আন্দোলনের কাল হয়ে দাঁড়াল একটা ছোট্ট স্লোগান, পরে বুঝলেন কমিউনিস্ট উৎপল

উৎপল দত্তের জন্মের সময় বিশ্বব্যাপী এক ভয়ংকর বিক্ষুব্ধ ঝোড়ো হাওয়া বয়ে চলেছে। সারা বিশ্ব এবং বিশেষ করে পাক-ভারতীয় উপমহাদেশে তখন প্রতিদিনের পরিস্থিতি সম্পর্কে মন্তব্য করা কঠিন ছিল। বিশ শতকের প্রথম দশক থেকে বিশ্ব রাজনীতির পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যেতে থাকল অর্থনৈতিক অবস্থা, সামাজিক মূল্যবোধের প্যাটার্ন, এমনকি মানুষের অন্তর্লীন রাজনীতিও। উৎপল দত্তের বেড়ে ওঠা এই সময়ের ভেতর। ছোটো থেকেই তাই রাজনৈতিক টানাপোড়েন এবং সংঘাত তাঁকে খুব করে টেনেছে।
উৎপল দত্ত কেবলমাত্র একজন অভিনেতা, নির্দেশক বা লেখকই ছিলেন না, তাঁর রাজনীতির আদর্শ ছিল বামপন্থা ও মার্ক্সবাদ। কলেজ জীবনেই অভিনয় শুরু করেন উৎপল। ১৯৪৭ সালে নিকোলাই গোগলের ‘ডায়মন্ড কাটস ডায়মন্ড’ এবং মলিয়েরের ‘দ্য রোগারিজ অব স্ক্যাপা’ দিয়েই তার কলেজ জীবনের অভিনয় শুরু। নাটক দুটি প্রযোজনা করেছিল কলেজের ইংরেজি একাডেমি এবং পরিচালনায় অধ্যাপক ফাদার উইভার। ক্রমশ উৎপল ও কলেজের কয়েকজন সহপাঠী মিলে গড়ে তোলেন একটি নাট্যদল- ‘দ্য অ্যামেচার শেক্সপিয়ারিয়ান্স’। তাদের প্রথম উপস্থাপনা ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’ এবং ‘ম্যাকবেথ’ নাটকের নির্বাচিত অংশ।
রাজনৈতিক থিয়েটারের ইতিহাস শুরু হয় মূলত দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটকের মাধ্যমে। তখন উনিশ শতকের মধ্যভাগ। রামমোহন, বিদ্যাসাগর’রা এসে প্রগতিশীল সমাজব্যবস্থা তৈরি করতে চেয়েছিলেন। এরপর জাতীয়তাবাদী উন্মেষ পর্বে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, উমেশচন্দ্র গুপ্ত প্রমুখরা আসেন রাজনৈতিক নাটক নিয়ে। পরবর্তীকালে গিরিশ ঘোষ বা দ্বিজেন্দ্রলালবাবুরা, এমনকি রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত রচনা করেছিলেন রাজনৈতিক নাটক। এই তালিকার পর আসেন উৎপল দত্ত, সম্পূর্ণ অন্য মেজাজে। তাঁর ‘টিনের তলোয়ার’-এর ঝনঝনিতে বাংলা থিয়েটারের দর্শক এক জায়গায় চুপটি মেরে বসে থাকতে পারেননি। বিদেশি নাটক বিশেষত শেক্সপিয়ার থেকে অনুপ্রাণিত উৎপল বারবার বলতেন, “আমি শিল্পী নই। নাট্যকার বা অন্য যেকোনো আখ্যা লোকে আমায় দিতে পারে। তবে আমি মনে করি আমি একজন প্রপাগান্ডিস্ট। আর এটাই আমার মূল পরিচয়।”১৯৫০ সালে ‘বিদ্যাসাগর’ ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে তাঁর হাতেখড়ি। ‘মাইকেল মধুসূদন’ সিনেমায় নাম ভূমিকায় অভিনয় করে চরিত্রাভিনেতা হিসেবে নিজের আসন পাকা করে নেন। পরবর্তীকালে একের পর এক বাণিজ্যিক ছবিতে কাজ করেন। ‘হীরক রাজার দেশে’, ‘ভুবন সোম’, ‘গোলমাল’, ‘নরম গরম’, ‘সাহেব’ ইত্যাদি ছবিতে তাঁর অভিনয় আলাদা মাত্রা এনে দিয়েছিল। উৎপল দত্তের নাটকে সমাজব্যবস্থার পাশাপাশি উঠে এসেছে অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে জোরালো কণ্ঠস্বর।
এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে যাচ্ছে বিশিষ্ট রাজনৈতিক কর্মী এবং বিশ্লেষক সৃজন সেনের একটি কথা। আড্ডাচ্ছলে তিনি একবার জানিয়েছিলেন, উৎপল দত্তের সঙ্গে রাজনীতির যোগ কতটা এবং নকশাল আন্দোলনের অনালোচিত প্রেক্ষাপট।১৯৬৭ সাল, নকশাল বাড়ির কৃষক সংগ্রামের একটি ঐতিহাসিক অধ্যায়। এই ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের মধ্যে ব্যাপক ভাঙন দেখা দেয়। যাঁরা নকশাল বাড়ির কৃষকদের সমর্থন করেছিলেন, তাঁরা চলে গিয়েছিলেন একদিকে। বাড়ির কৃষকদের দায় এসে পড়েছিল তৎকালীন মন্ত্রিসভার দায়িত্বে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের উপরে। সেইসময় বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল একটি বিভাজনরেখা। নাট্য আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা উৎপল দত্ত ছিলেন এই কৃষক আন্দোলনের সপক্ষে। তাঁর উদ্যোগেই লিটল থিয়েটার গ্রুপের মঞ্চে নকশাল বাড়ির কৃষকদের সমর্থনে একটি উৎসবের আয়োজন করা হয়। উৎসবের শুরুর দিন উৎপল দত্ত, সৃজন সেনের মতো কিছু ব্যক্তিরা মঞ্চে হাজির ছিলেন।
মঞ্চ সাজানোর প্রস্তুতি চলছে। উৎপল দত্ত হঠাৎ ভেবে বসলেন, মাও সে তুঙের বিখ্যাত একটি উক্তি দিয়েই চারদিক সাজানো হবে। মাওয়ের উক্তিটি ছিল, “প্রতিটি কমিউনিস্টকে অবশ্যই এ সত্য বুঝতে হবে যে, বন্দুকের নল থেকে রাজনৈতিক ক্ষমতা বেরিয়ে আসে”। আয়োজিত সভায় ঠিক করা হল মঞ্চের পিছনে কালো কাপড়ে কাগজ কেটে সেখানে লেখা থাকবে ‘বন্দুকের নল থেকেই রাজনৈতিক ক্ষমতা বেরিয়ে আসে।’ কিন্তু লিখতে গিয়ে দেখা গেল লেখাটা অনেক বড়ো হওয়ার দরুন পোস্টারে এক লাইনে লেখা যাচ্ছে না। সবাই মিলে ভাবতে বসলেন, এখন উপায় কী!
