চড়ক উৎসবের ইতিহাস নিয়ে রয়েছে ধন্দ

চড়ক বাংলার এক প্রধান লোকউৎসব। দুই বাংলাতেই চৈত্র মাসের শেষে অনুষ্ঠিত হয় চড়ক পুজো। চৈত্র মাসে শিবের ভক্তরা ভোলানাথের উপাসনা করে থাকেন। চড়ক কীভাবে শুরু হল, তা নিয়ে ধন্দ আছে। গ্রামীণ লোককথায় বলা হয়, পরম শিবভক্ত বাণরাজা যুদ্ধ করেছিলেন দ্বারকার অধিপতি তথা বিষ্ণুর অবতার কৃষ্ণের বিরুদ্ধে। যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত হওয়ার পর অমরত্ব পাওয়ার আশায় তিনি চৈত্র মাসের শেষ দিনে অনুচরদের নিয়ে নাচে গানে আত্মহারা হয়ে নিজের শরীরের রক্ত বের করে সমর্পণ করেন শিবের উদ্দেশ্যে। সেই ঘটনার স্মৃতিতেই প্রত্যেক বছর এই দিনে চড়ক উৎসব পালন করা হয়। গবেষকরা বলেন, পাশুপত সম্প্রদায় এই উৎসব পালন করত প্রাচীনকালে। সুন্দরানন্দ ঠাকুর নামের এক রাজা ১৫ শতকের শেষ দিকে এই পুজোর প্রচলন করেন, এমন মতও আছে। তবে চড়ক কোনোভাবেই রাজা-রাজড়াদের উৎসব নয়। মূলত হিন্দু সমাজের সাবঅল্টার্ন অংশের মানুষেরা এটি পালন করেন। চড়ক পুজোয় ব্রাহ্মণের কোনো ভূমিকা থাকে না।
গাজন উৎসবের অঙ্গ হল চড়ক। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে আছে শিবলোক প্রাপ্তির জন্য চৈত্র মাসে নৃত্য উৎসব পালনের কথা। রানি রঞ্জাবতী ধর্মঠাকুরকে সন্তুষ্ট করতে গাজন উদযাপন করেছিলেন, একথা বলা হয়েছে ধর্মমঙ্গলে। কেউ কেউ বলেন, বৌদ্ধ প্রভাব আছে গাজনে। মূলত এটি হিন্দুদের উৎসব, তবে মুসলমানের অংশগ্রহণও দেখা যায় কোনও কোনও জায়গায়। যেমন হাওড়া জেলায় পির জঙ্গল বিলাসের দরগায় হয়ে থাকে শিবের গাজন।
আরও পড়ুন
চড়ক ঘোরার আয়োজন হয় চড়ক ডাঙায়
চৈত্র মাসের প্রথম দিন ভক্তরা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। গ্রামে একজন মূল সন্ন্যাসী থাকেন, যিনি বাকিদের নেতৃত্ব দেন। এক মাস সন্ন্যাসীদের গেরুয়া বস্ত্র ধারণ করে হবিষ্যি গ্রহণের মতো কিছু নিয়ম পালন করতে হয়। তবে এখন নানা কারণে বহু জায়গায় নিয়মকানুন অতটা মানা হয় না। এক সপ্তাহ বা দু’তিন দিন সন্ন্যাস নেন অনেকে। কয়েকজন মিলে দল বেঁধে সন্ন্যাসীরা ভিক্ষা করতে বেরোন। দলে শিব এবং গৌরী সাজেন দু’জন। এছাড়া কখনও কখনও লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ, কালী – এঁদেরকেও দেখা যায়। থাকেন সখীরাও। সন্ধেবেলা ফিরে পাক করা অন্ন গ্রহণ করেন সবাই।
চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন পালিত হয় নীলষষ্ঠী। বাংলার গৃহিণীরা এদিন ব্রত পালন করেন। নীল বা নীলকণ্ঠ মহাদেবের আরেক নাম। নীলসন্ন্যাসী এবং শিব-দুর্গার সঙেরা নীলের মূর্তি সাজিয়ে গানবাজনা করতে করতে বাড়ি বাড়ি যান। গৃহস্থেরা তাঁদের ভিক্ষা দান করেন।
চৈত্র মাসে শেষ দিন অনুষ্ঠিত হয় চড়ক উৎসব। বৈশাখ মাসের প্রথম কয়েক দিনও উৎসব চলে কোথাও কোথাও। একটি বিশাল গাছের কাণ্ডকে ‘চড়ক গাছ’ বলা হয়। সারা বছর এটি জলে ডোবানো থাকে। চৈত্র সংক্রান্তির দিন ঢাকঢোল পিটিয়ে তোলা হয় এটিকে। কিছু জায়গায় তোলা হয় আগের দিন। চড়ক গাছ পুজো করে মাটিতে সোজা করে পুঁতে দেওয়া হয়। আগায় বাঁধা হয় কাঠ। গাছটি শিবের প্রতীক, আর পার্বতীর প্রতীক ভূমি। চড়ক শিব-পার্বতীর মিলনের উৎসব। জমির উর্বরতা বৃদ্ধির কামনা নিয়ে চাষিরা এই উৎসবে মাতেন।
আরও পড়ুন
শিবের গাজন হয় এই পিরের দরগায়
একটি জলভরা পাত্রে শিবলিঙ্গ রাখা হয়, যাকে সবাই বলে ‘বুড়ো শিব’। সন্ন্যাসীদের পিঠে বঁড়শি গেঁথে চড়ক গাছের কাঠের প্রান্তে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। এইভাবে সন্ন্যাসীরা পাক খেতে থাকেন শূন্যে। সেই অবস্থাতেই এক হাতে লাঠি ঘোরাতে থাকেন, অন্য হাতে সমবেত ভক্তদের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দেন বাতাসা, বেল, কাঁচা আম। শিশুদের মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করেন। অঞ্চল ভেদে নিয়মের কিছু পার্থক্যও আছে। চড়ক পুজোর আরও কিছু অঙ্গ হল কুমিরের পুজো, জ্বলন্ত অঙ্গারের ওপর হাঁটা, বাণফোঁড়া, কাঁটা আর ছুরির ওপর লাফানো ইত্যাদি। চড়ক পুজোর শেষে উপবাস ভাঙেন সন্ন্যাসীরা।
ব্রিটিশ সরকার আইন করে চরক পালন বন্ধ করে দিয়েছিল। তা সত্ত্বেও বাংলার নানা প্রান্তে এই উৎসব হয়ে থাকে এখনও। চড়ক পুজো উপলক্ষ্যে মেলাও বসে। তবে, এই বছর করোনা মহামারির কারণে সর্বত্র গাজন ও চড়ক উৎসব বন্ধ আছে।
তথ্যসূত্র – দেবদত্ত গুপ্ত, অনিরুদ্ধ সরকার, প্রসাদ মান্না।