বইমেলায় পাঠক নেই, শ্রোতা আছে? পড়ুয়ার বদলে দর্শকের ভিড়?

কলকাতা আন্তর্জাতিক পুস্তকমেলার বাইরে জেলায় জেলায় নানা বইমেলার আয়োজন নতুন না হলেও খুব বেশি পুরোনো দিনের ঘটনা নয়। মোটামুটি নব্বই দশকের শুরুতেই এই বইমেলাগুলির উপযোগিতা সাধারণ মানুষ ও পাঠক অনুভব করতে শুরু করেন। এমনকি এর নেপথ্যে সরকারি সহযোগিতাও ছিল। সহযোগিতা তবে খবরদারি নয়। মূলত শহর ও মফস্সলের বিভিন্ন লাইব্রেরিগুলোকে আর্থিক অনুদান দেওয়া হত বই কেনার জন্য। তারা নির্দিষ্ট পরিমাণ বই কিনে ফিরতেন। মফস্সলের সাধারণ পাঠকদের চাহিদা মিটত। ফলে প্রকাশকের দিক থেকেও এই জেলা বইমেলার চাহিদা ছিল। পাঠক অল্প বই কিনলেও সরকারি লাইব্রেরিগুলো যেহেতু অনেক বই কিনত, তাই তেমন আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হত না তাঁদের। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই জেলা বইমেলার বাইরে বেশকিছু সংস্কৃতিপ্রবণ মানুষ, স্থানীয় ক্লাব তাঁদের অঞ্চলে বইমেলার তাগিদ অনুভব করলেন। ফলে শুধু জেলায় নয়, মফস্সলের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহরতলিতে বইমেলা অনুষ্ঠিত হতে লাগল। উদ্বোধন করলেন বিশিষ্ট কিছু সাহিত্যিক।
যখন অনেকেই ভাবছেন ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াবেন না। তখনই ঘটল অঘটন। জেলা এবং শহরের বইমেলাগুলি ফিরে এল বিপুল গৌরবে। গত ১০-১৫ বছরে তারই শ্রুতকীর্তি মহিমা।
বই খুব বিক্রি হত তা নয়। বরং অনেক দোকানদার প্রকাশকের অভাবে বিভিন্ন প্রকাশনীর বই নিয়ে বসতেন। অর্থাৎ প্রকাশক নয় বরং একটু সমৃদ্ধ বইয়ের দোকানদার ছিলেন এই মেলাগুলির চালিকাশক্তি। সঙ্গে ছিলেন সাধারণ পাঠক। এমনকি কয়েকটি স্থানীয় লিটল ম্যাগাজিনও স্টল দিত। এর পাশাপাশি চলত নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। তখনও গ্রন্থ প্রকাশ এত সহজ হয়ে যায়নি। যেহেতু দুপুর থেকে রাত সারাদিনের অনুষ্ঠান এবং দুপুরে পাঠক সমাগম নেই- সেই সময় পাদপূরণের জন্য সাধারণত রাখা হত কবিসম্মেলন। শ্রোতাহীন আসরে লোকাল কবিরা কবিতা পাঠ করতেন এবং অভিমান নিয়ে ফিরে যেতেন।
মূল অনুষ্ঠান হত সন্ধ্যায়। গান থেকে নৃত্যনাট্য, থাকতো নাটকের নানা আয়োজন। এর পাশাপাশি ছিল কয়েকটি দোকান যেখানে আলপনা, বাড়ির তৈরি নানা জিনিস, বাচ্চাদের আঁকার বই, কম্পিউটার সেন্টারের কোর্সের সমাচার – বইয়ের সঙ্গে তেমন সম্পর্ক না থাকলেও। এভাবেই চলছিল জেলার বইমেলা এবং বিভিন্ন শহরের ছোটখাটো বইমেলা। তখনও জেলায় জেলায় লিটল ম্যাগাজিন মেলার দিন শুরু হয়নি। কিছুদিনের মধ্যেই পাঠকের অভাবে ধুঁকতে শুরু করল কয়েকটি বইমেলা। যেহেতু বইয়ের বৈচিত্র্য নেই, বড়ো প্রকাশকেরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন, তাই বইমেলার সঙ্গে জুড়ে দিতে হল আরও কিছু জিনিস। সেই সময় অনেক বইমেলাতেই মূল আকর্ষণ ছিল পুষ্প প্রদর্শনী। কিছু খাবার দোকান। বিজ্ঞান সচেতনতার অনুষ্ঠান। ফলত পাঠক নেই, শ্রোতা আছে। পড়ুয়ার বদলে দর্শকের ভিড়। বিক্রি যা কিছু পুরোনো বইয়ের। সেখানে মহার্ঘ্য অনেক বই কম দামে পেয়ে কেউ কেউ কিনতেন। এভাবেই চলছিল। যখন অনেকেই ভাবছেন ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াবেন না, তখনই ঘটল অঘটন। জেলা এবং শহরের বইমেলাগুলি ফিরে এল বিপুল গৌরবে। গত ১০-১৫ বছরে তারই শ্রুতকীর্তি মহিমা।
