No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    মহানগরে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সাহেবদের ঠিকানা 

    মহানগরে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সাহেবদের ঠিকানা 

    Story image

    ‘Red brick walls
    Instant grey skies
    Stands with their head held high
    Reminds me of you

    The old postcards
    The fragrance of plumps
    Rusted kerosene lamps
    Reminds me of you...’

    অঞ্জন দত্তের গানেও গাঁথা এই শহরের এক আশ্চর্য ঠিকানার হদিশ। এমনিতেই এ’শহরের হাজারো গপ্প। হলদে পোস্টকার্ড, ধুলোটে কেরোসিন-ডিবেতে ফিকে-রঙা নস্টালজিয়া নিশ্বাস ফেলতে থাকে এখানে। কলকাতার অলিগলিতে হেঁটে বেড়ালে পায়েপায়ে কেবলই জড়িয়ে যায় অতীতের লতাপাতা। তাকে ছাড়ানো যায় না। সে থাকে, হয়তো সঙ্গে চলেও।

    এমনই একটি অতীত-ঢালা গলির সন্ধান মেলে হেয়ার স্ট্রিট  থেকে বউবাজার থানার মাঝামঝি। সেখানে সরু রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে কয়েকটি প্রকাণ্ড বাড়ি। লাল ইটের বুননি। প্রায় একশো বছর ধরে সেই আয়তাকার গলিপথকে যেন পাহারা দিচ্ছে। এটাই কলকাতার বো স্ট্রিট বা বো ব্যারাক। লন্ডনের সাবেকি রাস্তা ‘বো স্ট্রিটে’র  সঙ্গে এখানের লাল বাড়ি-ঘেরা রাস্তারও সাদৃশ্য খুঁজে পেতে পারেন উৎসাহীরা।  

    লন্ডনের সাবেকি রাস্তা ‘বো স্ট্রিটে’র  সঙ্গে এখানের লাল বাড়ি-ঘেরা রাস্তারও সাদৃশ্য খুঁজে পেতে পারেন উৎসাহীরা 

    এই কঠোর-কঠিন বাড়িগুলির ইতিহাস খানিক অদ্ভুত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীর বসবাসের জন্যে নাকি তৈরি হয়েছিল এই ইমারত। প্রথম পেরিয়ে ক্রমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধও সাঙ্গ হয়। দেশ ছাড়ে ব্রিটিশ। বাড়ি খালি করে বিদায় নেয় সৈনিকের দল। আর সেই গ্যারিসনের মেসে তখন উঠে আসে কলকাতা শহরের অ্যাংলো বাসিন্দারা। কলকাতার  ওইটুকু অঞ্চল জুড়ে আজও তারা বাঁচিয়ে রেখেছে নিজেদের সংস্কৃতি।

    অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। কলকাতার কালো চামড়ার সাহেব-মেম। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান শব্দবন্ধের মতো অদ্ভুত এদের ইতিহাসও। জিনের ভিতর অন্য জিন। এক ভূখণ্ডের সংস্কৃতির ভিতর অন্য ভূখণ্ডের সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ। অস্তিত্বের প্রহেলিকা অ্যাংলোদের তাড়িয়ে ফিরেছে বহুদিন থেকেই। গাত্রবর্ণে সাহেব তারা মোটে নয়, আবার সাধারণ বাঙালি কলকাতাবাসীও নয়। এই টানাপোড়েনই জন্ম দিয়েছে নিজেদের শিকড়-স্থাপনের চাহিদার। তাই, সাহেব-সেনাদের ছেড়ে যাওয়া ব্যারাকই যেন হয়ে উঠেছে কলোনি-উত্তর এই আশ্চর্য কলোনি।

    প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীর বসবাসের জন্যে নাকি তৈরি হয়েছিল এই ইমারত 

    একইসময়ে, কলকাতার আশেপাশে তৈরি হচ্ছিল আরও এক ধাঁচের কলোনি। সেও বাস্তুহারাদের, উদ্বাস্তুদের। বাঙালি নয়, বাঙাল। আর, কলকাতার এই ছোট্ট গলিপথে তখন নিজেদের জন্য বসত খুঁজছিলেন অ্যাংলোরা।  

    অবশ্য এই বসতের নাকি কোনো লিখিত দলিল নেই। তবু, নিজেদের সংস্কৃতির অধিকারে বাড়িগুলিতে রয়ে গেছে ১৩২টি অ্যাংলো পরিবার। পূর্বপুরুষের স্মৃতি আঁকড়ে। শহরের সাহেবি-সংস্কৃতির একমাত্র জীবিত উত্তরসূরি এরা।  

