‘ছোটোদের বায়স্কোপ’ : কচিকাঁচাদের সিনেমা দেখা ও বানানোর অবাক পৃথিবী

‘ছোটোদের বায়স্কোপ’, নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে কচিকাঁচারা এবং সিনেমা; ছোটো ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য হাতে কলমে সিনেমা বানানোর প্রাথমিক শিক্ষা ও কর্মশালা। এবং সিনেমা যে শুধু বড়োদের, প্রথাগত বোদ্ধাদের একচেটিয়া সম্পত্তি নয়, ইতিমধ্যেই তার যথাসাধ্য প্রমাণ দিয়েছে খুদেরা। পড়াশোনা থেকে খেলাধূলা, নার্সারির খুদে থেকে শুরু করে সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীদের জীবনই এখন মোবাইল, কম্পিউটার, ইন্টারনেটময়। দিনবদলের ধারায়, অতিমারির প্রকোপে তা আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। এই দিনবদলের ধারাকে সম্ভাবনাময় করে তোলারই একটি অভিনব প্রচেষ্টা ‘ছোটোদের বায়স্কোপ’। বারাসাতের ‘চারুকলা আর্ট-এন-এডু ট্রাস্ট’ বিগত কয়েক বছর ধরে এই ‘নিভৃত বিপ্লব’টি ঘটিয়ে চলেছে। ‘নিভৃত বিপ্লব’ উপমাটা এক্ষেত্রে কেন ব্যবহার করলাম? বলছি।
সিনেমা বানাতেই হবে এরকম কোনও ভাবনা চিন্তা থেকে নয়, অন্যরকম কিছু—থিয়েটার ওয়ার্কশপ, খেলাধূলা, সারা বিশ্বের সিনেমা, ক্যামেরার সঙ্গে ছোটোদের পরিচয় করানো, মূলত এইধরণের ভাবনা থেকেই ২০১৬-তে ছোটো পরিসরে এই কর্মশালার শুরু। এই ভাবনার মূলে রয়েছেন বারাসাতের ‘এক্সপেরিমেন্টাল’ তথ্যচিত্র নির্মাতা শংকর কর্মকার। এই সুযোগে তাঁকে নিয়ে দু-চারটে কথা বলে নেওয়া যাক। ‘ডন টু ডাস্ক’, ‘দে আর নট আওয়ার্স’, ‘অন্য আলো অন্য আঁধার’, ‘পোড়া মাটি মুখ’, ‘সা রে গা মা পা’, ‘কেঁদুলি কড়চা’...আটের দশকের শেষ দিক থেকে একের পর এক ‘অন্যরকম’ তথ্যচিত্র, ছোটোছবি নির্মান করে চমকে দিয়েছিলেন মফস্বল শহরের শংকর কর্মকার। সকলে তাঁর কথা জানেন না, তাঁকে চেনেন না, অথচ কবি বিনয় মজুমদারকে নিয়ে তাঁর ‘অন্য আলো অন্য আঁধার’ সহ অন্যান্য ছবিগুলি চলচ্চিত্রের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। শুধু সিনেমা নয়, নিজের ভাষায় ছবি আঁকতেও তিনি ভালোবাসতেন। ছোটোদের মনে নতুন স্বপ্ন গেঁথে দিয়ে ২০১৯-এ চলে গিয়েছেন তিনি।
শংকরবাবুর ভাবনাকে আকার দিতে শুরু থেকেই তাঁর সঙ্গ দিয়েছেন কবি-চলচ্চিত্র সম্পাদক, ছোটদের বায়স্কোপের অন্যতম স্তম্ভ কৌশিক চক্রবর্তী, বিশিষ্ট স্থিরচিত্রশিল্পী মৃদুল দাশগুপ্ত, চারুকলা আর্ট স্কুলের শিপ্রা পাল বেরা, ইন্দ্রজিৎ বেরা আরও অনেকেই। শংকরবাবুর মতো চলে গিয়েছেন মৃদুলবাবুও, তবে ছোটদের জন্য দিয়ে গিয়েছেন একটি প্রজেক্টর এবং অফুরাণ ভালোবাসা। আসলে, এই কর্মশালায় হর্তা-কর্তা-বিধাতা বলে কেউ নেই, এখানে সবাই সবার বন্ধু, সবাই ছাত্র, সবাই শিক্ষক...'লিবারাল' আবহাওয়া যাকে বলে।
ক্যামেরার অলি-গলি চিনে নিতে ব্যস্ত ছোটরা
