No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    এক বাঙালি নেটিভের জন্য বিশপ সাহেব তৈরি করলেন আস্ত গির্জা 

    এক বাঙালি নেটিভের জন্য বিশপ সাহেব তৈরি করলেন আস্ত গির্জা 

    Story image

    এই গির্জা দেখেনি, এমন মানুষ হয়তো কলকাতায় নেই। বড়ো রাস্তার ওপরে বহাল তবিয়তে দাঁড়িয়ে আছে। যত্ন-আত্তি তার কম হয় না। সামনেই আরো বেশ কিছু প্রাচীন ইমারৎ। টংটং শব্দ করে রাস্তার ওপর দিয়ে ট্রাম ছুটে যায়। কত কত কলেজ ছাত্র, স্কুল-পড়ুয়া রোজ তার সামনে জড়ো হয়। আবার ফিরে যায় সূর্যের গায়ে বিকেলের লালচে রং লাগতে না লাগতেই। সড়কের নাম বদলায়। দোকানের হোর্ডিং বদলায়। গির্জাটি সেই সমস্ত বদলের সাক্ষী হয়ে থাকে। বেথুন কলেজের গায়ে অনেকগুলি গাছপালায় ঘেরা ছায়া-ছায়া এই লালরঙা গির্জা। রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতিলিপ্ত। সাধারণে একে অবশ্য চেনে ক্রাইস্ট চার্চ হিসেবেই। 

    ১৮২/বি, বিধান সরণী-- গির্জাটির ঠিকানা। এই বিধান সরণীর আগের নাম ছিল কর্নওয়ালিস স্ট্রিট।  উনিশ শতকের বাঙালিটোলার এক অন্যতম জায়গা। এই রাস্তাকে ঘিরেই কাশীপ্রসাদ ঘোষের বাড়ি, বিবেকানন্দের বাড়ি, হেদুয়ার পুল, স্কটিশ চার্চ কলেজ, ডাফের চার্চ, বেথুন কলেজ-- যেন পাশাপাশি সারিবদ্ধ ইতিহাস। এত সহজভাবেই এরা দাঁড়িয়ে থাকে, যে আলাদা করে নজরই দেওয়া হয় না। যেমন এই গির্জাটি। মুসকিল হল, আজ ২০১৯-এ, এটি আমাদের কাছে গির্জাই। এর বেশি কিছু নয়। কিন্তু একসময় এটি শুধু একটি ধর্মচর্চার জায়গা ছিল না। সামাজিক অনেক টালমাটাল পরিস্থিতি, অনেক প্রতিরোধ আন্দোলনের স্মৃতি এই গির্জার সঙ্গে অপ্রত্যক্ষে যুক্ত। 

    শিবনাথ শাস্ত্রী জানাচ্ছেন, কৃষ্ণমোহনের জন্যই নাকি ১৮৩৯ সালে বিশপ উইলসন গির্জাটি নির্মাণ করেন। একজন নেটিভ বাঙালির জন্য এক সাহেব গির্জা বানাচ্ছেন, তা থেকে বোঝাই যায় কৃষ্ণমোহন মানুষটি নেহাত হেলাফেলার ছিলেন না। এই গির্জায় বেশ কিছুকাল ছিলেনও প্রেস বাইটার ইনচার্জ কৃষ্ণমোহন। আসলে, উনিশ শতকের একটি বড়োসর প্রতিস্পর্ধা ছিলেন তিনি। ১৮১৩ সালে জন্মেছিলেন কলকাতার ঝামাপুকুর অঞ্চলে। ১৮১৮-১৯ সালে, মানে আজ থেকে দুশো বছর আগে কৃষ্ণমোহন ভর্তি হয়েছিলেন হেয়ারের পাঠশালায়। কালীতলায় অবস্থিত ছিল স্কুল সোসাইটির সেই পাঠশালাটি। এরপর ১৮২৪-এ হিন্দু কলেজের অবৈতনিক ছাত্র হিসেবে কৃষ্ণমোহনের প্রবেশ। কিছুদিনের মধ্যেই ডিরোজিওর সঙ্গে তাঁর গভীর আলাপ। ইয়ং বেঙ্গলের নেতাও হয়ে উঠলেন কৃষ্ণমোহন। রামতনু লাহিড়ীর সঙ্গে বন্ধুত্ব গাঢ় হল তাঁর। পড়াশোনা, যুক্তিবোধে তুখোড় ছিলেন মানুষটি। হিন্দু ধর্মের অনাচার গোঁড়ামি অন্ধতাকে জোর প্রশ্ন করছেন। সেটাও তো প্রশ্ন করারই যুগ। 

    ১৮৩১ সালে পাথুরিয়াঘাটার প্রসন্ন কুমার ঠাকুর ‘রিফরমার’ নামে একটি পত্রিকা বের করলেন। সেটার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সেই বছরই মে মাসে কৃষ্ণমোহন প্রকাশ করলেন ‘Inquirer’ পত্রিকা। হিন্দু ধর্মের গোঁড়ামিকে সেখানে কাঠগড়ায় তোলা হয়েছিল।

    এর আগে ১৮৩০ সালে আলেকজান্ডার ডাফ এদেশে এলে তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল কৃষ্ণমোহনের। হিন্দু কলেজের প্রথা ভেঙে সেখানে যাতায়াত শুরু করেন তিনি। ১৮৩২ সালে তাঁর খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ। হিন্দু বাঙালি ঘরের ছেলেরা ধর্মের বেষ্টনী ভেঙে যে একে একে এরপর বেরোতে শুরু করে, তার অন্যতম হোতা বলা যায় কৃষ্ণমোহনকে। বাড়ি থেকে বিতাড়িত তাঁকে হতে হয়েছিল। দীর্ঘদিন এদিক-ওদিক ভেসে বেড়ানো চলেছিল। হ্যাঁ, এক ধর্মের খপ্পর ছেড়ে, অন্য ধর্মের খপ্পরেই পড়েছিলেন হয়তো। কিন্তু, তার ভিতরেও একটি প্রতিস্পর্ধার আগুন লুকিয়েছিল। যে আগুনের ফলেই রাধাকান্ত দেবকে নিজের পত্রিকায় গাধাকান্ত দেব হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। কারণটি অনুমেয় সহজেই। ইংরেজ-তোষামোদ ও হিন্দুধর্মের অন্ধতাকে প্রশ্রয়।

    কৃষ্ণমোহনের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী বিন্ধ্যবাসিনী দেবীও। অনেক পরে হলেও। এই ঘটনা সে যুগে কম আলোড়ন ফেলেনি।

    ১৮৩৯ সালে তাঁর ছোটো ভাই কালীমোহনও খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। আর সেই বছরই তৈরি হয় এই গির্জা। কালীমোহনও এখানেই ছিলেন বেশ কিছুকাল। এখানেই প্রসন্ন কুমার ঠাকুরের একমাত্র পুত্র জ্ঞানেন্দ্রমোহন খ্রিস্টধর্ম অবলম্বন করেন কৃষ্ণমোহনের কাছে। ফলে সেও ত্যাজ্যপুত্র হয়। কৃষ্ণমোহনের মেয়ে কমলমণির সঙ্গে বিয়ে হয় জ্ঞানেন্দ্রমোহনের। এই ঘটনারও সাক্ষী হয়ে আছে গির্জাটি। 

    গির্জাটির সঙ্গে জুড়ে রয়েছে ক্রাইস্ট চার্চ স্কুল। দমদমে অবস্থিত সেই স্কুলটিরও ইতিহাস নেহাত কম নয়। 

    গির্জাটির সামনে একটি স্বল্পকায় খাবারের দোকান। সেখানে বসে গির্জাটির কথা কেবলি ভাবার চেষ্টা করছিলাম। যতই রংচঙে হোক গির্জার শরীর, এর ইতিহাস, একসময়ের রৈরৈ কাণ্ডগুলো আমরা ভুলেই গিয়েছি। শুধু ইমারৎ বাঁচিয়ে তো আর ইতিহাস বাঁচানো যায় না আসলে। সেই প্রতিস্পর্ধাকেও ধারণ করতে হয়। অবশ্য প্রতিস্পর্ধার ধারণা তো স্থান-কালের নিরিখে বদলায়। তার পথ অসরল জটিল। ঔপনিবেশিক প্রভুদের ধর্মও তাই কখনো হয়ে উঠতে পারে অধীনদের প্রতিস্পর্ধার অস্ত্র। ইতিহাস ভারি মজার এক ব্যাপার। সেই সাবেক কলকাতাটার মতোই।

    তথ্যসূত্র: রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ, শিবনাথ শাস্ত্রী; আশার ছলনে ভুলি, গোলাম মুরশিদ

    Tags:

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @