No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    বাঙালো, মাছ খাইল, ভাঁড় ভাঙিল, পয়সা দিল না...

    বাঙালো, মাছ খাইল, ভাঁড় ভাঙিল, পয়সা দিল না...

    Story image

    প্রথমে ট্রেন, তারপরে ইস্টিমার, তারপরে আবার ট্রেন। সবশেষে কলকাতার শিয়ালদা স্টেশন।

    গিজগিজে লোকদের কাটিয়ে কাটিয়ে হাঁটি ছোটদির হাত ধরে। হাফ প্যান্টুল পরা ছোট্ট ছেলেটা অবাক হয়ে দেখে জনস্রোত। কত্ত লোক থাকে এখানে? দাদাকে “জিগাইবার সাহস” পায় না ছোটদি। অতএব, আমিও চুপ। স্টেশন থেকে বেরিয়ে আমাদের দাঁড়াতে বলে একটা ঘোড়াগাড়ি ডেকে আনল দাদা। মালপত্র ঘোড়ার গাড়ির ছাতে তুলে একটা দড়ি দিয়ে বেঁধে দেওয়া হল। আমাদেরকে নিয়ে আলোছায়া মাখা পথ ধরে লোকের ভিড়কে ঢুঁ মারতে মারতে এগিয়ে চলল এক্কাগাড়ি।

    গাড়ির সহিসের চাবুকটা আছড়ে আছড়ে পড়ছিল ঘোড়ার পিঠে। প্রতিটা চাবুক মারার হিস হিস শব্দ আমার চোখ দুটোকে বুজিয়ে দিচ্ছিল বারবার। ভয়ে আমি ছোটদিকে জড়িয়ে ধরছিলাম। ছোটদি বলছিল, “ডরাইস না, ডরাইস না। অখনই আমাগো বাসা আইয়্যা যাইব।”

    কলকাতার ট্রামলাইন, ট্রাম, বাস, ট্যাক্সি, কালো পিচগলা রাস্তা, ইলেকট্রিক লাইট, একঠেঙে হয়ে দু’হাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গ্যাসবাতির হিজিবিজির মধ্যে দিয়ে আমাদের ঘোড়ার গাড়ি একটা সরু গলির মধ্যে ঢুকে দাঁড়াল। তখন সন্ধে। মালপত্র নামানো হল। তারপর প্রায় অন্ধকার একটা সিঁড়ি বেয়ে একটা বাড়ির দোতলায় উঠে এলাম সবাই। একটা মাত্র ঘর। ঘরের তালা খুলতে খুলতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল দাদা। অথচ, অন্ধকার ঘুপচি-মতো সেই ঘরে আমার ভীষণ দমবন্ধ লাগছিল। আমি ছোটদির হাত চেপে ধরে বারবার ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছিলাম। ছোটদি আমার মাথার ধুলোভর্তি চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বলছিল—“দূর বোকা, এইডা ত দেশের বাড়ির মতো না। এইডা কইলকাত্তা শহর! শহরের বাড়িঘর অ্যাইরকমই হয়!”

    সকালে ঘুম থেকে উঠে কলকাতাকে ভালোভাবে দেখলাম। চারদিক দেয়ালের ফাঁক দিয়ে একচিলতে আকাশ। বারান্দায় লোহার রেলিং। নীচের তলায় কলের জল নেওয়ার জন্য বাড়ির বাসিন্দাদের ঠেলাঠেলি, চেঁচামেচি, ঝগড়া-ঝাটি। দোতলার তিনঘর ভাড়াটের জন্য একখানা পায়খানা। সেখানে ছোট বালতি ও মগ নিয়ে লোকের লাইন। একটাই বড় চৌবাচ্চা নীচে। উপচে পড়ছে জল। তাতে বালতি চুবিয়ে স্নানপর্ব সারার তাগিদে একদল লোকের ছোটাছুটি। জল কাড়াকাড়ি।

    মাঝারি বয়সের একটা ছেলে আমাদের দেখে নীচ থেকে হাঁক দেয়—“কী রে, কোত্থেকে এলি তোরা? বাঙাল?” আমি ফের ছোটদির মুখের দিকে তাকাই। ছোটদি বলল—“আমরা কাইল রাতে আইছি। চানপুর থিকা।” ছেলেটা বলে উঠল—“বুঝেছি, বুঝেছি। এ বাড়িতে আরেকঘর বাঙাল বাড়ল। ভালোই হল। তিনঘর মোহনবাগান, তিনঘর ইস্টবেঙ্গল! ড্র ম্যাচ। হিপ হিপ হুররে!”

    এই পাগলা শহরের কিছুই বুঝি না। সে রাতেই অবশ্য দাদা আমাকে, ছোটদিকে আর বৌদিকে ফুটবল খেলা কী, ঘটি-বাঙাল কাদের বলে, ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানই বা কী—ভালো করে বুঝিয়ে দিল। তারপর বৌদিকে বলল, “কাইল ইস্টবেঙ্গল- মোহনবাগানের খেলা। ইস্টবেঙ্গল যদি জেতে তবে ইলিশ কিইনা আনব। ভালো করে রাঁধবা কিন্তু।”

    পরের দিন রাতে দাদা যখন কাজ থেকে বাড়ি ফিরল, তখন তার মাথায় রক্তমাখা পেট্টি বাঁধা। ইস্টবেঙ্গল হেরেছে। গলির মোড়ে মারামারি। একটা ইঁটের টুকরো দাদার ইলিশ মাছ খাওয়ার বাসনা মিটিয়ে দিয়েছে। নীচের তলার সেই ছেলেটা তখন হেঁড়ে গলায় চেঁচিয়ে গান ধরেছে—“ বাঙালো/ মাছ খাইল/ ভাঁড় ভাঙিল/ পয়সা দিল না...”

    বৌদি দাদার মাথার ব্যান্ডেজটা খুলে একটু গরম জল, ডেটল দিয়ে রক্ত মুছিয়ে দিতে দিতে মৃদু অভিযোগের সুরে বলছিল—“তোমার অই বাঙাল-ঘটি লইয়্যা লাফালাফি করার কী আছিল? ফুটবলের ফু কাকে বলে, তাও তো বোঝো না!”

    মাথা ফাটিয়েও দাদার উত্তেজনা কমেনি-- “ভাইব্যো না, নেক্সটবার মোহনবাগান চার গোলে হারব। দেইখ্যা নিও।” বৌদি ভেংচি কেটে বলে, “হ, সেই আশায় বইস্যা থাকো! কাম-কাজ না থাইকলে আটাটা এট্টু মাইখ্যা দাও তো দেখি। কয়ডা রুটি বানাইয়্যা ফেলি। ও ঘরের গীতার মা কইসে, রাতে রুটি খাইলে সকালের হাগা ভালো হয়!”

    বৌদি রুটির কথা বলতেই আমার আর ছোটদির মনটা আহ্লাদে নেচে ওঠে। দেশে থাকতে আমরা তিন-চারবার শুধু ভাতই খেতাম। রুটি কী, গম কী, আটা কী, ময়দা কাকে বলে—কিছুই চিনতাম না তখন। শুধু বাবার গুরুদেব এলে মা তাঁকে লুচি করে দিতেন। তখন সে লুচির দু’এক টুকরো আমাদের ভাগ্যেও জুটলে তো আনন্দে আত্মহারা। এখানে এসে আমরা রেশনে গম আনতে দেখতাম দাদাকে। বৌদি সেই গম ভেজে দিত। কী ভালোই না লাগত খেতে আমাদের। তাছাড়া যেদিন রুটি হত, আমাদের আনন্দ দেখে কে? রুটিকে এমন মহার্ঘ খাদ্য কেন মনে হত, বয়স বাড়া ইস্তক তার কোনও যুক্তিগ্রাহ্য জবাব খুঁজে পাইনি। হয়ত ছোটবয়সের নানা ভালোলাগার ধর্মই এমনই-- অযৌক্তিক।

    কয়েকদিনের মধ্যেই আমাদের কর্পোরেশন প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হল। দুজনেই এক ক্লাসে পড়ি। সকালে উঠেই দুই ভাইবোন খাতা-পেন্সিল হাতে করে স্কুল রওনা দিতাম। স্কুল ব্যাগ ছিল না আমাদের। 

    দেশের বাড়িতে সকালে আমরা পান্তাভাত খেতাম। কলকাতায় পান্তা কেউ খায় না। এখানে লোক সকালে যা খায়, তাকে টিফিন বলে। এই টিফিনের ওপরও আমাদের ভারি লোভ। অথচ, আমাদের জন্য টিফিনের কোনও বন্দোবস্ত ছিল না। স্কুলের ছেলেরা স্কুলের উল্টোদিকের দোকান থেকে ফুলুরি-টুলুরি কিনে খায়। আমাদের পয়সা নেই। দুই ভাইবোন জুলু জুলু করে ওদের খাওয়া দেখি। ওরা ফুলুরি, বেগুনির একটুকরো ছিঁড়ে নাকে শুঁকে আমাদের বেঞ্চের দিকে ছুঁড়ে দিত। ছোটদি তখন চোখের দৃষ্টি দিয়ে পারলে ওদের ভস্ম করে দিয়ে আমাকে টেনে অন্যদিকে নিয়ে যেত।

    বাবাকে পান্তা খেতে না পাওয়ার যাতনার কথা কীভাবে যেন জানিয়েছিলাম আমরা। কিছুদিন পরে বাবা একটা পোস্টকার্ডে বৌদিকে সকালবেলা আমাদের দুটি পান্তাভাত দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি লিখল। বাড়িতে এরপর যারাই আসত, বৌদি সবাইকে সেই চিঠি পড়ে শোনাত। তারপর সবাই মিলে হাসাহাসি করত খুব।

    আমরা ভাইবোন তখন বুঝতে শিখলাম, কলকাতায় পান্তাভাত খাওয়াটা কত লজ্জার ব্যাপার। তদ্দিনে অবশ্য আরেকটা কথাও বুঝে গেছি, অন্যদের টিফিনের দিকে তাকিয়ে থাকতে নেই। খিদে ও খাওয়ার লোভ লুকিয়ে রাখাই শিষ্টতা। এইসব শিক্ষা ছাড়া আমাদের আর ছিলই বা কী!

     

    (ক্রমশ...)

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @