No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    শতবর্ষে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ : তরুণ কবির স্পর্ধা সেদিন ঝড় তুলেছিল

    শতবর্ষে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ : তরুণ কবির স্পর্ধা সেদিন ঝড় তুলেছিল

    Story image

    ত বছর থেকেই খানিক নীরবে পার হয়ে যাচ্ছে ‘বিদ্রোহী’ (Bidrohi) কবিতার শতবর্ষ। ১৯২১ সালে কবি-কলমে লেখা হচ্ছে এই কবিতা এবং ১৯২২ সালে প্রথম প্রকাশিত হচ্ছে। যে কবিতা লিখে একসময় যেমন জুটেছিল খ্যাতি আবার বিতর্কও পিছু ছাড়েনি নজরুলের। ‘বিদ্রোহী’ মানেই আমাদের সকলের ছোটোবেলা। পাঠ্যপুস্তক। শৈশবের রক্তে ঢুকে পড়তেন বিদ্রোহী নজরুল (Nazrul Islam) আর এক বাঙালি কবির জেদ। শৈশবের রক্তও গরম হতে থাকত। নজরুল লিখেছেন,

    “বল বীর –
    বল উন্নত মম শির!
    শির নেহারি আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!
    বল বীর –
    বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি
    চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি
    ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া
    খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া,
    উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর!
    মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!
    বল বীর –
    আমি চির উন্নত শির!”

    ১৯২১ সাল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের রেশ কাটেনি। নজরুলের ঘরের একদিকে মুজফ্ফরের নানারকম বই। বিভিন্ন সভায় যাচ্ছেন, বক্তৃতা দিচ্ছেন তিনি। আর নজরুল সেসব পর্যবেক্ষণ করছেন।

    ১৯২০ সালের আগের ঘটনা। নজরুল তখন সামরিক বিভাগে চাকরি করতেন। বেঙ্গল রেজিমেন্টে সেনা হিসেবে চাকরি করেছেন প্রায় আড়াই বছর। ১৯২০ সালের মার্চ মাসে ফিরে আসেন কলকাতা (Kolkata)। চাকরির পাশাপাশি চলে লেখালেখি। কখনও গান, কখনও কবিতা। বাসা বদল হয় প্রায়ই।  শেষমেশ তালতলা লেনের একটি বাড়িতে চলে যান। বন্ধু হিসেবে পেয়েছিলেন কমিউনিস্ট আন্দোলনের (Communist Movement) মুজফ্ফর আহমেদকে। দোতলা বাড়ির নিচের দক্ষিণ কোণের এক একফালি ঘরে জায়গা হবে নজরুলের। কেউ জানে না, এই কবিই একদিন হয়ে উঠবেন বাংলার শ্রেষ্ঠ। হয়ে উঠবেন বাংলা সাহিত্যের বিদ্রোহী কবি।

    শোনা যায়, সেদিন নাকি খুব বৃষ্টি পড়েছিল। ডিসেম্বরের কনকনে ঠান্ডা। ১৯২১ সাল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (First World War) রেশ কাটেনি। নজরুলের ঘরের একদিকে মুজফ্ফরের নানারকম বই। বিভিন্ন সভায় যাচ্ছেন, বক্তৃতা দিচ্ছেন তিনি। আর নজরুল সেসব পর্যবেক্ষণ করছেন। রাশিয়ার বিপ্লবে তখন ফুটছে লক্ষ লক্ষ বাঙালি রক্ত৷ নজরুলও বুঝি তাঁদেরই একজন! সেই ডিসেম্বরের রাতেই নজরুল লিখে ফেললেন একটি কবিতা, নাম দিলেন ‘বিদ্রোহী’। লিখলেন,

    “আমি ঝন্ঝা, আমি ঘূর্ণি,
    আমি পথ-সমূখে যাহা পাই যাই চূর্ণি।
    আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ,
    আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ।
    আমি হাম্বার, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল,
    আমি চল-চঞ্চল, ঠমকি ছমকি
    পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি
    ফিং দিয়া দিই তিন দোল;
    আমি চপলা-চপল হিন্দোল।
    আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা,
    করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা,
    আমি উন্মাদ, আমি ঝন্ঝা!
    আমি মহামারী আমি ভীতি এ ধরিত্রীর;
    আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ণ চির-অধীর!
    বল বীর –
    আমি চির উন্নত শির!”

    এক একটা আগুন ঝড়া লাইন লিখে চলেছেন তিনি। শোনা যায়, পরদিন সকালে বন্ধু মুজফ্ফরকে এটি পড়ে শুনিয়েছিলেন। শোনা যায়, দোয়াত-কলমে নয়, সেদিন পেনসিল দিয়েই লেখেন এই কবিতা। কিছুদিনের মধ্যেই অর্থাৎ ১৯২২ সালের জানুয়ারি মাসে ‘বিজলী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হল ‘বিদ্রোহী’। জনপ্রিয়তা বাড়ল। পাঠকের চাহিদায় ওই একই কবিতা ছাপা হল ‘প্রবাসী’ ও ‘সাধনা’-তেও। এই কবিতার জন্যই বিজলী পত্রিকার বিক্রি হু-হু করে বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু বিতর্কও পিছু ছাড়ল না।

