বাংলার পুতুল-ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখছে চালচিত্র আকাদেমি

পশ্চিম মেদিনীপুরের নয়াগ্রামে একজন নবীন শিল্পী পটুয়াদের সঙ্গে কাজ করে ক্রমশ চিনতে শিখছেন শিল্পমাধ্যমের সরল রেখাগুলো। যে শিল্প শহর-কেন্দ্রিক নয়, সে সম্বন্ধে প্রগাঢ় হচ্ছে তাঁর দৃষ্টি। সালটা ২০০০। শিল্পী মৃণাল মণ্ডল। পটশিল্পীদের নিজেদের সহজিয়া জীবনযাপন আর শিল্পকর্মে মৃণালবাবু অনুভব করলেন এমন এক ঐতিহ্য, যা ইউরোপের ইতিহাসের পৃষ্ঠায় অনুপস্থিত। বিখ্যাত ফরাসি শিল্পী পল গঁগ্যা নিজর্ন তাহিতি দ্বীপে ক্যানভাসে আঁক কেটে যেরকম ছবি ফুটিয়ে তুলতেন, অনেক শতাব্দী আগেই এই বঙ্গদেশের এক জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের পটুয়ারা সেই ছবি এঁকে ফেলেছেন, সূচনা করেছেন সেই সংস্কৃতির। বাংলার শিল্পকর্ম, বা indigenous art-কে বোঝার জন্যে, প্রসার করার তাগিদে বন্ধু জয়তি ব্যানার্জির সঙ্গে মৃণালবাবু ২০১২ সালে নিজের সংস্থা শুরু করলেন। নাম – চালচিত্র আকাদেমি।
শিল্পচর্চার ওপর নির্ভর করে শহুরে যান্ত্রিকতা থেকে কিছুটা হলেও নিজেকে মুক্ত করা, এই মহৎ ধারণাটিকেই কেন্দ্র করে চলে সংস্থাটির কাজকর্ম। লোকশিল্পে নিহিত যে সরল, স্বাভাবিক অভিব্যক্তি আছে, সেই আঙ্গিকটি ভাবনায় রেখে চালচিত্র আকাদেমি নির্দিষ্ট পরিসরে কাজ করে। আকাদেমির অন্যতম পরিকল্পনা হল কর্মশালা আয়োজন করা, যেখানে শিল্পকর্ম বিষয়ক বিভিন্ন চিন্তাধারার আদান-প্রদান হয়। আলোচনা হয় মৌলিক কর্মপদ্ধতি নিয়ে।
গত ২৬ অগস্ট চালচিত্র আকাদেমি আয়োজন করল প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া মৃৎশিল্প আর পুতুল নিয়ে একটি কর্মশালা। ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে জনপ্রিয় হয় দু’রকমের পুতুল। কৃষ্ণনগর অঞ্চলের মাটির পুতুল আর মজিলপুরের পুতুল। সেই সময়ে বাংলায় বাবু সংস্কৃতির রমরমা। সেই সংস্কৃতিকে মূলে রেখেই তৈরি হওয়া শুরু করল বাবু পুতুল। বাবু পুতুলের কথা বেশি মানুষজন জানেন না। বাংলার বাবুদের স্বভাব, আচরণ, কৃত্রিমতাকে কটাক্ষ করে এই পুতুল তৈরি হত মজিলপুরে। এই পুতুলগুলোয় দেশজ ছাপ স্পষ্ট। বাবু পুতুলের ইতিহাস ২০০ বছরেরও বেশি প্রাচীন। যশোহর জেলার দত্ত-জমিদারদের সঙ্গে সেই পরিবারের পেয়াদা কালীচরণ দাস এ’পারে উত্তর চব্বিশ পরগণার অধুনা মজিলপুরে আসেন। জীবিকা নির্বাহের জন্যে জমিদারদের পেয়াদার কাজ করলেও, কালীচরণ দাস মনেপ্রাণে একজন উচ্চমানের মৃৎশিল্পী ছিলেন। নানারকমের পুতুল আর ঠাকুর গড়তেন তিনি। তাঁর শিল্পের ধারা আট পুরুষ ধরে প্রবাহিত হচ্ছে উত্তরপুরুষদের হাত ধরে। তাঁরই বর্তমান প্রজন্মের দুই কৃতি সন্তান মজিলপুর নিবাসী শম্ভু নাথ দাস আর গৌতম দাস পরিচালনা করেন ‘বাবু কালচার’ কর্মশালাটির। প্রসঙ্গত, শম্ভুনাথবাবুর পিতামহ শিল্পী মন্মথনাথ দাস নিজের কাজের জন্যে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন।
আরও পড়ুন
আবেদ চিত্রকর-দের আজকাল
নান্দীমুখ সংস্কৃতি কেন্দ্রে সকাল সাড়ে-নটা থেকে সূচনা হয় কর্মশালাটির। স্বনামধন্য শিল্পী থেকে সাধারণ মানুষ, কর্মশালায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন মোট ৩২জন শিল্প-উৎসাহী। মূলধারার শিল্পীদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন শ্রী প্রদীপ রক্ষিত, শ্রী চয়ন রায়, শ্রী সৌমেন খামারুই এবং শ্রী সমীর দত্ত। কর্মশালাটির অন্যতম অভিনবত্ব ছিল সবাইকে গাছ দিয়ে বরণ করা। অনুষ্ঠানে আলোচনা হয় বাবু পুতুলের নির্মাণ-শিল্পে কালীঘাটের পটের লক্ষণীয় প্রভাব সম্পর্কে। প্রধান আলোচক শ্রী দেবদত্ত গুপ্ত মহাশয় বাবু পুতুলের শিল্প-সংস্কৃতি নিয়ে অনেক অজানা তথ্যের সন্ধান দিলেন।
উল্লেখযোগ্য, মজিলপুরের শিল্পীরা কেবল বাবু পুতুলই নয়, তৈরি করেন বনবিনি, দক্ষিণ রায়ের মতো স্থানীয় দেবদেবী থেকে শুরু করে শিব, পার্বতী, গণেশ প্রভৃতি নানান রূপের পুতুল। হাতে গড়া পুতুলকে নিতান্তই সাধারণ সামগ্রী হিসেবে ধরার প্রবণতা আছে মানুষের। আসলে পুতুলের অর্থ আরও বেশি, সমাজের প্রতিবিম্বের একটি অংশ হল পুতুল।
অনুষ্ঠানের শেষ লগ্নে ছিল লোকগান। তিতাস ভ্রমর সেন এবং সায়ন সিনহা গানের মাধ্যমে কর্মশালাকে আরও রঙিন করে তোলেন। কর্মশালাটির সমাপ্তি ঘোষণা করেন সম্পাদক মৃণাল মণ্ডল।
বাংলার মৃৎশিল্পীরা, বিশেষত পট শিল্পে যাঁরা যুক্ত, তাঁরা ক্রমশ অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। আধুনিক যুগে প্লাস্টিকজাতীয় দ্রব্যের খেলনার দাপটে মাটির পুতুলের অস্তিত্ব সংকটে। পুতুল নির্মাণের শিল্পকে উজ্জিবীত করার প্রচেষ্টায় মৃণালবাবুর চালচিত্র এ্যাকাডেমির এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। ভবিষ্যতে আমরা যেন মাটির পুতুলে শুধু আমোদ নয়, আরও বেশি করে অনুভব করতে পারি মানুষের স্পন্দন, যা এক চিরকালীন ঐতিহ্যকে বহন করে।