বন্ধ হয়ে যাওয়া সিঙ্গেল স্ক্রিন আজও শহরের ল্যান্ডমার্ক

ভবানী সিনেমাহল এখন বাস স্টপেজ
দুপুর-বিকেলের সন্ধিক্ষণের ম্যাটিনি শো নেই, বৃহস্পতি-শনি-রবির ঠাসা ভিড় নেই, বাদাম-চানাচুর-ঘুগনির পসরা নেই, ব্যালকনি একশো বলে ব্ল্যাকারের হাঁক-ডাক নেই। লেমনেড ছেড়ে কৃষ্ণ বর্ণের ঠান্ডা নরম পানীয় আর ভুট্টা ভাজায় মজেছে আধুনিক বাঙালি। টিকিট কাটতে আর লাইন নয়, মোবাইলে তিন-চারটে ক্লিকেই কেল্লাফতে!
ইতিহাস মুছে গেলেও রয়ে যায় তার চিহ্ন। বাস, ট্রাম নিদেনপক্ষে অটোর মতো গণপরিবহণে চেপে কলকাতা ঘুরতে শুরু করলে সেই স্মৃতি চিহ্ন ছুঁয়ে দেখার সুযোগ মিলবে। জানান দেবে, শেষ হয়েও হয়নি শেষ। শহরের স্থাননামে মিশে গিয়ে টিকে রয়েছে সিঙ্গেল স্ক্রিন।
সাম্রাজ্য বিস্তার করে ফেলেছে মাল্টিপ্লেক্স, এক পর্দার সিনেমা হল নাম পেয়েছে সিঙ্গল স্ক্রিন। একে একে সিঙ্গল স্ক্রিনের ঝাঁপ বন্ধ হয়েছে আগেই। কেতাদুরস্ত আম বাঙালির সিনেমা হল ধীরে ধীরে মলে পরিণত হচ্ছে। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আর্থ-সামাজিক বাঁক বদল। নয়ের দশকের শেষ থেকে মধ্যবিত্ত বাঙালি সিনেমা হলমুখী হওয়া ছেড়েছে। দিনে দিনে হল বিমুখ হওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। তালা পড়েছে একের পর এক সিঙ্গল স্ক্রিনে। কফিনে শেষ পেরেক হয়ে এসেছিল করোনা।
গত শতকের দুই ও তিনের দশকে যে শহরে পাড়ায় পাড়ায় তৈরি হয়েছিল এক পর্দার সিনেমা হল, সেই শহরে সিঙ্গল স্ক্রিন আজ ইতিহাসের উপাদান। কিন্তু এত দিনের নাড়ির টান কি সহজে ছিঁড়ে ফেলা যায়? ইতিহাস মুছে গেলেও রয়ে যায় তার চিহ্ন। বাস, ট্রাম নিদেনপক্ষে অটোর মতো গণপরিবহণে চেপে কলকাতা ঘুরতে শুরু করলে সেই স্মৃতি চিহ্ন ছুঁয়ে দেখার সুযোগ মিলবে। জানান দেবে, শেষ হয়েও হয়নি শেষ। শহরের স্থাননামে মিশে গিয়ে টিকে রয়েছে সিঙ্গেল স্ক্রিন। এককালে যেখানে প্রিমিয়ারের আসর বসত, তাবড় তারকাদের ভিড়ে গমগম করত গোটা চত্বর, আজ সেখানে হয়তো দাঁড়িয়ে রয়েছে ভাঙা একটা পেল্লায় বাড়ি বা তৈরি হয়েছে শপিং মল, কর্পোরেট অফিস। কিন্তু এলাকার নামটা আজও জানান দিচ্ছে সেই সোনাঝরা দিনের। জানান দিচ্ছে ইতিহাসের...
