‘সিনেমা পাড়া’ হাতিবাগান

বিংশ শতাব্দীর বিশের দশক শুরুর অনেক আগেই উত্তর কলকাতায় টাউন স্কুলের পাশে একটি মাঠে তাঁবু ফেলে সিনেমা প্রদর্শন শুরু করে দেন পারসি ব্যবসায়ি জে.এফ. ম্যাডান। পরে যখন তিনি সাহেবপাড়ার হল তৈরি করেন, সে সময় তাঁবুর মাঠেই দু’টি পাকা প্রেক্ষাগৃহও নির্মাণ করেন - কর্নওয়ালিস ও ক্রাউন। সেই শুরু। ম্যাডান নির্মিত ‘কর্নওয়ালিস’-ই উত্তর কলকাতার প্রথম সিনেমা হল। হলের নামকরণ হয়েছিল রাস্তার নামেই। ধীরে ধীরে কর্নওয়ালিস স্ট্রিট (অধুনা বিধান সরণি) অঞ্চলের হাতিবাগানের চারিদিকে গড়ে ওঠে আরও অনেক সিনেমা হল - মিত্রা, রূপবাণী, শ্রী, উত্তরা, রাধা, খান্না, দর্পণা, মিনার, বীণা, পূর্ণশ্রী, বিধুশ্রী, সুরশ্রী, টকি শো হাউজ, এবং থিয়েটার হল থেকে সিনেমাহলে পরিণত গ্রেস। দর্শকের ভিড় সামলাতে নাজেহাল অবস্থা হতো হল-মালিকদের। শেষ পর্যন্ত হাতিবাগানের নামই হয়ে গেল ‘সিনেমা পাড়া’।
সকাল থেকে রাত বারোটা অবধি গমগম করত এই অঞ্চল। সঙ্গে ছিল থিয়েটার হল। সেখানে বৃহস্পতি-শনি-রবি অভিনয় চলত। শনি ও রবি আবার ডাবল শো। হাতিবাগান হয়ে উঠেছিল মিনি সিনেমা শহর। বিনোদন সংস্কৃতির হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে ম্যাডান কোম্পানি ১৯১৯ সালে তৈরি করল বাংলায় প্রথম পূর্ণাঙ্গ ফিচার ‘বিল্বমঙ্গল’, পরিচালক জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলার প্রথম নির্বাক ফিচার মুক্তি পায় কর্নওয়ালিস সিনেমাতেই। প্রথম বাংলা ফিচারের নারী চরিত্রে ছিলেন অবাঙালি মিস গহর।
পরবর্তীতে ‘কর্ণওয়ালিস’-ই ১৯৩৫ সালে হয়ে ওঠে ‘উত্তরা’। পাশেই ছিল ‘শ্রী’ সিনেমা। শুরুতে যে ক্রাউন সিনেমাহলের উল্লেখ করেছিলাম, সেটিরই পরিবর্তিত নাম ‘শ্রী’। একুশ শতকে সেই জায়গায় এখন আমরা দেখতে পাই জামাকাপড়ের মার্কেট। প্রসঙ্গত, ১৯৩১-এর ২৫ এপ্রিল ক্রাউন সিনেমাতেই মুক্তি পায় প্রথম বাংলা সবাক ছবি ‘জামাইষষ্ঠী’।
ম্যাডান কোম্পানির সাফল্য়ে অনুপ্রাণিত হয়ে সিনেমা ব্যবসায় নেমে পড়লেন একজন বাঙালি, নাম অনাদি বসু। অনাদি বসুই খোলেন অরোরা ফিল্ম কোম্পানি। পরে তিনি সিনেমা নির্মাণের পথে পা রাখলে অরোরা ফিল্ম কোম্পানির নাম পাল্টে হয় ‘অরোরা ফিল্ম কর্পোরেশন’।
