হিমাচলের চাঁদ হ্রদ

হিমাচলের লাহুল-স্পিতি বেড়ানোর পরিকল্পনা আমাদের অনেকদিনের। এই বেড়ানোর আমাদের প্রধান আকর্ষণ চন্দ্রতাল -চাঁদের হ্রদ। ১৪ হাজার ফুট উঁচুতে হিমালয়ের কোলে চন্দ্রতালে পৌঁছাতে হয় কুনজুম পাস পেরিয়ে। জুন থেকে সেপ্টেম্বরই এই পথের সময়। মানালি থেকে আসতে হলে পেরোতে হয় আরেক পাস-রোটাং। অন্য সময়ে সেই পথও অনিশ্চিত। সময় ও সুযোগ মেলাতেই আমাদের কেটে গেছে বেশ ক’বছর, অবশেষে ঠিক হল ২০১৬-র সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি রওনা হব লাহুল-স্পিতির পথে। একটা আশংকা থেকেই গেছিল-ভ্রমণসূচী অনুযায়ী স্পিতির অন্য জায়গা ঘুরে চন্দ্রতাল পৌঁছাতে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ হবে - কুনজুম পাস খোলা পাব ত’? আর চন্দ্রতালে রাত্রিবাসের আশা না করাই ভালো, শুনেছি অক্টোবরের শুরুতেই চন্দ্রতালের পাশের তাঁবুগুলো উঠে যায়। ঠিক হল কুনজুম পাসের ১৮ কিলোমিটার আগে লোসার গ্রামে হবে আমাদের রাত্রিবাস, তারপর ভাগ্য সহায় থাকলে কুনজুম পাস পেরিয়ে চন্দ্রতাল, সেখান থেকে সেদিনই মানালি। লোসার থেকে চন্দ্রতালের দূরত্ব প্রায় ৪০ কিলোমিটার।
চন্দ্রতাল যাওয়া যায় দু’দিক থেকে। মানালি থেকে বাতাল হয়ে গাড়ি চলার পথ গিয়েছে, এ পথের দূরত্ব ১৪০ কিলোমিটার। তবে আগেই বলে রাখি গাড়ি চলার পথ যে কি তা আক্ষরিক অর্থে হাড়ে হাড়ে টের পাবেন। এই পথে কুনজুম পাস পেরোতে হয় না। আরেক পথ কিন্নর হয়ে স্পিতির নাকো, টাবো, কাজা হয়ে লোসার। সেখান থেকে কুনজুম পাস পেরিয়ে চন্দ্রতাল। আমার মতে এই পথ দিয়ে যাত্রা শুরু করে মানালিতে শেষ করা ভালো, এতে উচ্চতার সাথে খাপ খাওয়ানো সহজ। চন্দ্রতাল ট্রেকিংও খুব জনপ্রিয়। বাতাল থেকে পায়ে হাঁটা পথ গিয়েছে চন্দ্রতাল, দূরত্ব ১৪ কিলোমিটার। আরেকটা পথ গিয়েছে কুনজুম পাস থেকে। অনেকে মোটরবাইকেও আসেন এই পথে। তবে এসব অভিযান করতে হলে অবশ্যই থাকতে হবে লেকের পাশে। মনে রাখতে হবে লেকের ধারে রাতের তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচেও নেমে যায়। আর লোসারে Nomad’s Cottage-এর বুকিং অন-লাইন করা যেতে পারে। আরেকটা কথাও মনে রাখতে হবে – লোসার, চন্দ্রতাল-দুই জায়গাতেই উচ্চতাজনিত অসুস্থতা হতে পারে।