    শহর কলকাতার ইতিহাসের সঙ্গে সাহেবিয়ানার নিবিড় সম্পর্ক। আর পুরোনো কলকাতা আজও যাদের ভাবালুতায় ভোগায়, তাদের জন্য আদর্শ জায়গা এই বো ব্যারাক। অবশ্য ভরা গ্রীষ্মে না, ডিসেম্বরের নরম শীতে। তেলেনাপোতা আবিষ্কারের মতো বো ব্যারাকে যে-কেউ খুঁজে পেতে পারে শতাব্দী-প্রাচীন কলকাতা। যিশুর ‘ছলছল চোখে’ আশ্বাসবাণী তার সামনে থেকে তুলে দিতে পারে অতীতের কালো পর্দা। ক্রিস্টমাসে এ-অঞ্চলের উদযাপন দেখতে ভিড় জমায় বেবাক কলকাতা। কেক পেস্ট্রি ওয়াইনের গন্ধে হদিশ মেলে অতীত রূপকথার। একটুকরো বিলেতের খোঁজে ভিড় জমানো শহুরে মানুষেরা কিন্তু স্পষ্ট বুঝতে পারবেন, বো ব্যারাকের সাহেবিয়ানা আর পার্ক স্ট্রিটের সাহেবিয়ানায় পার্থক্য অনেকখানি। পার্ক স্ট্রিটের বৈভব, আলো, আভিজাত্য বো ব্যারাকের নেই। যা আছে, তাকে বুঝতে হলে কান পাততেই হবে এখানকার দেওয়ালে, রাস্তায়।

    বো ব্যারাক নিয়ে সিনেমা অঞ্জন দত্ত, দেখিয়েছিলেন বো ব্যারাকে বসবাসরত পরিবারগুলির অস্তিত্বের সংগ্রাম। ভিতরের কালচে দেওয়াল, ঘুপচি ঘরে আলোবাতাস খেলে না, দারিদ্র, ময়লা কোট-প্যান্ট। অনেকগুলো বছর পার করেও তবু অন্যত্র চলে যায়নি মানুষগুলো। থেকে গেছে।

    সরকারপক্ষ অবশ্য সে বাড়িগুলি নিতে চেয়েছে বারবার। তার বিনিময়ে পুনর্বাসন মিলতে পারে বাসিন্দাদের। কিন্তু বাসিন্দারা তাতে নারাজি। কারণ শুধু প্রাণধারণ করে তারা বেঁচে থাকে না। তারা ধারণ করে রেখেছে একটা সংস্কৃতিকে। তাই ওই লালবাড়িগুলিকে হেরিটেজ ঘোষণা করার দাবি জানিয়েছে তারা। এক্ষেত্রে এটাও ভেবে দেখার, যে কুঠুরিপ্রায় অবস্থার মধ্যে তারা থাকে, অনেকেই সেখানে পুনর্বাসনের সুযোগটি গ্রহণ করতেন। কিন্তু এরা তা করেননি। তাদের অস্তিত্ব কলকাতায় গভীর বিপন্নতার মুখে দাঁড়িয়ে। তাদের কমিউনিটি ফিলিং, একসঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকার মধ্যে এই লালবাড়িগুলির ভূমিকা গভীর। তা তাদের  কাছে জমির মতো, মাটির মতো। সেখান থেকে উঠে গেলে বহু মানুষের ভিড়ে তাদের পৃথক অস্তিত্বটি যাবে হারিয়ে। যে ‘সাহেবিয়ানা’র হুজুগ এখন গটা শহরজুড়ে চলে, তার বর্ণ আলাদা, বিত্ত সুপ্রচুর। বো ব্যারাকের থুত্থুরে, ফোকলা বুড়ি মার্গারেট, উদোম মদ খেয়ে গিটার হাতে মাঝরাতে গান-গেয়ে-চলা স্যাম সেই ঠিক সাহেবিয়ানার দলে পড়েন না। বরং কলকাতার সাধারণ মানুষের অনেক কাছের এই কালোসাহেব ও মেমরা।

    বো ব্যারাকে যে-কেউ খুঁজে পেতে পারে শতাব্দী-প্রাচীন কলকাতা

    এই শহর এমনিতে বহু পালাবদলের সাক্ষী। সেই পালাবদলের চক্করে অতীতস্মৃতিকে আমরা বারবারই হারিয়েছি। সেনেট হল ভাঙা হয়েছে সেই কবেই। মহাকরণের সামনে লালদিঘিকে দেখলে আজ আর মনেই পড়ে না, যে এই দিঘিই ছিল একসময় কলকাতার সাহেবসুবোদের জলের ভাণ্ডার। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আঁচে গড়ে ওঠা লালবাড়িগুলিও ভাঙনের মুখে দাঁড়িয়ে। অতীত গৌরবের হোক বা অগৌরবের। অতীতের থাকা প্রয়োজন। কলকাতা শহরের ওই বাড়িগুলি, তার মানুষগুলি সেই অতীতের চিহ্ন।

    আর, বো ব্যারাকের বেঁচে থাকা উচিত কলকাতাকেও বাঁচিয়ে রাখার জন্য। এ’শহরের ভিতরে আছে এমন অসংখ্য অলীক ঠিকানা। সংস্কৃতির কোলাজ। বা হয়তো এটাই এই শহরের প্রাণ। কলকাতার ঐতিহ্যের শরিক আরও কয়েকটা লালবাড়িতেও যা লুকিয়ে।  

    ছবিঃ তর্পিণী ভুঁইঞা

    Tags:

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @