বাঙালির ছবি তোলার নয়া যুগ

ধর্মতলার মোড়ে ঠিক যেখানে বর্তমান কটেজ ইন্ডাস্ট্রির বাড়িটি বাস রাস্তার উপরে শেষ হচ্ছে, ঠিক সেখানেই ১৪১ নং এস এন ব্যনার্জি রোডের উপর দাঁড়িয়ে থাকা কঙ্কালসার ইট বের করা বাড়ির উপরিতলে ভাঙা ভাঙা শব্দে পড়ে নেওয়া যায়, “photographe” শব্দটি । তার ঠিক নিচের তলায় পড়া যায় Bourne & Shepherd, এখন তাহলে প্রশ্ন হল তাহলে এই “photoghraphe” শব্দটির তাৎপর্য কি?
আসলে, জর্জ শেফার্ড এবং স্যামুয়েল বোর্ন ১৮৬৩ তে কলকাতার এই বাড়িতে যখন নিজেদের নামে স্টুডিও খুললেন, সেইসময় তাদের পার্টনারশিপ ব্যবসা হিসেবে সঙ্গে এসেছিলেন মিস্টার হাভাড। তার ছিল ওই Calcutta photographer নামের স্টুডিওটি।
Calcutta Photographer এর এই বাড়িটি নির্মাণ হয়েছিল কিছু আগে ১৮৪০। সেখানে এসে উঠলেন এই বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ড।
আজকে এই বাড়িটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অনেকটাই যেন টাইম মেশিনে এ চড়ে পিছনে যাওয়া যায়। সেটা একটা দিন। কলকাতার ইতি উতি চলা ফেরা করা জনগণের চোখে পড়ল। প্রায় ৪০-৪২ জন কুলি হরেকরকম যন্ত্রপাতি নিয়ে এক বার এদিকে যায়, এক বার ওদিকে যায়। তার পর কোথাও গিয়ে তাঁবু টাঙায়। আর তারই সাথে সাথে শুরু হয়ে যায় বিলিতি সাহেবদের ছবি তোলার বিস্তর আয়োজন। কখনও তাঁবু পড়ে গঙ্গার ঘাট তো, কখনও সাহেবরা তাঁবু ফেলে আজকের ডালহৌসি পাড়ায়। কলকাতা ছবিতে বন্দি হতে থাকে। শুধু কি তাই? এই সাহেবরা কুলিদের সঙ্গে নিয়ে কখনও কখনও ছোটেন অসমের চা বাগানে। তো কখনও ছোটেন রাজা বাদশাহদের বাড়িতে ছবি তুলতে। এসব তো গেল তথ্যপঞ্জির বিবরণ। এরই মাঝে এই সাহেবদের ছবিতোলার ব্যবসা শুরু হল studio photographer এর নতুন দিশা নিয়ে। যারা যারা ছবি তুলতে আসছেন তাদের ভাব, ভাবনা বংশ পরিচয় ইত্যাদির খাতিরে শুরু হল ছবি তোলার নতুন আয়োজন।
বনেদি বাড়ির মহিলারা ধর্মতলা স্ট্রিটে নামছেন ছবি তোলাতে। সেটা এমনই এক কাল, যখন তাঁরা বছরে একবারও বাড়ির বাইরে পা রাখতেন কিনা সন্দেহ। অথচ তাঁরা চলেছেন স্থির ছবিতে বন্দি হতে। তখন তাঁদের হৃদয়ে অন্যরকম আলোড়ন। কী ভাবে এক টুকরো কাচের পাতে সাদা মুখ সাহেবগুলো ছবিগুলিকে টপাটপ বন্দি করে, তা নিয়ে ভেবে রাতের-ঘুম চলে যেত তাঁদের। জনৈক রমণীর অপ্রকাশিত দিন লিপিতে পড়া যায়, ” সাহেব যখন ছবি তুলিতে উদ্যত হয়, তখন সে একটি কাল নিকষ কাপড়ের মধ্যে মাথা গুঁজিয়া দেন। আমার তো মনে হয়, ওই কালো কাপড়ের মধ্যেই বোধ হয় ইংল্যান্ডের ডাইনি লুকিয়ে আছে, তাহার সহিত সলা ক্রিয়াই সাহেব ওই কাচের পাতে ছবি ফোটাইয়া তোলে”।
মহিলারা বসবেন চেয়ারে। পুরুষরা দাঁড়াবেন ঠিক তার পেছনে। চেয়ারের পেছনে হাত টি দিয়ে। তবেই যে তা হবে নতুন বারতার ছবি। সে কথাই বুঝিয়েছিলেন স্টুডিওর সাহেবরা। রমণী হলেন প্রকৃতপক্ষে সিংহাসনের অধিকারী। তাই তিনি বসবেন চেয়ারে। আর পুরুষ সেই সিংহাসনের রক্ষা কর্তা। তাই তিনি দাঁড়ালেন চেয়ারের পাশে। ছবির মধ্যেই নেমে এল ইংল্যান্ডের মহারানীর শাসনব্যবস্থার সংবিধানের গন্ধ।
বাঙালি, নতুন করে রমণীকে নতুন আলো দেখাতে শেখাল বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ড। এ যেন ছবি তোলার নতুন etiquette। আর আছে যারা কালাপানি পার হচ্ছেন সাগর পারি দিয়ে, কিম্বা যেসব মেয়েরা বেথুন স্কুলে পড়তে যাচ্ছে, তাদের জন্য ছবি তোলার নয়া পন্থা। সেখানে দেখা যাবে শ্বেত পাথরের টেবিলের উপর সিঁড়ির মত ধাপে ধাপে সাজানো বই ডান হাতে ধরে ছবি তোলার রীতি। সব মিলিয়ে এক নয়া যুগের সূচনা।
কলকাতার যুগ জামানার দিশারা বারেবারেই বলেছেন ‘ওড়ে আগুন আমার ভাই’ বহুকাল আগে কলকাতার বিখ্যাত সাসুসী থিয়েটার আগুনে ভস্মীভূত হয়েছিলো স্টার থিয়েটারেও আগুন লেগেছিল। আগুনে ভস্মীভূত হয়েছে আরও অনেক কিছুই। তেমনি ১৯৯১ তে বোর্ণ অ্যান্ড শেফার্ড আগুনে ভস্মীভূত হয়। একটি কাজের নেগেটিভও অক্ষত ফিরে আসার সুযোগ পায়নি। সেই পোড়া দাগ নিয়ে আজও বাড়িটি দাঁড়িয়ে। কিছুকাল আগে পর্যন্ত সামান্য কিছু স্টুডিও ব্যবসা চালাতেন এই সংস্থার কর্মীরা। কিন্তু দেখতে দেখতে এসে যায় ডিজিটাল ক্যামেরার যুগ। প্রয়োজন হয় না ফটো স্লাইডের। স্লাইড শো কথাটির মানে বদলে গেছে। শুধু দাঁড়িয়ে পোড়া বাড়িটি। যেকোনো মুহূর্তে শুধু ভাঙা পড়তেই বাকি রইল ।।