কী হয় এই কর্মশালায়? ‘ব্রেড অ্যান্ড অ্যালি’, ‘কোরাস’, ‘রেড বেলুন’, ‘টু’, ‘প্রিন্সেস মনোনোকে’, ‘মাই নেবার টোটোরো’—কিয়ারোস্তামি, মিয়াজাকি, সত্যজিতের সিনেমা দেখে ১৩-১৪ বছর বয়সীদের সঙ্গে ক্লাস টু-থ্রিতে পড়া পুঁচকেরাও। একঘেয়েমি কাটাতে তার মাঝে মাঝে চলে থিয়েটার কর্মশালা, একসঙ্গে বসে শব্দ সাজিয়ে সাজিয়ে একটা গোটা গল্প তৈরির অনুশীলন, অডিও-ভিস্যুয়ালে গল্প বলা, ইত্যাদি। ছোটোরা সিনেমা বানাবে, শুরুর বছরগুলোয় এরকম কোনও লক্ষ্য স্থির করা ছিল না। ২০১৯ থেকে ঠিক হয় ওয়ার্কশপ শেষে প্রত্যেক শিক্ষার্থীই একটা করে সিনেমা বানাবে। হয়ও তাই। সেগুলির প্রদর্শনী করতে একদিনের চলচ্চিত্র উৎসবেরও আয়োজন করা হয়। ছোটোদের বানানো ছবি ছাড়াও সেখানে প্রদর্শিত হয় স্বনির্ভর ছবিওয়ালাদের বিভিন্ন কাজ। ছোটোদের উৎসাহিত করতে চলচ্চিত্র উৎসবে উপস্থিত থাকেন পরিচালক প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য, SRFTI-এর শিক্ষক শ্যামল কর্মকারের মতো শহরের বিভিন্ন চলচ্চিত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গুণীজনেরা। এ ছাড়াও ফটোগ্রাফি, সিনেমা, থিয়েটার, লেখালিখি করেন এরকম লোকজনও স্বেচ্ছায় যুক্ত রয়েছেন এই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে।
এরকম অনেক শিক্ষার্থী আছে যারা ক্লাস টু-থ্রিতে অংশগ্রহণ করেছিল, এখন তাদের ক্লাস ফাইভ-সিক্স এবং ইতিমধ্যেই বেশ পরিণত সিনেমা-বোধ তৈরি হয়েছে তাদের। আর একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, এই কর্মশালায় স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করছে বিশেষ ক্ষমতা সম্পন্ন বাচ্চারাও। কর্মশালার সদস্যদের কাছে জেনেছি, এরকম একটা ঘটনার কথা এখানে বলা দরকার।
ছবি দেখার মাঝে শট ডিভিশন ইত্যাদি বোঝানোর জন্য মাঝে মাঝে ‘পজ’ করতে হয়। সেভাবেই একবার একটি ছবি দেখাতে দেখাতে থামানো হয় এবং যে ছেলেটি এই কাজের দায়িত্বে ছিল, শুভায়ু তাকে সপাটে চড় মারে। শুভায়ু অটিস্টিক শিশুদের একজন। ছবি দেখাতে দেখাতে কেন বন্ধ করা হয়েছে, এই ছিল তার ‘চড়’ ওরফে প্রতিবাদের কারণ। শুভায়ু ক্লাসে একেবারে পিছনের দিকে বসে। আঁকতে খুব ভালোবাসে; কিয়ারোস্তামির ‘রেড বেলুন’-এর একটি দৃশ্য আঁকে—একটা বাচ্চা অনেক বেলুন সমেত উড়ে যাচ্ছে। ওর আঁকা সেই ছবির সঙ্গে রেড বেলুন ছবির কিছু দৃশ্যের কোলাজ করে একটা সিনেমাও বানানো হয়েছে। শুভায়ুদের মন যে কতটা সংবেদনশীল হয়, তা আমরা অনেকেই এখনো বুঝতে শিখিনি।
কোনও কোনও বাচ্চা তো ভীষণ রকম ‘ইন্টেলেকচুয়াল’। কেউ কিয়ারোস্তামির ‘কোরাস’-এর রিভিউ লিখে মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছে, কেউ ওয়ার্কশপ ছেড়ে সিকিমে বেড়াতে যাওয়ার দুঃখ ভুলতে বানিয়ে ফেলেছে ট্রাভেলগ—বাড়ি থেকে বাড়ি অব্দি, কেউ আবার সত্যজিতের ‘টু’ দেখে ধরিয়ে দিয়েছে ‘এটা তো ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রেক্ষিতে বানানো’। আখের রস, কমলালেবু, ছাপাখানা, জুতোর দোকান, রাস্তাঘাট, পুকুর, দিদার পুরোনো বাড়ি, মায়ের গতিবিধি…এইসব বিষয় নিয়ে হৈ হৈ করে অজান্তেই কিছু ‘এক্সপেরিমেন্টাল’ ছবি বানিয়ে ফেলেছে ছোটরা।
সেসব অভিজ্ঞতার কথাই বলছিলেন এই কর্মশালার অন্যতম শিক্ষক চন্দন বিশ্বাস। “অবশ্যই বড়োদের মতো টেকনিক্যাল বিষয়গুলো বাচ্চারা বুঝতে পারছে না, সেটাই স্বাভাবিক কিন্তু সিনেমা দেখে ওয়ার্কশপ করে ওদের যা যা মনে হচ্ছে ওরা বানাচ্ছে আর সেটা নতুন একটা ভাষা তৈরি করছে। ইউটিউবে সংরক্ষণ করা রয়েছে ছোটোদের বানানো স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবিগুলি; একটা তথ্যচিত্রের ভিতরেই পর পর সাজানো রয়েছে ১৪টি ছবি। আমি, কৌশিক দা এবং অন্যান্যরা মিলে ওদের পাশে থাকার চেষ্টা করছি। পুরো বিষয়টাকে একটা প্র্যাকটিসে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে কৌশিকদার বড়ো ভূমিকা রয়েছে। চারুকলার প্রত্যেকে, শিক্ষার্থী-অভিভাবক সকলেরই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে ‘ছোটোদের বায়স্কোপ’-এর নেপথ্যে। আর বিশেষ করে বলতে চাই, অটিস্টিক-শিশুদের কথা। ওদের সঙ্গে এত ঘনিষ্ঠতা এই প্রথম। অদ্ভুদ সুন্দর সব অভিজ্ঞতা হয়েছে ওদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে। পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে ব্যক্তিগত ‘হিলিং প্রসেস’। কিয়ারোস্তামি যে সহজ-সরল সিনেমার কথা বলেছেন, সেটা পাওয়া যাচ্ছে এখানকার শিক্ষার্থীদের মধ্যে।”
‘ছোটদের বায়স্কোপ’ তথ্যচিত্র
আমরা জানি, করোনা আবহে বড়দের সঙ্গে সঙ্গে ছোটোদেরও বিভিন্ন মানসিক চাপের মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে। কর্মশালার শিক্ষক কৌশিক চক্রবর্তীর কথায়, “অতিমারির কারণে ২০২০ থেকে এই কর্মশালা অনলাইনে শুরু হয়। ভার্চুয়াল কর্মশালায় স্বাভাবিক ভাবেই ছোটোদের মানিয়ে নিতে অসুবিধা হয়, ক্লাস করতে করতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে অনেকেই। আবার এও দেখা গেছে, কারো কারো ক্ষেত্রে মানসিক চাপ কমানোর নির্ভরযোগ্য প্রতিষেধক হয়ে উঠেছে এই ভার্চুয়াল কর্মশালাই। তাই, হাল না ছেড়ে, এভাবেই একটা কিছু করার চেষ্টা করছি সকলে মিলে।”
এসব দোলাচলের মধ্যেই ২৬ জুন থেকে অনলাইনে শুরু হয়েছে ‘ছোটোদের বায়স্কোপ’ কর্মশালা। এবার ষষ্ঠ বর্ষ। ২০২১-এর কর্মশালার নতুন সংযোজন- ‘ছোটোদের বায়স্কোপ’-এ এবার যোগ দিতে পারবেন বড়োরাও। কোনও বয়সসীমা নেই, বিভাগ আছে। ছোটোরা যা যা শিখবে, বড়োরাও তাই তাই শিখবে, ক্লাস হবে আলাদা আলাদা। সব মিলিয়ে স্বাধীন ব্যকরণে ‘ছোটোদের বায়স্কোপ’ তৈরি করছে সিনেমার নতুন ন্যারেটিভ। শুরুতে ‘নিভৃত বিপ্লব’ উপমাটা কেন ব্যবহার করেছিলাম বোঝা গেল কি?