এই বিপুল গৌরব নিশ্চয়ই ভালো দিক। যে রক্তাল্পতায় ভুগছিল জেলা বা শহরের বইমেলাগুলি সেখানে নতুন করে রক্তের সঞ্চার হল। এখন অবশ্য বুঝতে পারি অনেক ক্ষেত্রেই তা ছিল বদরক্ত। এই স্পন্দনে পাঠকের অধিকার কম, দোকানদারের ঝুঁকি আরও কম। এমনকি পাঠক শূন্য হলেও এই মেলা আর পিছন ফিরে তাকাবে না। তার কারণ পাঠকের ছদ্মবেশে এই বইমেলাগুলি আসলে চাইছে দর্শক। নির্বিচার শ্রোতা। এখানে খাবারের স্টল আছে, নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের হুল্লোড় আছে, আবার কবিসম্মেলনও আছে। এবং সমস্ত কবি ডাক পেয়ে সংগঠকদের আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছেন, এমন বয়ান দেন। ফলে এখানে যাঁরা আসেন তাঁরা সকলেই পাঠক নন কিন্তু শিক্ষিত এবং পাঠরুচিও আছে। তাই খাওয়া-দাওয়ার শেষে, অনুষ্ঠানের হাততালির শেষে, বিবেকের তাড়নায় তাঁরা কিছু বই কেনেন সন্তানের জন্য। কিছু কিছু প্রয়োজনীয় বইও, কবিতা বা কথাসাহিত্য একেবারেই নয়। কিন্তু জৌলুস একেবারেই কমেনি কেননা অংশগ্রহণের আভিজাত্য আছে। কিছুদিন আগেই একটি গুরুত্বপূর্ণ শহরে বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়ে গেল প্রবেশ মূল্যসহ। যেখানে বিনা পয়সায় পাঠক হয় না সেখানে প্রবেশ মূল্যের হঠকারিতা কেন? আসল রহস্য সেখানে।
ছোটো প্রকাশকেরাও এইসব বইমেলায় সামান্য লাভের মুখ দেখছেন। একটু ‘পুশ’ করলে তরুণ কবির বইও বিক্রি হচ্ছে। এই বইমেলাগুলি হরর সাম্রাজ্য থেকে খানিকটা মুক্ত।
আসলে কলকাতা-মুম্বাইয়ের নামিদামি শিল্পীরা গান গাইবেন। তাঁদের অনুষ্ঠানেরই টিকিট বইমেলার নামে। রথ দেখাও হল, কলা বেচাও হল। এই বইমেলাটিতে যেদিন রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী জয়তী চক্রবর্তী এলেন সেদিন প্রবেশ মূল্য ৩০ টাকা, যেদিন গায়ক অনুপম রায় এলেন সেদিন প্রবেশ মূল্য ১২০ টাকা, মুম্বাইয়ের নবীন গায়িকার জন্য ৭০ টাকা এবং হিমেশ রেশমিয়া যেদিন এলেন সেদিন প্রবেশ মূল্য ১৫০ টাকা। ইদানীং জেলা বইমেলা বা শহরের বইমেলাগুলির যত পোস্টার হয় সেখানে বইমেলা শব্দটি আছে, বই নেই। গায়ক গায়িকার জৌলুসপূর্ণ ছবি দেখে বুঝবার উপায় নেই, শুধু এক কোণে ক্ষীণকায় বইমেলা শব্দটি পরম্পরা বজায় রেখে চলেছে।
ঠান্ডা মাথায় খেয়াল করলেই দেখবেন এই বইমেলাগুলির এত জাঁকজমক মূলত স্থানীয় বিধায়ক বা সাংসদের দৌলতে। বইমেলার অছিলায় সাংস্কৃতিক পরিসরটিকে রাজনৈতিকভাবে দখল করে নেওয়া। অতএব বই এবং পাঠকের হাতে রইল কেবলমাত্র পেন্সিল। এইভাবে বইমেলাগুলিকে গত দশ বছরে স্রেফ কিনে নেওয়া হয়েছে। লোকাল কবিকেও মহার্ঘ্য উপহার দিয়ে স্তাবক বানানো হয়েছে। শুধু পাঠকের দেখা নেই।
শুধু খারাপ দিক থেকেই দেখছি আমি! সবটাই তেমন অবশ্য নয়। পাঠকের অভিমানের কথা বাদ দিলেও পড়ে থাকেন সাধারণ পাঠক, যাঁদের দেখনদারি নেই, লেখককে খুশি করার দায় নেই। কবিসম্মেলনের মঞ্চ অধিকারের বাসনা নেই। এঁরা সেই অবলুপ্ত পাঠক। এঁরাই দীর্ঘদিন দুপুরের ভাতঘুমে বই পড়ে মফস্সলের লাইব্রেরিগুলিকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। তাঁদের গবেষণা নেই, পাঠপ্রতিক্রিয়া নেই। কিন্তু আছে বইয়ের প্রতি নির্জন ভালোবাসা। তাঁরা কলেজস্ট্রিট চেনেন না, প্রকাশক চেনেন না, বিভিন্ন প্রকাশনীর ছাড় বা মহাছাড়ের তাঁরা কেউ নন। তাঁরা বই কিনতে চান। কিন্তু সংসার ফেলে বা অফিসের কাজ ফেলে যাবার উপায় নেই। তাঁরা আসেন এবং পছন্দসই বই কেনেন। এমনকি প্রতিবছর অপেক্ষাও করেন। এঁদের সংখ্যা খুব কম নয়। তাঁরা গায়কের গান শুনে হাততালি দিলেও শুধু সেই কারণেই ভিড় জমাবেন না। ফলে কলকাতা কেন্দ্রিকতা থেকে বেরিয়ে অনেক শহরে পাঠকের দরজা খুলে দিচ্ছে এই বইমেলাগুলো। অনেক জায়গায় আবার, নানা সংগঠক মেলার শেষ দিন প্রকাশকদের দোরে দোরে গিয়ে খোঁজ নিচ্ছেন কেমন বিক্রি হল। বিক্রি কম হলে নিজেরাই পাঠক হিসেবে সাধ্যাতীত বই কিনে নিচ্ছেন। সম্প্রতি এমনই এক বইমেলায় সংগঠকেরা লিটল ম্যাগাজিনকে গুরুত্ব দিয়ে অনেকখানি জায়গা করে দিয়েছেন। তাঁদের সম্মান দিয়েছেন। বিরল হলেও এই দৃশ্য নতুন করে বাঁচার আশা জাগায়।
ছোটো প্রকাশকেরাও এইসব বইমেলায় সামান্য লাভের মুখ দেখছেন। একটু ‘পুশ’ করলে তরুণ কবির বইও বিক্রি হচ্ছে। এই বইমেলাগুলি হরর সাম্রাজ্য থেকে খানিকটা মুক্ত। শুধু প্রকাশকের সহৃদয়তা চাই। এইসব মেলার মূল সম্পদ নানা ছোটো প্রকাশক। তাঁরাই আর্থিক কারণে অনেক সময় সব বই নিয়ে যেতে পারেন না কিন্তু অলক্ষ্যে পাঠক তৈরি করে আসেন। এই রক্তপ্রবাহটির গুরুত্ব আছে। আমরা কলেজস্ট্রিটের বিজ্ঞ পাঠকেরা এঁদের চিনি না, এঁদের গুরুত্ব বুঝি না। যে গবেষক বা তরুণ কবি বা লেখক খালি হাতে বইমেলায় ঘুরছেন, তাঁরা অপেক্ষায় আছেন নির্দিষ্ট ছাড়ে কলেজস্ট্রিট থেকে বইটি নেবেন। কিন্তু কলকাতা বইমেলার মূল বিক্রি কিন্তু জেলার মানুষদের হাতে। তাঁরা উন্নাসিক কবি বা পাঠক নন।
যদি পাঠক কমে গিয়ে থাকে সে দুর্ভাগ্য সার্বিক। আজ পাঠককে দোষ না দিয়ে এই প্রশ্ন তুলতে চাই অধিকাংশ সরকারি লাইব্রেরিগুলি বন্ধ কেন? জেলা বইমেলার এই বিপুল খরচ পৌরসভা বা বিধায়কদের হাত ঘুরে এলেও পাঠক তৈরি করতে গেলে চাই লাইব্রেরিগুলিকে সক্রিয়, পুনর্জীবিত করে তোলা। আজ অনেক ছোটো প্রকাশক এবং স্থানীয় লিটিল ম্যাগাজিনগুলির মূল ভরসার জায়গা জেলা বা শহরের এই বইমেলাগুলি। কলকাতা বইমেলার বাইরে এখন নজর দিতে হবে এই মেলাগুলির দিকে। এখনও বেশিরভাগ লিটল ম্যাগাজিন মেলা সরকারি উদ্যোগের বাইরে। তা শুভ লক্ষণ। ঠিক একইভাবে এই বইমেলাগুলিকে যথাসম্ভব ক্ষমতার বাইরে আনতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে এই মেলাগুলিকে তৈরি করেছে অতিরিক্ত অর্থ নয়, পাঠকের বিচ্ছিন্নতা, অপরিসীম বিরহ। তাঁকে সম্মান দিই এবার। খাবারের স্টল কম হোক। বাইরের শিল্পীর নাচ গান একটু কম হোক। পৌরপিতা এবার একটু দূরে থাকুন।