হঠাৎ একসময় উৎপল দত্ত চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘ইউরেকা ইউরেকা’ বলে। উৎপলবাবুর মস্তিষ্কপ্রসূত ভাবনা থেকেই বেরিয়ে এল রাজনীতির একটি নতুন সুর, বলা ভালো শ্লোগান। তাঁর বুদ্ধিতেই লেখা হল ‘রাইফেলই ক্ষমতার উৎস।’ এই উক্তিই কালো কাপড়ের পিছনে লাগানো হল। সেকালের ছাত্রসমাজ এবং রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তিবর্গের মধ্যে তা নিয়ে রীতিমতো হইচই শুরু হয়ে গেল। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, কথাটির মধ্যে অর্ধেক সত্যি আছে। এর মর্মার্থ হল, যাদের হাতে বন্দুক অর্থাৎ সশস্ত্রবাহিনী থাকে তারাই ক্ষমতার নিয়ন্ত্রক। কিন্তু সেই ক্ষমতা হল রাজনীতির ক্ষমতা। রাইফেল তো গুন্ডাদের হাতেও থাকে, চোর ডাকাতদের হাতেও থাকে। এখন প্রশ্ন হল, এই রাইফেলকে কারা বা কোন রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। এই ছোট্ট একটা উক্তিই আন্দোলনের কাল হয়ে দাঁড়ায়। রাইফেলের চিন্তা করাটাই আন্দোলনের একটা বিষয় হয়ে দাঁড়ালো এবং মানুষকে ভুল পথে চালিত করল।১৯৬৭ সালের সেইদিনের কথা খুবই পরিচিতি লাভ করেছিল পরবর্তীকালে। এই বহুল ব্যবহৃত কথাটিই আমরা পরবর্তীকালে সাহিত্যের বিভিন্ন জায়গায় দেখতে পাব। রাইফেল বা বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস- পথেঘাটে দেওয়ালে এই উক্তি রীতিমতো ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল। এই ভুল বার্তার দায়িত্ব নিতে হয় ওই আন্দোলনকারীদেরই। উৎপল দত্ত যদিও পরবর্তীকালে আবার কমিউনিস্ট পার্টিতে ফিরে গিয়েছিলেন। নকশাল আন্দোলনও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্তিমিতপ্রায় হয়ে এসেছিল। আন্দোলনে নানান ভুলভ্রান্তি খুঁজে পাচ্ছিলেন অংশগ্রহণকারী কর্মীরাই। উৎপল দত্ত একজন স্বনামধন্য অভিনেতা, নাট্যকার এবং রাজনৈতিকভাবে সচেতন একজন মানুষ। এমন নানান ঘটনার ছবি ভেসে উঠবে উৎপলবাবুর সহকারী যোদ্ধা হিসাবে থাকা সৃজন সেনদের মতো ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে। স্মৃতিচারণায় তাঁরাও কি সেই ইতিহাসের কাছে ফিরে যান না! সেই উত্তাল আগুনধরা সময়ে! হয়তো যান, হয়তো কালের নিয়ম গ্রাস করে চশমার মোটা ফ্রেমে কিংবা কুঁচকে যাওয়া চামড়ায়।
আরও পড়ুন: উৎপল দত্তের পত্রিকা ‘এপিক থিয়েটার’
আজ উৎপল দত্তের বিরানব্বইতম জন্মদিন। এখনও কি আমাদের মনে হয় না, কোথায় হারিয়ে গেলেন উৎপল! তাঁর মতো রাজনীতি সচেতন মানুষ যে বড়োই প্রয়োজন এই সমাজে। তিনি একজন আদর্শ, তিনি শিক্ষক। আজকের ঘুণধরা সমাজে ধর্ম নিয়ে, জাত নিয়ে, বর্ণ নিয়ে রাজনীতির মরশুমে উৎপলরা একজন সাধারণ মানুষের মতোই বারবার ফিরে আসুক। এরকম বিক্ষুব্ধ সময়ে বন্ধু হওয়াটাই সবথেকে প্রয়োজন।