No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    সম্প্রীতির মিলনতীর্থ বোড়াল ঋষি রাজনারায়ণ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়

    সম্প্রীতির মিলনতীর্থ বোড়াল ঋষি রাজনারায়ণ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়

    Story image

    স্কুলে রুকসানা, সাহিদার সঙ্গে একই বেঞ্চে পাশাপাশি বসে নন্দিনী, সঞ্চারীরা। ক্লাস শেষে বা কোনও কোনও দিন নির্ধারিত সময়ের একটু আগে ক্লাস শেষ হয়ে গেলে ছাত্রীরা একে অপরকে রামায়ন-মহাভারতের গল্প বলে, কেউ কাউকে কোরান পড়ে মানে বুঝিয়ে দেয়, কেউ আবার বাইবেলের কাহিনি পড়ে শোনায়। আসলে ওরা শিখেছে মানুষের মতো মানুষ হতে। ওদের স্কুল এই শিক্ষাই দিয়ে আসছে। আর এভাবেই সম্প্রীতির মিলনতীর্থ হয়ে উঠেছে বোড়াল ঋষি রাজনারায়ণ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়।

    দেশের নানা প্রান্তে যখন জাত, ধর্ম, বর্ণ নিয়ে হানাহানি চলছে, জাতের নামে যখন রাজনীতি করছে কেউ কেউ, ধর্ম যখন রাজনীতির হাতিয়ার হয়ে মানুষকে আক্রমণ করছে, তখন এই স্কুল রাজ্য তো বটেই, সারা দেশেও একটা দৃষ্টান্ত। স্কুলের এহেন পরিবেশের জন্য স্কুলের শিক্ষিকাদের যেমন ভূমিকা আছে, তেমনই স্কুলটি যে এলাকায় গড়ে উঠেছে সেই এলাকারও একটা ভূমিকা আছে। 

    গড়িয়া থেকে অটোরিকশায় উঠে বোড়াল ত্রিপুরেশ্বরী মন্দিরে যাব বললেই এই স্কুলে পৌঁছে যাওয়া যাবে। অটো ভাড়া ১০ টাকা। এই বোড়াল একটি প্রচীন জনপদ। এখন নাগরিক সভ্যতার ছোঁয়ায় অনেক আধুনিক হলেও এই অঞ্চলের জনবসতির ধরণ পুরোপুরি বদলে যায়নি। এই এলাকায় হিন্দু-মুসলিম সহ সব ধর্মের মানুষ একসঙ্গে বসবাস করে। ঋষি রাজনারায়ণ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়েও এই জনবসতির স্থানীয় মেয়েরাই পড়তে আসে। তাই জাতি-ধর্মের ছুঁতমার্গে নেই এই স্কুলের শিক্ষিকারা বা ছাত্রীরা। উল্টে যার যেটুকু ভালো, তা পরস্পরের মধ্যে বিনিময় করেই এই স্কুলে সম্প্রীতির বাতাবরণ অক্ষুণ্ণ রয়েছে।

    হিন্দু-মুসলিম মেয়েরা একসঙ্গে হাতে হাত লাগিয়ে এই স্কুলে সরস্বতী পুজো করে। মুসলিম ছাত্রীরা অঞ্জলী দেয়, ফল কাটে, আলপনা দেয়, খিচুড়ি প্রসাদ খায়। আবার কোনও কোনও ছাত্রী ইদের ছুটির পরের দিন বন্ধুদের জন্য সিমাইয়ের পায়েস নিয়ে আসে। দশমীর পর স্কুল খুললে নারকোল নাড়ু বিতরণ হয় বন্ধুদের মধ্যে। “বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য” – আমাদের ভারতাত্মার ঐক্য ও সম্প্রীতির হৃদস্পন্দন এই স্কুলে এলে তাই শুনতে পাওয়া যায়। বোড়াল ঋষি রাজনারায়ণ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা বুঝতে শিখেছে আগে মানুষ তার পর জাতপাত।

    এবার আসা যাক স্কুলের ইতিহাস প্রসঙ্গে। এই স্কুলের নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে রাজনারায়ণ বসুর নাম। তিনি ছিলেন উনিশ শতকের ভারতীয় বাঙালি চিন্তাবিদ এবং সাহিত্যিক। বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক মহাকাব্য মাইকেল মধুসূদন দত্তর “মেঘনাদবধ” কাব্য ইংরেজিতে অনুবাদ করেন তিনিই। রাজনারায়ণ বসু জন্মেছিলেন এই বোড়াল গ্রামে, যে গ্রাম আজ রাজপুর-সোনারপুর পুরসভার অধীনে এসে আধুনিক হয়েছে। ১৯৫২ সালে ঋষি রাজনারায়ণ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়। স্কুলের প্রতিষ্ঠা দিবস ৯ ফেব্রুয়ারি।