কাজা থেকে লোসারের দূরত্ব ৫৬ কিলোমিটার। সারা পথেই সঙ্গী হয়েছে স্পিতি নদী, আর একদিকে হিমালয়ের রুক্ষ পাথরে অপূর্ব কারুকার্য - মনে হয় কোন শিল্পীর নিপুণ তুলির ছোঁয়ায় যেন আঁকা। কাজা থেকে পথ যত এগোচ্ছে, ততই সে হয়েছে রুক্ষ, পাথুরে। স্পিতির শেষপ্রান্তে ভারত-চীন সীমান্তের শেষ গ্রাম লোসার – স্পিতির শীতলতম গ্রাম। লোসারের উচ্চতা ১৩,৪০০ ফুট। শীতল মরুভূমির রুক্ষ রূপের পর চোখ জুড়িয়ে যায় লোসারে এসে - সবুজ ঘাস, ফসলের ক্ষেত, পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে স্পিতি নদী। ছোট্ট গ্রাম লোসার - দূরে দূরে হাতে গোনা কয়েকটা বাড়ি, সব বাড়ি স্পিতির বিশেষ ধাঁচে মাটির তৈরি, সাদা রং, উপরে উড়ছে বৌদ্ধধর্মের পতাকা। আবহাওয়ার প্রতিকূলতার জন্যই বোধহয় জনবসতি একেবারেই কম, মাত্র ১৪২ জন লোকের বাস এখানে। চাষ আর চমরী গাই - এই দুই এদের জীবিকা। গরুর মত ঘুরে বেড়াচ্ছে চমরীগাইর দল। আমাদের কোন কোন সঙ্গী কাজা থেকেই আপত্তি জানাচ্ছিলেন লোসারে রাত্রিবাসের পরিকল্পনায়, এখানে কোন চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই, পাসের এত কাছে এই উচ্চতায় কেউ অসুস্থ হলে কাজাতে ফিরতে হবে, এই পথে রাতে ফেরা অসম্ভব। সব যুক্তি প্রায় গোঁয়ারের মতই অগ্রাহ্য করে এখানে এসেছি। কিন্তু যদি না আসতাম, কি যে হারাতাম। এ এক স্বর্গরাজ্য যার অপার্থিব শান্ত নিস্তব্ধতা ভুলিয়ে দেয় সবকিছু। আমাদের থাকার জায়গা ‘Nomad’s Cottage’ - এই বাড়িটিও স্পিতির বিশেষ ধাঁচে তৈরি, এখানে থাকার অভিজ্ঞতাও অসাধারণ, স্পিতির বাসিন্দারা যেভাবে থাকেন ঠিক সেই রকম সব ব্যবস্থা। এত দুর্গম জায়গায় যতটা আরাম দেওয়া সম্ভব তা এরা দেয়, বাকিটা পুষিয়ে দেয় আতিথেয়তা দিয়ে। লোসারকে উপভোগ করতে হলে অবশ্যই থাকতে হবে Nomad’s Cottage-এ।

পরদিন ভোরে যাত্রা শুরু হল কুনজুম পাস পেরিয়ে চন্দ্রতালের উদ্দেশে। কুনজুম পাস শুনেছি বিপদজনকতার দিক দিয়ে বেশ এগিয়ে– তার মতিগতি আগের থেকে কিছুই বোঝা যায় না। কিন্তু আমাদের প্রতি কুনজুম মাতার বোধহয় করুণাই হয়েছে, কোন বিঘ্ন তিনি ঘটাননি। ১৫০০০ ফুট উঁচু কুনজুম পাস থেকে দেখা যায় বড়াসিগ্রি – পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম হিমবাহ। চারধারে তুষারশুভ্র পাহাড়ের চূড়া, উপর থেকে দেখা যাচ্ছে স্পিতি উপত্যকা – এ দৃশ্য বর্ণনা করার ভাষা আমার নেই। পাসের উপর কুনজুম মাতার মন্দির। কনকনে তীব্র ঠাণ্ডা হাওয়ার বেশীক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যায় না, উঠে পড়লাম গাড়িতে, আজ আমাদের অনেক লম্বা যাত্রা। কুনজুম পাস স্পিতি ও লাহুলকে ভাগ করেছে, পথ গিয়েছে বাতাল, গ্রামফু হয়ে মানালির দিকে, গ্রামফু থেকে আরেক দিকে পথ গিয়েছে লাডাকের দিকে। আমরা বাতাল পৌঁছানোর আগেই এক রাস্তা ধরলাম, দু কিলোমিটার গিয়ে গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ল। এখান থেকে এক কিলোমিটার হেঁটে পৌঁছাতে হবে তালে, তালের পরিবেশ রক্ষার জন্য এর পর আর কোন যানবাহন যায় না। এখনো আছে কিছু তাঁবু, তবে সবাই গোটানোর আয়োজন করছে। কিছুটা এগিয়েই চোখে পড়ল নীল জল - হ্রদের আকৃতির জন্য এর নাম হয়েছে চন্দ্রতাল – চাঁদহ্রদ, এখান থেকে উৎপত্তি হয়েছে চন্দ্র নদীর, যা পরে ভাগার সাথে মিশে হয়েছে চন্দ্রভাগা। নীল জলে পড়েছে সাদা পাহাড়ের ছায়া। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম হ্রদের পাশের পথ দিয়ে আর কল্পনায় ভিড় করে এল সেই সব দিনের কথা, যখন চীন থেকে রেশম পথ দিয়ে ব্যবসায়ীরা এসে বিশ্রাম নিত এখানে। হিমালয়কে যত দেখি তত অবাক হই। এর অপার সৌন্দর্যেরও শেষ নেই,শেষ নেই এর রহস্য-রোমাঞ্চের। হ্রদের পাশে রাত কাটানো হল না ঠিকই, কিন্তু যা দেখলাম, যা পেলাম-তাই বা কম কি?
