চৈতন্যদেব, ধর্মমঙ্গলের বারবনিতা এবং মধ্যযুগের পিঠে

‘কলা বড়া মুগ সাউলি ক্ষীরমোন্না ক্ষীরপুলি
নানা পিঠা রান্ধে অবশেষে।’
চণ্ডীদেবীর আশীর্বাদ নিয়ে সর্বমঙ্গলাকে স্মরণ করে রাঁধতে বসেছেন খুল্লনা। সেই বহুবিধ রান্নার পদে রয়েছে নানান জাতের পিঠেও। ষোড়শ শতাব্দীর কাব্য ‘চণ্ডীমঙ্গলে’ এভাবেই মধ্যযুগীয় বাঙালির হাজারো খ্যাদ্যাভ্যাসের কথা বুনে দিয়েছেন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী। আর, সেই খাদ্যতালিকা উজ্জ্বল করে রয়েছে ক্ষীরপুলির মতো পিঠে।
পিঠের সঙ্গে বাঙালির সম্পর্ক আজকের নয়। সংস্কৃত ‘পিষ্টক’ ঠিক কবে বাঙালির উচ্চারণে সহজ পিঠেয় পরিণত হল, তা জানা নেই। কিন্তু, পিঠে সেই আদ্যিকাল থেকেই মজিয়ে রেখেছে বঙ্গবাসীকে। আর, বাঙালির এই পিঠেপ্রেমের কথাই ধরা আছে মধ্যযুগের একাধিক কাব্যে। কৃত্তিবাসী রামায়ণেও ‘পিষ্টকাদি’র উল্লেখ মেলে। কিন্তু, কৃত্তিবাসের রামায়ণের প্রকৃত পুঁথির প্রাচীনত্ব নিয়ে ধোয়াঁশা দীর্ঘদিনের। বিজয়গুপ্তের ‘মনসামঙ্গল’ নিয়ে অবশ্য সে তর্ক নেই। চন্ডীমঙ্গলের চাইতেও প্রাচীন কাব্য এই মনসামঙ্গল। রচনাকাল পনেরো শতাব্দীর শেষভাগ। সেখানেও দেখি মহানন্দে পিঠে তৈরির বর্ণনা—
মিষ্টান্ন অনেক রান্ধে নানাবিধ রস।
দুইতিন প্রকারের পিষ্টক পায়স।।
দুগ্ধে পিঠা ভালো মতো রান্ধে ততক্ষণ।
রন্ধন করিয়া হৈল হরষিত মন।।
একসময়ে বাঙালি মিষ্টি বলতে চিনত এইসব পিষ্টক থুড়ি পিঠেকেই। তখন কিন্তু পৌষসংক্রান্তির সঙ্গেই কেবলমাত্র সম্পর্ক ছিল না পিঠের। যে কোনো অনুষ্ঠানে, আচারে এমনকি বাসায় অতিথি এলেও পিঠে রাঁধতেন মহিলারা। ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গলেই’ যেমন ভবানন্দ মজুমদারের স্ত্রী পদ্মমুখী দেবী অন্নদার পুজো উপলক্ষে ব্রাহ্মণভোজনের জন্য রেঁধেছেন পিঠে—
‘অম্বল রাঁধিয়া রামা আরম্ভিলা পিঠা।।
বড়া হল আশিকা পিযুষী পুরি পুলি।’
কেউ প্রশ্ন জুড়তেই পারেন, মহিলারাই শুধু পিঠে রাঁধে কে বলল! কত পুরুষও তো দক্ষ রাঁধুনি হয়। সে ঠিকই। কিন্তু, পিঠের সঙ্গেও বাঙালি রমণীর সম্পর্কটি যেন বড়ো মধুর। সেই কারণেই হয়তো বাংলা কাব্যে বারবার পিঠে তৈরির অনুষঙ্গে জড়িয়ে যায় মহিলাদেরই নাম। সেই পিঠেরও যে কত বাহার, তার প্রমাণ মেলে ‘ময়মনসিংহ গীতিকায়’। চন্দ্রপুলি, রসাল, ক্ষীরপুলির গন্ধে মম করছে সেই গানের আকাশ।
‘নানা জাতি পিঠা করে গন্ধে আমোদিত।
চন্দ্রপুলি করে কন্যা চন্দ্রের আকিরত।।
চই চপরি পোয়া সুরস রসাল।
তা দিয়া সাজাইল কন্যা সুবর্ণের থাল।।
ক্ষীরপুলি করে কন্যা ক্ষীরেতে ভরিয়া।
রসাল করিল তায় চিনির ভাঁজ দিয়া।।’
ঘনরাম চক্রবর্তীর ‘ধর্মমঙ্গলে’ এক বারবনিতাও বড়ো যত্নে প্রস্তুত করছেন পিঠে। সারাদিনের শ্রমে দুধ জ্বাল দিয়ে বানিয়েছেন ক্ষীর। ছানা, ননীর পুর প্রবেশ করেছে সেইসব পিঠের গর্ভে। পিঠে তৈরির এমন বিস্তৃত বিবরণ সচরাচর মেলে না।
সঁঝাল বক্কাল কত মিছরি মিশাইয়া।
দুগ্ধ মারি ক্ষীর করি রাখে জুড়াইয়া।।
উড়ি চেলে গুঁড়ি কুটি সাজাইল পিঠা।
ক্ষীর খণ্ড ছানা ননী পুর দিয়া মিঠা।।
পিঠের সঙ্গে বাংলা কাব্যের এই মিষ্টি-মধুর সম্পর্কের মধ্যে জড়িয়ে আছেন চৈতন্যদেবও। নীলাচলে গেছেন গৌরচন্দ্র। তাঁর জন্য বহু পদ রান্না হয়েছে অদ্বৈত আচার্যের গৃহে। সেই পদের মধ্যে রয়েছে পিঠেও। বৃন্দাবন দাসের ‘চৈতন্যভাগবত’ এবং কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘চৈতন্যচরিতামৃত’— দুই গ্রন্থেই মেলে পিঠের এই উপস্থিতির কথা। পিঠের বর্ণনায় কৃষ্ণদাস কবিরাজের কলম অবশ্য বেশি রসিক—
“ক্ষীরপুলি নারিকেল পুলি আর পিষ্ট।।
কাঞ্জি বড়া দুগ্ধ চিড়া দুগ্ধ লকলকি।
আর যত পিঠা কৈল কহিতে না সকি।।’
বাংলার মধ্যযুগীয় সাহিত্যে এভাবেই জড়িয়ে আছে পিঠে। পিঠে যে বাংলার হেঁসেলের কতখানি অধিকারের বস্তু, তারই প্রমাণ যেন বোনা এইসব কাব্যে। সেই পরম্পরাই হয়তো বয়ে আসে বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’তে কিংবা ‘দুধপিঠের গাছে’। পিঠের সঙ্গে এমনই নিবিড় সম্পর্ক বাঙালির স্বাদের, চর্যার, জীবনের।
আর, কে না জানে— সাহিত্য স্বভাবতই জীবনমুখী।
তথ্যসূত্র: পিষ্টক বৈচিত্র, আলপনা ঘোষ, রোববার, প্রতিদিন