বিশ দশকের শেষে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ জড়িয়ে পড়েছিলেন সিনেমার সঙ্গে। যদিও তাঁর কাহিনি নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। জার্মানি গিয়ে কবি এবার ছবির চিত্রনাট্য লিখলেন। বাংলায় সেটাই পরে ‘শিশুতীর্থ’ কবিতা। এরপর রবীন্দ্রনাথ ‘নটীর পূজা’ নাম দিয়ে চিত্র পরিচালনা করার ভাবনা নিয়ে উত্তর কলকাতার একটি হলের নামকরণ করলেন রূপবাণী, যার উদ্বোধন উপলক্ষে ‘রূপবাণী’ নামে একটি কবিতাও লেখেন তিনি। ততদিনে শুধু ছবি তৈরি নয়, প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণেও নেমে পড়েছেন বাঙালিরা। রঙমহল ও স্টার থিয়েটারের মাঝে এক বড় সিনেমা হল বানাল নবগঠিত বাঙালি সংস্থা স্ক্রিন কর্পোরেশন লিমিটেড। সেই সংস্থার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন সুধীর নান, রবীন্দ্রনাথ দত্ত এবং মনোরঞ্জন ঘোষ।
রূপবাণী
বাংলা ছবি তখন সবে সবাক হয়েছে। এই সময়েই তৈরি হয়েছিল বিলাসবহুল রূপবাণী। বাংলার প্রথম সিনেমা হল যেখানে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করার যন্ত্র বসানো তোরণদ্বার, ও ছবিঘরের মধ্যের প্রাঙ্গণে চারধারে বাগান, মাঝখানে গাড়ি রাখার জায়গা। মূল ফটকের দু’ধারে দু’টি ছোট গেট, একটি দিয়ে গাড়ি ঢুকবে, অন্যটি দিয়ে বেরোবে। মহিলাদের জন্য আলাদা সিঁড়ির ব্যবস্থা, সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতলায় তাঁদের বিশ্রামঘর। প্রেক্ষাগৃহে তিনটি লবি। এই প্রেক্ষাগৃহেই প্রথম চালু হয় হঠাৎ আলো না নিভিয়ে ধীরে ধীরে আলো নেভানো, যা পরবর্তীকালে সব সিনেমা হলের প্রথা হয়ে দাঁড়ায়। তৎকালীন কলকাতার সেরা সিনেমা হল হয়ে ওঠে রূপবাণী, যার উদ্বোধন হয় ১৯ ডিসেম্বর, ১৯৩২ সালে, সৌজন্যে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ।১৯৩১-এ বি এন সরকার যখন নিউ থিয়েটার্স স্টুডিও তৈরি করছেন, ভারতের রাজনৈতিক আন্দোলন তখন তুঙ্গে। তার আগের বছরই কলকাতায় তৈরি হয়েছে নিউ থিয়েটার্স-এর নিজস্ব সিনেমাহল, চিত্রা। এই প্রেক্ষাগৃহের উদ্বোধক ছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। উদ্বোধনী ভাষণে তিনি সিনেমা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত সকলের কাছে আবেদন রাখেন যে, তাঁরা যেন বিদেশি ভাষাকে প্রাধান্য না দেন, যেন বিশেষ করে বাংলা ছবি করেন। ম্যাডান চলচ্চিত্রকে নিছক ব্যাবসা হিসেবে দেখলেও বাঙালি চলচ্চিত্র ব্যবসায়ীরা ব্যবসার বাইরেও চলচ্চিত্রকে মত ও প্রচারের জনপরিসর হিসেবেও ব্যবহার করলেন।
প্রথম থেকেই অঙ্গসজ্জার জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল চিত্রা প্রেক্ষাগৃহ। অঙ্গসজ্জা করেছিলেন প্রখ্যাত শিল্পী চারু রায়। দু’দিকের খোদাই ছবি আঁকেন শিল্পী কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। বাঙালি সিনেমা প্রদর্শকদের কাছে মূল চ্যালেঞ্জ ছিল সাহেবপাড়ার সব প্রেক্ষাগৃহ। তাই সেই সময়ের পত্রিকা চিত্রলেখাতে বেরিয়েছিল, “বাঙ্গালীর দুঃখ-জ্বালা সম্পূর্ণ না হউক অংশত দূর করিয়াছেন শ্রীযুক্ত বি এন মহাশয়। উত্তর কলিকাতার একেবারে বাঙ্গালী পাড়ার কেন্দ্র স্থলে আধুনিকতম চিত্রাগার চিত্রার প্রতিষ্ঠা করলেন তিনি। চিত্রার সমতুল্য চিত্রাগার ম্যাডান কোম্পানীর নাই। চিত্রার তুলনায় এম্পায়ার ও গ্লোবেরও দোষ ধরা যাইতে পারে। চারি আনা দর্শনী দিয়াও যাঁহারা প্রবেশ করবেন তাঁহারাও দেয় মূল্যের অনেক বেশী আরাম পাইয়া খুশী হইবেন। টকির এমন নিঁখুত আয়োজন অন্য কোনও চিত্রাগারে নাই।”
মিত্রা
এহেন হলের ১৫ এপ্রিল ১৯৬৩ সালে হাতবদল হয়ে নতুন নাম হয় মিত্রা। বাড়ি একই থাকলেও মিত্রার সমস্ত অঙ্গসজ্জা নষ্ট হয়ে যায়। প্রায় নয় দশক ধরে কলকাতার ঐতিহ্যের সাক্ষী বহন করেছিল মিত্রা। দু’বছর হল সেই মিত্রাও আর নেই। ২০১৯-এই তার যবনিকা পতন হয়েছে।
হরিপদ পাল নির্মাণ করেছিলেন মিনার চিত্রগৃহ। ইনিই তার আগে মধ্য ও দক্ষিণ কলকাতায় নির্মাণ করেছিলেন ছবিঘর ও বিজলী। বাংলা সিনেমা সংস্কৃতির আর এক ঐতিহাসিক সাক্ষী ছিল রাধা সিনেমা। এখন নেই, সেখানে হয়েছে 'বিগবাজার। ‘দর্পণা’ সিনেমা হলটি উদ্বোধন হয়েছিল চার্লি চ্যাপলিনের ছবি ‘সিটি লাইটস’ দিয়ে। রাজ কাপুরের ‘একদিন রাত্রে’ মুক্তি পেয়েছিল এই প্রেক্ষাগৃহেই। রাজ কাপুরও এসেছিলেন।
টকি শো হাউজ
সাহিত্যিক বিমল পাল ফড়িয়াপুকুরে একটি সিনেমা হল নির্মাণ করে নাম দেন শো হাউজ। পরে তা হয়ে ওঠে টকি শো হাউজ। উত্তর কলকাতার একমাত্র প্রেক্ষাগৃহ যেখানে পুরোনো দিনের হলিউড ছবি দেখানো হত। প্রথম প্রদর্শিত ছবি ‘অ্যাক্রস টু সিঙ্গাপুর’। ইংরেজি সিনেমাপ্রেমীদের জন্য সেখানে রবিবারের সকালে থাকত বিশেষ উপহার। ‘পথের পাঁচালী’ তখনও হয়নি। এক সকালে সের্গেই আইজেনস্টাইনের ‘ইভান দ্য টেরিবল’ দেখতে হলে পৌঁছে যান সত্যজিৎ রায়।
পূর্ণশ্রী
রূপবাণী এবং রঙমহল থিয়েটারের মাঝখানের গলিতে পূর্ণশ্রী। একমাত্র হিন্দি ছবি দেখানো হত। আরও পূর্বে খান্না ও ‘বিধুশ্রী, সেখানেও হিন্দি ছবি। বাংলার ঐতিহ্যবাহী রূপবাণী সিনেমা ভেঙে যেমন ফ্ল্যাটবাড়ি নির্মিত হয়, তেমনই উত্তরা ভেঙে হয় শপিং কমপ্লেক্স।
উত্তরের সিনেমা হল অঞ্চল ছিল স্থাপত্য, শিল্পরুচি, ঐতিহ্যের মিশেল। ম্যাটিনি, ইভনিং, নাইট-দুপুর-সন্ধ্যা-রাত্রি যেখানে আলো ঝলমল করত সিনেমা ভাবনায়। ভাঙাভাঙি, সিঙ্গল স্ক্রিন বনাম মাল্টিপ্লেক্স এসবের কোলাহলে হাতিবাগানের সিনেমাপাড়া আজ শুধুই অতীত। শুধুই মনের ক্যামেরায় তার স্থান।
গ্রন্থঋণঃ
সিনেমা হলের জন্ম ও মৃত্যু : চণ্ডী মুখোপাধ্যায়