    কেন লিখলেন নজরুল এমন কবিতা? তার আগে বাংলায় কোনো কবিতা এত সরাসরি প্রতিবাদ করেছে বলে জানা যায় না। ইংরেজদের অত্যাচার তো ছিলই। পাশাপাশি এই কবিতা আসলে ফ্যাসিবাদ-বিরোধী লেখা। সমাজে ঘটে চলা যাবতীয় অন্যায় অত্যাচার শোষণের বিরোধী এই কবিতা। সাহিত্য তো বটেই, রাজনীতির আদর্শকেও এক নিমেষে ঘুরিয়ে দিতে পারে ‘বিদ্রোহী’-র এক একটা লাইন। এর মধ্যে দিয়েই বাংলা পেল এক তেজি দামাল কবিকে, যিনি সাধারণ মানুষের হয়ে কথা বলবেন।

    এই কবিতা আসলে ফ্যাসিবাদ-বিরোধী লেখা। সমাজে ঘটে চলা যাবতীয় অন্যায় অত্যাচার শোষণের বিরোধী এই কবিতা। সাহিত্য তো বটেই, রাজনীতির আদর্শকেও এক নিমেষে ঘুরিয়ে দিতে পারে ‘বিদ্রোহী’-র এক একটা লাইন।

    এর কিছু মাস পরেই নজরুল দায়িত্ব নেবেন ‘ধূমকেতু’ (Dhumketu) পত্রিকা সম্পাদনার। যা হয়ে উঠবে তৎকালীন তরুণ বিপ্লবীদের মুখপত্র। আজও কি একজন তরুণ কবির চোখে এমন আগুন জ্বলে ওঠে? যে লেখায় নড়ে উঠবে রাজার সিংহাসন? রাজা ভয় পাবেন! আর দস্যি দামাল লেখাই হয়ে উঠবে নতুন যাত্রাপথ! এখনকার তরুণ কবির চোখে ‘বিদ্রোহী’ কতটা প্রাসঙ্গিক? কবি সঙ্ঘমিত্রা হালদারের মতে, “বিদ্রোহী কবিতাটা একটি বিশেষ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে লেখা হলেও তা দেশকাল ব্যতিরেকে সকল সময়ের। মূলত যুবসমাজের উদ্দেশে লেখা এই কবিতা আত্মশক্তি জাগরণের প্রতীক। নানারকম তঞ্চকতা আর দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে  নিজের অবস্থান চিনতে শেখায়। সম্পূর্ণ সংস্কারহীন হয়ে আত্মবোধে স্থিত থাকা যে একজন মুক্তিকামী মানুষ কিংবা একজন কবির কাজ, সেই কথা মনে করিয়ে দেয়। কবিতা মানুষের কোনও কাজে লাগে কিনা এই নিয়ে চিরকালীন দ্বন্দ্ব হয়তো থাকবে, কিন্তু এই কবিতার প্রয়োজন একশো বছর পেরিয়েও জেগে আছে। থাকবে।”

    উৎপীড়িত, নিপীড়িত মানুষের কান্না ভাবিয়েছিল নজরুলকে। আজ একশো বছর পরেও মনে হয় ঠিক যেন এই সময়ের কথা। কবিতাপাঠ তাই বারবার নতুন হয়ে ওঠে অধ্যাপক প্রিয়ব্রত ঘোষালের কাছে। তিনি বলেন, “কবিতাটিতে বিপরীতধর্মী দুটো ভাবনার প্রকাশ দেখা যায়। একদিকে নজরুল বলছেন, ‘আমি ভেঙে করি সব চুরমার’, অন্যদিকে তিনি ‘মুক্ত জীবনানন্দ’। ধ্বংস আর সৃষ্টিকে কবি এখানে পাশাপাশি রেখেছেন। নবসৃষ্টির মহানন্দেই তিনি যাবতীয় অন্যায়ের ধ্বংসে মত্ত। তাই ‘জাহান্নামের আগুনে’ বসে তিনি ‘পুষ্পের হাসি’ হাসতে পারেন। রণক্লান্ত হলেও এই ‘বিদ্রোহী’ উৎপীড়িত, নিপীড়িতের ক্রন্দনের অবসানেই হবেন শান্ত। ধ্বংস আর সৃষ্টির এই বৈপরীত্য যেমন চিরকালীন, তেমনই চিরস্মরণীয় অন্যায়ের প্রতিবাদে কবির প্রত্যয়।”

    এই একবিংশ শতাব্দীতে কোনো ‘মুসলমান’ কবি এমন কবিতা লিখলে হয়তো জেলবন্দি থাকতে হত তাঁকে৷ কিংবা তাঁর মাথার দাম চাইত রাষ্ট্র। অথবা দেশ থেকেই তাড়িয়ে দেওয়া হত সত্যি কথা বলার সাজায়। ভাগ্যিস একটা নজরুল জন্মেছিলেন। নাহলে নতুন আদর্শে একরাশ স্বপ্ন নিয়ে হাঁটাই দুষ্কর হয়ে যেত বাংলার, বাঙালির।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @