স্বাধীনতার ৭৫ : আনন্দ ভয় চেনা অচেনা বিস্ময় ও হিংস্রতা কথা

সাধারণভাবে একটা তেলের বিজ্ঞাপন বা একটা জুতোর বিজ্ঞাপন একটা নির্দিষ্ট সময়েই বেঁচে থাকে। তাদের আয়ু সীমিত। কারণ সময়ের সঙ্গে বিজ্ঞাপনের ভাষা, ছবি, রং বদলে বদলে যেতে থাকে।
আমাদের বোধ, সময়ের প্রতিনিধিত্ব করে। আবার যখন, কয়েক হাজার বছর আগে বৈশেষিক সূত্রের রচিয়তা মহর্ষি কণাদ বলেন, ‘যে দ্রব্যের গন্ধ আছে তাহাই পৃথিবী, পৃথিবী ভিন্ন আর কোনও দ্রব্যে গন্ধ নাই’, এই দার্শনিক আবিষ্কার কিন্তু সময়কে অতিক্রম করে যায়।
আসলে আমরা সময়কে বুঝতে চেষ্টা করি। আমাদের কাছে আইনস্টাইনের সময় যেমন সত্যি, তেমনি সত্যি রবীন্দ্রনাথের ডাকঘরের সংলাপ, ‘কেউ বলে সময় বয়ে যাচ্ছে’, ‘কেউ বলে সময় হয়নি’। তার পরে অবশ্য আরেকটা লাইন রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন। সেখানে অমল বলছে, ‘তুমি ঘণ্টা বাজিয়ে দিলেই তো সময় হবে’।
আরও পড়ুন: ঠিকঠাক বাংলা বলছেন তো?
কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্ত (Krishnapriya Dasgupta) আমাদের দেশের স্বাধীনতার ৭৫ বছর (75 Years of Independence) সময়টাকে ধরতে চেয়েছেন স্বাধীনতার ৭৫ বছরে অর্থাৎ ২০২১-এর অগাস্ট মাস এবং তার আগে পরে কয়েকটি মাসে প্রকাশিত বিভিন্ন খবরের কাগজের সংবাদ, সম্পাদকীয়, রিপোর্ট, উত্তর সম্পাদকীয় এবং বিজ্ঞাপনের মধ্যে দিয়ে। ওই সব নিবন্ধ, রিপোর্ট, ছবি, কাহিনি দেখতে দেখতে, পড়তে পড়তে, আমাদের মনে একটা ছবি ফুটে ওঠে। সেই ছবিই স্বাধীনতার ৭৫ বছরের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু এখানে বাস্তবের ছবি আর পাঠকের মনে যে প্রতিচ্ছবি তৈরি হল, দুটো হুবহু এক নয়। শুধু তাই নয়, একেক জনের মনের আয়নায় ভিন্ন ভিন্নও হয়ে উঠতে পারে সেই প্রতিচ্ছবি। এবং তা প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীলও হতে পারে।
কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্ত আমাদের দেশের স্বাধীনতার ৭৫ বছর সময়টাকে ধরতে চেয়েছেন স্বাধীনতার ৭৫ বছরে অর্থাৎ ২০২১-এর অগাস্ট মাস এবং তার আগে পরে কয়েকটি মাসে প্রকাশিত বিভিন্ন খবরের কাগজের সংবাদ, সম্পাদকীয়, রিপোর্ট, উত্তর সম্পাদকীয় এবং বিজ্ঞাপনের মধ্যে দিয়ে।
সংবাদপত্রকে তো সমাজের আয়না বলা হয়। তাহলে স্বাধীনতার ৭৫ বছর সময়টাকে খবরের কাগজের শরীর দিয়ে কেন ছোঁয়া যাবে না! কৃষ্ণপ্রিয়র এই যে অভিনব প্রয়াস, তার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে হাইওয়ের ধারের নয়নজুলিতে মেঘের ছায়ার সঙ্গে। ভাসছে। বদলাচ্ছে। ভাঙছে। তবে এই ছায়া মেঘের মতো নীরব নয়। কখনও তার চিৎকার শোনা যায়, কখনও কান্নার শব্দ ভেসে আসে, কখনও রক্তের দাগ, কখনও হাসি, কখনও প্রশ্ন, এই দেশ-ই কি আমি চেয়েছিলাম? এই সুদীর্ঘ ভাষা-বিস্তারে ‘সাররিয়ালিস্ট’ কবিতার রূপ খুঁজে পেতেও পারেন কোনও পাঠক।
সেই কারণেই, মনে হয় আজ থেকে পঁচিশ বছর পরে, স্বাধীনতার শতবর্ষেও এই বইয়ের পাতা ওল্টাতে হবে, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে! কারণ স্বাধীনতা ওইখানে পাতায় পাতায় ছবিতে, ক্রোধে, বেদনায়, সাফল্যে মুখরিত হবে তখনও। বইয়ের নাম ‘আজাদি@৭৫, মহোৎসব ও বিভীষিকা’।
বই শুরু হচ্ছে একটি অদ্ভুত খবর দিয়ে, যা প্রকাশের তারিখ ১০ অক্টোবর, ২০২১। যেখানে মুম্বইয়ের একটি ব্যাঙ্কের কর্মচারীদের বলা হচ্ছে নবরাত্রী উপলক্ষে টানা ন’দিন বিভিন্ন রঙের পোশাক পরে আসতে হবে। হলুদ, সবুজ, ছাই রং ইত্যাদি। এ আসলে এক ফতোয়া সংস্কৃতি, যা এতদিন পাকিস্তানে, ইরানে বেশি শোনা যেত, এখন হিন্দুত্ববাদীদের হাত ধরে, কখনও হিজাবে, কখনও আজানে, কখনও খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের দাবিতে শোনা যাচ্ছে ভারতেও। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভারতের গণতন্ত্রকে বলতে শুরু করেছে ‘ইলেক্টেড অটোক্র্যাসি’।
পরের খবর, ১২ অক্টোবর, ২০২১, ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার ডাক দিয়েছেন বিজেপির সাধারণ সম্পাদক সি টি রবি।
বই শুরু হচ্ছে একটি অদ্ভুত খবর দিয়ে, যা প্রকাশের তারিখ ১০ অক্টোবর, ২০২১। যেখানে মুম্বইয়ের একটি ব্যাঙ্কের কর্মচারীদের বলা হচ্ছে নবরাত্রী উপলক্ষে টানা ন’দিন বিভিন্ন রঙের পোশাক পরে আসতে হবে। হলুদ, সবুজ, ছাই রং ইত্যাদি। এ আসলে এক ফতোয়া সংস্কৃতি, যা এতদিন পাকিস্তানে, ইরানে বেশি শোনা যেত, এখন হিন্দুত্ববাদীদের হাত ধরে, কখনও হিজাবে, কখনও আজানে, কখনও খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের দাবিতে শোনা যাচ্ছে ভারতেও।
তার পরের খবর, হরিদ্বারের ধর্ম সংসদ থেকে হিন্দুত্ববাদী পুরোহিত যতি নরসিংহানন্দের গণহত্যার ডাক। এরকম কয়েকটি খবরকে পর পর সাজিয়ে তৈরি হয়েছে বইয়ের প্রস্তাবনা।
মূল বইয়ে যখন প্রবেশ করবেন তার প্রথম ছবি জুয়েলারির দোকানের বিজ্ঞাপন, যেখানে ঘোষণা করা হয়েছে স্বাধীনতার ৭৫ বছরে ৭৫ শতাংশ ছাড়ের কথা। শতাংশ আর ছাড়ের মাঝে খুব ছোটো ছোটো হরফে লেখা ‘পর্যন্ত’। তার নিচে আরও ছোটো করে, ‘সোনা ও হিরের গয়নার মেকিং চার্জের উপর’। এই পরিচ্ছেদের নাম ‘পূর্বভূমিকা বা অপারেশন ল্যাংড়া’। এই অপারেশন ল্যাংড়া কথাটা এসেছে উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথের শাসন থেকে। ২০১৭ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে ২০২১-এর ১৩ অগাস্ট পর্যন্ত হিসেব, মোট ৮৪৭২টি এনকাউন্টার করেছে উত্তরপ্রদেশের পুলিশ। এই এনকাউন্টারে পুলিশের গুলিতে আহতের সংখ্যা ৩৩০২ জন। পুলিশের দাবি এরা প্রত্যেকেই বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত। কিন্তু দোষ প্রমাণ হয়নি। এইসব এনকাউন্টারে মারা গিয়েছেন ১৪৬ জন। আর বহু অভিযুক্তের গুলি লেগেছে পায়ে, তারা আর ভালো করে হাঁটতে পারেন না। তাই এই অপারেশনের নাম ‘অপারেশন ল্যাংড়া’। তা দেখে বিপুল হাততালি দিচ্ছে জনতা। এখানে প্রচুর রঙিন বিজ্ঞাপন (গয়না, খাবার ইত্যাদি) এবং তা নিয়ে স্বাধীনতার ৭৫-এর সঙ্গে নানা তুলনা-সহ আলোচনা পাবেন পাঠক। একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অতিমারির এই সময়ে দেশে দরিদ্রের সংখ্য কত তা সরকারের জানা নেই। তবে দেশে কত জন কোটিপতি আছেন তা সরকারের জানা আছে। অক্সিজেনের অভাবে কোভিডকালে কতজনের মৃত্যু হয়েছে তা সরকারের জানা নেই। জোড়া লকডাউনের সময়ে বাড়ি ফেরার পথে কত জন পরিযায়ী শ্রমিকের প্রাণ গিয়েছিল, তা-ও কেন্দ্রীয় সরকারের জানা নেই।
একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অতিমারির এই সময়ে দেশে দরিদ্রের সংখ্য কত তা সরকারের জানা নেই। তবে দেশে কত জন কোটিপতি আছেন তা সরকারের জানা আছে। অক্সিজেনের অভাবে কোভিডকালে কতজনের মৃত্যু হয়েছে তা সরকারের জানা নেই। জোড়া লকডাউনের সময়ে বাড়ি ফেরার পথে কত জন পরিযায়ী শ্রমিকের প্রাণ গিয়েছিল, তা-ও কেন্দ্রীয় সরকারের জানা নেই।
এইভাবে চলতে চলতে ২৩৬ পাতায় দেখা যাচ্ছে বোল্ড হরফে বিভিন্ন সংবাদপত্র থেকে নেওয়া বেশ কয়েকটি ‘হেডলাইন’। তার কয়েকটা এরকম-
১) চৌকিদার এখন সরকারি সম্পত্তি বিক্রির ঠিকাদার।
২) বিক্রি হচ্ছে এ রাজ্যের টয়ট্রেন, জাতীয় সড়ক, বন্দরও।
৩) সব বেচে দিচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার, তোপ রাহুলের।
বইয়ের শেষ পাতায় প্রশ্ন, বড়োরা কি ছোটোদের কথা শুনবে? শুনতা পাচ্ছে? সেখানে একটা রঙিন হিয়ারিং এইডের বিজ্ঞাপনের ছবি আছে। যেখানে বলা হয়েছে, ‘ফ্রিডম অফার’, শ্রবণ সমস্যা থেকে মুক্তি। হিয়ারিং এইডের উপর ৩০% পর্যন্ত ছাড়।
আজাদি @ ৭৫ - মহোৎসব ও বিভীষিকা, কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্ত, ঋতবাক প্রকাশনী, মুদ্রিত মূল্য ৫০০ টাকা