমাজে শৈশব কৈশোর কালের ব্যবহৃত খেলার বিভিন্ন উপকরণ, প্রাচীন কুপি, হারিকেন, টর্চলাইট, প্রাচীন খড়ম, প্রাচীন চরকা, মানব সমাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র, কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাওয়া বিভিন্ন প্রসাধনী। ৩২০টি নদীর পানি ও মাটি, ৬৪টি জেলার মাটি।
সামুদ্রিক বিভিন্ন শামুক, ঝিনুক, মুক্তা, প্রবাল, কাঁকড়া জীবাশ্ম, মানব সমাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন ভেষজ, বনোজ, ফলজ বৃক্ষ ও ফসলের মূল, প্রায় বিলুপ্ত প্রজাতির প্রাণী হেজার কাটা, দুর্লভ বাঘের দুধ, হরিণের মেষ আম্বর/কস্তুরি।
সামুদ্রিক অক্টোপাস মাছের স্পেসিম্যান, ৫ হাজার গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস, সাহিত্য, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, আইন, কৃষি, বিশ্ব সাহিত্য, শিশু সাহিত্য, ধর্ম বিষয়ক গ্রন্থ, গবেষণার রেফারেন্স বই। ভারতবর্ষের সুপ্রাচীন ব্যাকারণবিদ পাণিনির প্রথম ব্যাকরণ গ্রন্থ অষ্ঠ্যাধায়ী, বিদ্যাসাগর রচিত গৌরীয় ব্যাকরণ গ্রন্থ।
জাদুঘরে উৎসুক কচিকাঁচারা
দেশ-বিদেশের ১ হাজার ম্যাগাজিন ও স্মারক গ্রন্থ। দেশের সকল জাতীয় দৈনিক সহ আঞ্চলিক পত্রিকার সমাহার। প্রাচীন বাল্যশিক্ষার বই সমূহ। বিশ্ব বিখ্যাত এনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটানিকার ৩৩টি খন্ড সংগ্রহ। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিবস ও উপলক্ষে ছাপানো ২ হাজার পত্রিকা ও বিশেষ ক্রোড়পত্র। বিশ্বখ্যাত কয়েক হাজার মনীষীর আলোকচিত্র ও জীবনী।
সৃজনশীল বইপড়ার প্রতি ছাত্র, যুব ও সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে জাদুঘরের পাঠাগার হতে বই নিলে ‘প্রবেশ মূল্য ফ্রি’ এমন বিষয়টি দিনে দিনে পাঠক বাড়িয়ে দিচ্ছে। প্রতিদিন শত শত সাধারণ উৎসুক জনতা ভিড় জমাচ্ছে জাদুঘরটি একপলক দেখার জন্য। বিশেষ করে বিভিন্ন স্কুল ও কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা আগ্রহ নিয়ে আসছে দল বেঁধে বেঁধে।
বিভিন্ন ধরনের রাস বা মটকা রয়েছে জাদুঘরে। এগুলোর কোনো কোনোটির বয়স শত বছরের ওপরে।
জাদুঘরটি মূলত নতুন প্রজন্মের কাছে বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদের লোকজ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি তুলে ধরছে গুরুত্বের সঙ্গে। জাদুঘর প্রাঙ্গণে সংস্কৃতি বিকাশে একটি মুক্ত মঞ্চ তৈরি করেছি যেখানে শিশু ও যুবরা বিভিন্ন মঞ্চ নাটিকা ও আবৃত্তি অনুশীলন করে থাকে।
প্রতিষ্ঠাতা ইমাম হোসাইনের সঙ্গে জাদুঘর পরিদর্শনে বাংলা একাডেমির গবেষণা বিভাগের প্রখ্যাত গবেষক মামুন সিদ্দিকী ও সুপাঠক ঠাকুর জিয়াউদ্দিন আহমেদ। (বাঁ দিক থেকে)
জাদুঘরটিতে প্রতিদিন বহু দর্শনার্থী ও গবেষক আসেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত হতে। কিন্তু পর্যাপ্ত নিরাপত্তার অভাবে দুর্লভ জিনিসপত্র হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই বিষয়টিতে সমাজের চিত্ত-বিত্তবান মানুষের পাশাপাশি সরকারের প্রয়োজনীয় সহায়তা কামনা করি। পর্যাপ্ত পৃষ্ঠপোষকতা পেলে জাদুঘরটি হতে পারে ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বাহক কেন্দ্র।