হল বন্ধ হলেও এলাকাটি খান্না নামেই পরিচিত
প্রথমে সিনেমা হলগুলো নিছক গন্তব্য হিসাবে ব্যবহৃত হত। অর্থাৎ সিনেমা দেখতে আসা লোকেরা হলের নাম উল্লেখ করে বলতেন, তাঁরা কোথায় যাবেন। ধীরে ধীরে হলগুলো হয়ে উঠল নির্দিষ্ট এলাকার পরিচিতির সূচক (ল্যান্ড মার্ক)।
উত্তর কলকাতা থেকেই শুরু করা যাক। শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড় থেকে এপিসি রোড ধরে এগিয়ে চলেছেন। বাস কন্ডাক্টর হাঁক দেবে, খান্না নামবেন খান্না? সেকালের খান্না সিনেমা হল আজ মানুষের স্মৃতিতে একটি বাসস্টপের নাম হয়ে রয়ে গিয়েছে। খান্না মোটরস-র মালিকেরা ১৯১৭ সাল নাগাদ সিনেমা হলটি তৈরি করেছিলেন। হাতিবাগানের বৃহত্তর সিনেপাড়ার মধ্যে খান্নাও পড়ত। হল বন্ধ হলেও এলাকাটি খান্না নামেই পরিচিত।
গণেশ টকিজের বর্তমান অবস্থা
কলকাতার বুক থেকে হারিয়ে গিয়েছে হীরালাল সেনের স্মৃতিবিজড়িত রবীন্দ্র সরণির গণেশ টকিজ হল। ১৯১৪ সালে হল তৈরি হলেও গণেশ টকিজ নাম হয় ১৯৩১ সালে। হলের ঝাঁপ পড়লেও বড়বাজার-পোস্তা অঞ্চলে বাসস্টপ হয়ে বেঁচে রয়েছে গণেশ টকিজ।
বিধান সরণীর রূপবাণীও এখন বাসস্টপ। ১৯৩২ সালে পথচলা শুরু করা এই সিনেমা হলের নাম রেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পূরবী, ১৯৩৬ সালে নির্মিত এই সিনেমা হল এখন ভাঙা হচ্ছে। সিনেমা দেখানো বন্ধ হয়েছে বহুকাল কিন্তু এমজি রোড ধরে চলা শিয়ালদহ-বড়বাজার অটো বা বাস রুটের বহু সওয়ারি এখনও বলে ওঠেন পূরবী নামবো।
লোটাস সিনেমাহল
এন্টালির লোটাস সিনেমা হল-এর যাত্রা শুরু হয়েছিল আরডি বনসলের হাত ধরে, ১৯৫৮ সালে। আজ আর লোটাস সিনেমা হলের অস্তিত্ব নেই, কিন্তু লোটাস সিনেমা স্টপেজ বা লোটাস সিনেমা ক্রসিং রয়ে গিয়েছে এসএন ব্যানার্জি রোড ও রফি আহমেদ কিদওয়াই রোড সংলগ্ন চত্বরে।
এসপ্ল্যানেড চত্বরের কথা বললেই উঠে আসে মেট্রোর কথা। ১৯৩৫ সালে মেট্রোর যাত্রা শুরু হয়েছিল প্রেক্ষাগৃহ হিসাবে। আজ তা শপিং মল, পাশাপাশি রয়েছে মাল্টিপ্লেক্স। প্রাক গুগল ম্যাপ-অ্যাপ ক্যাব যুগে মেট্রোই ছিল ধর্মতলার গুরুত্বপূর্ণ ল্যান্ড মার্ক। আজও তা-ই। মেট্রো গলি একইভাবে বিখ্যাত অদ্যাবধি। মেট্রোর উল্টো দিকে রয়েছে ২১৪এ-র বাস স্ট্যান্ড (সোদপুর গির্জা- এসপ্ল্যানেড)।
মেট্রো গলি
এসপ্ল্যানেড পেরিয়ে দক্ষিণ কলকাতাতেও স্থাননামে এসে পড়েছে সিনেমা হলের নাম। ১৯২০ সাল নাগাদ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় রোডে নির্মিত হয় রসা থিয়েটার। পরে নাম হয় পূর্ণ সিনেমা। হল আজ আর নেই কিন্তু পূর্ণ এখন বাসস্টপ। উচ্চারণ খানিক বদলে আম জনতার ভাষায় পুণ্য হয়ে গিয়েছে। রাসবিহারী-এক্সাইডের মধ্যে যাতায়াত করা বাসগুলোর কন্ডাক্টরেরা জিজ্ঞাসা করেন, পুণ্য নামবেন পুণ্য?
শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় রোডের শান্তি থিয়েটার, যা পরে (১৯৫১) ভারতী সিনেমা নামে পরিচিতি পায়। অধুনা ভবানীপুর অঞ্চলের একটি স্টপেজ হয়ে গিয়েছে ভারতী সিনেমা।
টালিগঞ্জ অঞ্চলে রবীন্দ্র সরোবর মেট্রো স্টেশনের পাশে, মুদিয়ালীর কাছে একসময়ের খুবই বিখ্যাত ভবানী সিনেমাহলও এখন বাস স্টপেজ। সরোবর মেট্রো স্টেশনের একটি গেটের দিকনির্দেশিকাতেও ভবানী সিনেমা হলের নাম এখনও জ্বলজ্বল করছে।
কলকাতা ছাড়িয়ে শহরতলিতেও রয়েছে এই প্রবণতা। উত্তরপাড়ার একটি বাস স্টপের নাম গৌরী সিনেমা। ডানলপের আগেই রয়েছে বাস স্টপেজ অনন্যা, সোদপুর-বারাসাত রোডে, এইচবি মোড় পেরোলেই পড়বে পদ্মা সিনেমা বাস স্টপ। তিনটি সিনেমা হলই ভ্যানিশ! কিন্তু স্থাননামে তারা সজীব।
স্থাননাম ছাড়াও স্রেফ চানাচুরের নামেও টিকে আছে সিঙ্গেল স্ক্রিনের স্মৃতি। দক্ষিণে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় রোডে উজ্জ্বলা সিনেমা হল তৈরির আগেই শুরু হয়েছিল উজ্জ্বলা চানাচুরের জয়যাত্রা। হিম্মতভাই প্যাটেল গুজরাত থেকে এসে গুরুপদ হালদার সরণি ও শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় রোডের মুখে ১৯২৮ নাগাদ চানাচুরের দোকান খোলেন। কোনও নাম ছাড়াই চানাচুর এক-দেড় দশক কাটিয়ে দিয়েছিল। উজ্জ্বলা সিনেমা হল চালু হওয়ার পর দর্শকেরা, সিনেমা দেখতে এসে চানাচুর কিনে খেতেন। হলের সামনে ছোট্ট দোকানে সকাল থেকে চানাচুর ভাজা হত। লোকমুখে নাম হল উজ্জ্বলা চানাচুর। হলটি উঠে যাওয়ার পরও হলের নামেই বিক্রি হচ্ছে উজ্জ্বলা চানাচুর। উত্তরে এপিসি রোডে ছিল ছায়া সিনেমা হল। হলের অনতিদূরে অবস্থিত নামহীন চানাচুর-ভুজিয়ার দোকানের নাম হয়েছে ছায়া চানাচুর। যদিও সিনেমা হলটির আর অস্তিত্ব নেই।
স্থাননামে এক পর্দার সিনেমা হলের নাম এসে পড়া হালের প্রবণতা নয়। আদতে স্থাননামে কোনও কিছু এসে পড়া বা স্থাননামের জন্ম দীর্ঘকালের ফসল। এই সফরের কয়েকটি ধাপ রয়েছে। প্রথমে সিনেমা হলগুলো নিছক গন্তব্য হিসাবে ব্যবহৃত হত। অর্থাৎ সিনেমা দেখতে আসা লোকেরা হলের নাম উল্লেখ করে বলতেন, তাঁরা কোথায় যাবেন। ধীরে ধীরে হলগুলো হয়ে উঠল নির্দিষ্ট এলাকার পরিচিতির সূচক (ল্যান্ড মার্ক)। তারপর মিশে গেল শহরের স্থাননামে। কালের নিয়মে সিঙ্গেল স্ক্রিন হারিয়ে গেল একে একে, কিন্তু স্থাননামগুলো অক্ষত রয়ে গেল। ইতিহাস বেঁচে থাকল।