কলকাতার সবচেয়ে পুরোনো রাস্তার গল্প

‘কলকাতা’ এবং ‘ক্যালকাটা’ নামের উৎস নিয়ে বিতর্ক রয়েছে অনেক। তবে গবেষকরা বলেন, ‘কালীঘাট’-এর সঙ্গে নামটির কোনও যোগ নেই। বেশিরভাগ পণ্ডিতই একমত যে ‘খাল’ এবং ‘কাটা’ – দুটি শব্দের বিকৃতি ঘটে এমন নাম এসেছে। গোবিন্দপুর এবং কলিকাতা গ্রামের মাঝখানে বয়ে যাওয়া এক প্রাকৃতিক খালই নামটির উৎস।
চিত্রেশ্বরী মন্দির
তবে এসব নিয়ে আলোচনায় যাব না আজকে। জানব তিলোত্তমার সবচেয়ে পুরোনো রাস্তার ইতিহাস। চিৎপুর রোড ((এখনকার রবীন্দ্র সরণি) চালু ছিল মুঘল আমলেও। মনে করা হয়, চিত্রেশ্বরী কালীর থেকেই রাস্তার এমন নাম। চার্নক আসার অনেক আগে কালীঘাটের মতোই বিখ্যাত ছিল চিত্রেশ্বরী (কেউ কেউ ‘চিত্তেশ্বরী’-ও বলেন) দেবীর মন্দির। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন (বা অর্থসাহায্য করতেন) মুঘল যুগের নাম করা ডাকাত চিত্রেশ্বর বা ‘চিতে ডাকাত’। বাংলার নানা প্রান্ত থেকে মন্দিরে পুজো দিতে আসতেন ভক্তরা।
আরও পড়ুন: ঘাটের কথা – পুরোনো কলকাতার জীবন্ত ইতিহাস
ক্যালকাটা রিভিউ (Vol. 3, 1845) থেকে জানা যায়, বাংলার নবাবি বাহিনীর এক সেনাপতি চক্রপাণি দত্তের রোষে পড়েন চিতে ডাকাত। ১৮ শতকের প্রথমার্ধে ঘটেছিল এই রোমাঞ্চকর ঘটনা। মন্দির যাওয়ার পথে দত্ত পরিবারকে আক্রমণ করে চিতে ডাকাতের দলবল।পুলিশের সাহায্য নিয়ে পরবর্তীকালে চিতে ডাকাতকে ধরে ফেলেন চক্রপাণি। একেবারে ফাঁসিতে ঝোলানোর ব্যবস্থা করেন। তারপর অযত্নে ভেঙে পড়তে থাকে চিত্রেশ্বরী মন্দির। অবশেষে মন্দির সংস্কারের দায়িত্ব নেন প্রথম ‘কালো জমিদার’ হিসেবে পরিচিত গোবিন্দরাম মিত্র। কলকাতা প্রেসিডেন্সির ডেপুটি কালেক্টারের পদে ছিলেন তিনি। প্রচুর অর্থ এবং প্রতিপত্তি অর্জন করেন কুমোরটুলির মিত্র বংশের এই পূর্বপুরুষ।
মদনমোহন মন্দির
চিৎপুর রোডের কথায় আসা যাক। ১৮২১ সালের ১২ জুলাই সমাচার দর্পণের সম্পাদকীয়তে উল্লেখ রয়েছে এই রাস্তার। বলা আছে, কলিকাতার জনসংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। স্থানীয় লোকেরা তখনও বাঘ নিয়ে আলোচনা করছেন। চিৎপুর অঞ্চলে বাঘ ঘুরে বেড়াত অল্প কিছু সময় আগেই। হিংস্র জন্তু-জানোয়ারে ভর্তি গভীর অরণ্যের মাঝখানে চিৎপুর রোড দিয়েই নবাবি রাজধানী মুর্শিদাবাদের সঙ্গে সুতানুটি, গোবিন্দপুর, কলিকাতা গ্রাম এবং কালীঘাটের প্রধান সংযোগ ছিল। বাগবাজার খাল থেকে বাগবাজার স্ট্রিট পর্যন্ত ছিল রাস্তার প্রথম অংশ। বাগবাজার স্ট্রিট থেকে মেছুয়াবাজার স্ট্রিট অবধি আপার চিৎপুর রোড। লোয়ার চিৎপুর রোড চলে গিয়েছিল বৌবাজার স্ট্রিট এবং লালবাজার স্ট্রিট পর্যন্ত।
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি
চিৎপুর রোড মন্দিরের জন্য বিখ্যাত। যেমন সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির এবং মদনমোহন মন্দির। ধর্মের বাইরেও পরিচিতি রয়েছে পথটির। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা ১৭৫৬ সালে কলকাতা আক্রমণ করলে সেনাপতি মির জাফরের সঙ্গে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অফিসার জন হলওয়েলের সংঘর্ষ যেখানে হয়, সেই ‘বারুদখানা’-র স্মৃতি এখনও লোকের মনে জ্বলজ্বল করে।
চিৎপুর সেতু
এখানেই ছিল ‘পেরিং সাহেবের বাগান’। ক্যাপটেন পেরিন ছিলেন প্রচুর জাহাজের মালিক। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তারা বাড়ির মহিলাদের নিয়ে তাঁর বাগানে ঘুরতে আসতেন। ব্রিটিশরা সুতানুটি ছেড়ে বিদায় নিলে দেখাশোনার অভাবে বাগান নষ্ট হয়ে যেতে থাকে। ১৭৫২ নাগাদ একেবারে বন্ধ হয়ে যায়।
নাখোদা মসজিদ
আদি ব্রাহ্ম সমাজের মতো প্রতিষ্ঠান, জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির মতো বনেদি পরিবার – চিৎপুর রোডের ইতিহাসে গৌরবের অভাব নেই। বিনোদনের আয়োজন অফুরন্ত – ঐতিহ্যবাহী থিয়েটার, জনপ্রিয় রেস্তোরাঁ, একের পর এক মদের দোকান, এমনকি গণিকালয়ও রয়েছে। আবার এই রাস্তা দিয়েই যদুনাথ মল্লিকের বাড়ি যেতেন রামকৃষ্ণ পরমহংস। এখানেই কলকাতার সবচেয়ে বড়ো মসজিদ নাখোদা।
নানা বিপরীতের সমাহার, বিচিত্র সংস্কৃতির মিশ্রণ – সব মিলিয়ে চিৎপুর রোড যেন গোটা কলকাতা শহরের এক ছোটো সংস্করণ।