    তবে আজ যে ভবনে স্কুলের ক্লাস সহ সমস্ত প্রশাসনিক কাজ চলে, শুরুতে সেই ভবনটা ছিল না। এই প্রসঙ্গে কথা হচ্ছিল স্কুলের অর্থনীতির শিক্ষিকা অনুপমা পালের সঙ্গে। নিজের স্কুল নিয়ে গর্ব বোধ করেন তিনি। “প্রথমে ঋষি রাজনারায়ণ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের ক্লাস হত বোড়াল হাইস্কুলের ভবনে, মর্নিং স্কুল হিসাবে। আমাদের নিজেদের কোনও নিজস্ব স্কুল বিল্ডিং ছিল না। খুব কষ্ট করে তখন স্কুলটা চালাতে হত। বোড়াল হাইস্কুলে ডে সেকশনে সকাল সকাল ক্লাস শুরু করেও যে সময়টা পাওয়া যেত তা পর্যাপ্ত ছিল না। রোজ দশটার মধ্যে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে ফেলতেই হত। সব মিলিয়ে ক্লাসের জন্য তিন সাড়ে তিন ঘণ্টা সময় থাকত হাতে। এই অবস্থা চলতে চলতে ১৯৯৭ সালে আমাদের বর্তমান স্কুল বিল্ডিংটা তৈরি হয়।” বলছিলেন অনুপমা পাল।

    হিন্দু-মুসলিম মেয়েরা একসঙ্গে হাতে হাত লাগিয়ে এই স্কুলে সরস্বতী পুজো করে। মুসলিম ছাত্রীরা অঞ্জলী দেয়, ফল কাটে, আলপনা দেয়, খিচুড়ি প্রসাদ খায়। আবার কোনও ছাত্রী ইদের ছুটির পরের দিন বন্ধুদের জন্য সিমাইয়ের পায়েস নিয়ে আসে। দশমীর পর স্কুল খুললে নারকোল নাড়ু বিতরণ হয় বন্ধুদের মধ্যে।

    এই স্কুলের ভবন তৈরির পিছনেও একটা মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করেছে। দেশভাগের পর এপার বাংলায় এসে মেয়েদের শিক্ষার কথা ভেবে এই স্কুলটা তৈরি হয়েছিল। ১৯৯৭ সালে স্কুলটি তৈরির জন্য এই অঞ্চলের মানুষরা মুক্ত হাতে অর্থ ও নির্মাণ সামগ্রী দিয়ে সাহয্য করেছিলেন। নেতৃত্ব দিয়েছিলেন স্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষিকা ও স্কুল পরিচালন সমিতি। এর পিছনে ভালোবাসা, একটা একাত্মবোধ অবশ্যই কাজ করেছে। স্থানীয় মানুষেরা ভেবেছিলেন, সেই ১৯৫২ থেকে এতো ছাত্রী পড়ছে, কেন সেই স্কুলের নিজস্ব একটা ভবন থাকবে না? এই ভাবনা থেকেই স্কুল শুরুর ৪৫ বছর পর নতুন ভবনের পত্তন। ১৯৯৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি থেকে নতুন ভবনে এসেই স্কুলের দিবা বিভাগ চালু হয়। এখন দিবা বিভাগেই পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির ক্লাস হয়।

    বর্তমানে এই স্কুলে ২৬ জন শিক্ষিকা ও ২ জন প্যারা টিচার আছেন, তাঁদের নিয়ে মোট ২৮ জন শিক্ষিকা। পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলে ছাত্রী সংখ্যা এক হাজারের কিছু বেশি। অনুপমা পাল বলছিলেন, “ছাত্রী-শিক্ষিকার অনুপাত আমাদের স্কুলে ঠিকই আছে। ক্লাস করতে আমাদের বা ছাত্রীদের কোনও সমস্যা হয় না। উচ্চমাধ্যমিকে কলা বিভাগে পড়ানোর ব্যবস্থা আছে। স্কুল ভবনটি তিনতলা। ১৬ থেকে ১৭টা ক্লাস রুম। তবে স্থানাভাবে পিওর সায়েন্স পড়ানো যাচ্ছে না স্কুলে। চেষ্টা চলছে ক্লাস রুমের সংখ্যা আরও বাড়িয়ে, ল্যাবরেটরি তৈরি করে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনার উপযোগী করে তোলার। এখন ইকনমিক্স, ভূগোল, নিউট্রিশন, অংক পড়ানো হয় একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে। ভূগোল ও নিউট্রিশনের ল্যাবরেটরি আছে।”

    স্কুলের মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকের ফল ভালো হয়। তবে একটা সমস্যা হল স্কুলের বেশ কিছু সংখ্যক ছাত্রীর অভিভাবক নিরক্ষর। এই প্রসঙ্গে অনুপমা বলছিলেন, “আমরা আমাদের সবটা দিয়ে তাই এই ছাত্রীদের পড়াই, নিজেদের সন্তান মনে করে। আমরা জানি, আমরা ওদের ভালোভাবে না পড়ালে বাড়ি গিয়ে হয়তো কোনও বিষয় বুঝতে অসুবিধা হলে তা দেখিয়ে দেওয়ার মতো কাউকে পাবে না। আমি ২১ বছর এই স্কুলে পড়াচ্ছি। ওদের যেদিন মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকের ফল প্রকাশিত হয় সেদিন মনে হয় যেন আমাদেরই পরীক্ষার ফল প্রকাশ হবে। তবে আমাদের মেয়েরা ভালো ফলই করে৷ ওরা পাশ করলে আমাদের যুদ্ধজয়ের তৃপ্তি হয়।”

    স্কুলে পড়াশোনা ছাড়াও গান, কবিতা, ক্যুইজ ইত্যাদির চর্চা আছে। বিভিন্ন স্কুল ভিত্তিক বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় ছাত্রীরা অংশ গ্রহণ করে এবং পুরস্কার পায়। এনসিসি চালু করার চেষ্টা চলছে স্কুলে। এছাড়া ইউথ পার্লামেন্টে স্কুলের ছাত্রীরা অংশ নেয়। এই সব বিষয়ে ছাত্রীদের সহায়তা স্কুল থেকেও যেমন করা হয় ছাত্রীরাও নিজেরা বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়ে সফল হওয়ার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে। সাবিনা নামের একটি ছাত্রী বাস্কেট বল খেলে রাজ্য স্তরে সাফল্য পেয়েছিল বছর পাঁচেক আগে। 

    স্কুলের লাইব্রেরির অবস্থা বর্তমানে তেমন ভালো নয়। তার কারণ, লকডাউনের সময় তালা ভেঙে লাইব্রেরির বই চুরি হয়ে যায়। এখন আবার নতুন করে বই কেনা হচ্ছে ছাত্রীদের জন্য। চেষ্টা চলছে যাতে একটা ভালো লাইব্রেরি ছাত্রীদের জন্য করা যায়। স্কুলে লাইব্রেরিয়ান পদে কেউ নেই। তাই শিক্ষিকারাই পর্যায়ক্রমে এই কাজটা আপাতত সামলাচ্ছেন।

    এক কথায় বলতে গেলে বলতে হয়, শিক্ষা তখনই সম্পূর্ণ হয় যখন প্রান্তিক শ্রেণির মানুষের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে, তাঁদের চেতনা জাগ্রত করে সঠিক পথে চালিত করা যায়। সেই কাজটা খুব দায়িত্বের সঙ্গে করে চলেছে বোড়াল ঋষি রাজনারায়ণ বসু উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়।

    ______________
    তথ্য সূত্র : অনুপমা পাল, শিক্ষিকা, বোড়াল ঋষি রাজনারায়ণ বসু উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়
    ছবি সৌজন্যে : অনুপমা পাল

    *কলকাতা, শহরতলি বা জেলার কোনও না কোনও স্কুলের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে গর্বের ইতিহাস রয়েছে, রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বুনিয়াদি গল্প। এবার সেদিকেই ফিরে তাকিয়ে চলছে নতুন ধারাবাহিক ‘আমাদের ইস্কুল’। সমস্ত পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন। চোখ রাখুন প্রতি বুধবার সন্ধে ৬টায়, শুধুমাত্র বঙ্গদর্শনে।           

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @