দামোদা : ঠাকুরবাড়ির পদ, বিলুপ্তপ্রায় এই মিষ্টান্নে মেশানো হতো মনের মাধুরী

বনেদিবাড়ির ঐতিহ্য, ইতিহাস, রোমান্টিকতা শুধুমাত্র কলকাতাতে আটকে থাকে না, পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে অসংখ্য বনেদিবাড়ি রয়েছে—বরং সেখানে অনেক বেশি রং এবং গভীরতা। ইতিহাসের পাতায় যেমন অমর হয়ে থাকবে এসব বাড়ি, তেমনই তাদের রান্নাঘরও। রান্নার কিছু কিছু পদ কোনও কোনও পরিবারের হাত ধরে ঢুকে পড়ে ইতিহাসের খাতায়, সর্বসাধারণের হেঁশেলে। দেশিয় থেকে কন্টিনেন্টাল, আমিষ থেকে নিরামিষ, নোনতা থেকে মিষ্টির নানান পদ আজও ‘পাক’ হয় সেই সব পরিবারের উত্তরসূরির রন্ধনশালায়। প্রতিটি বনেদি পরিবারের খাওয়া-দাওয়াতেই থাকত এক-একটি সিগনেচার পদ। শতক পেরিয়ে ধুমধাম, আনন্দ-জৌলুসে ঘাটতি পড়লেও রীতি ভাঙতে পারেনি এখনও বহু পরিবার। বাংলার বিভিন্ন অভিজাত পরিবারের বিশেষ বিশেষ পদের কথা, তাদের বিচিত্র সব নাম শুনলে জিভে জল আর মনে কৌতূহলের উদ্রেক হয় বইকি! তাই বনেদিবাড়ির রাজকীয় রান্না, তাদের পাকঘরে এবার ঢুঁ মারবে ‘বঙ্গদর্শন’।
প্রথম দিনের প্রথম কিস্তিতে আমরা পরিবেশন করেছিলাম শোভাবাজার রাজবাড়ির ১১৭ বছরের পুরোনো পদ ‘পদ্মলুচি’। এই পদ্মলুচি ছিল মুখরোচক-নোনতা খাবার। দ্বিতীয় কিস্তিতে আমরা পরিবেশন করছি প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া একটি মিষ্টি পদ। ‘দামোদা’ নামের এই মিষ্টান্ন’র উল্লেখ পাওয়া যায় পূর্ণিমা ঠাকুর প্রণীত ‘ঠাকুরবাড়ির রান্না’ বইতে। প্রসঙ্গত, অবিভক্ত বাংলায় ভোজের আসরে বিদেশের মেনু কার্ডের আদলে হাতে লেখা ‘ক্রমণী’ চালু করেছিলেন ঠাকুরবাড়ির প্রজ্ঞাসুন্দরীদেবী। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তৃতীয় পুত্র হেমেন্দ্রনাথের মেজো মেয়ে প্রজ্ঞাসুন্দরীই লিখেছিলেন বাংলা ভাষায় প্রথম রান্নার বই।
বইয়ের ভূমিকায় পূর্ণিমাদেবী লিখেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের ভাতুষ্পুত্রী তাঁর ন’মা ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী একটি লম্বা, মুদির খাতার মত দেখতে, রান্নার হাতেলেখা খাতা তাঁকে দিয়ে গিয়েছিলেন। রান্নাঘরে ঢুকতে না দেখা গেলেও তাঁর ন’মা যত্ন করে সেই খাতায় লিখে রাখতেন পছন্দমতো পদের কায়দাকানুন। পূর্ণিমা ঠাকুর সেই খাতারই বেশ কিছু রেসিপি এবং ঠাকুরবাড়ির মেয়ে ও চৌধুরীবাড়ির বউ নলিনীদেবীর (পূর্ণিমা ঠাকুরের মা) কাছ থেকে যে যে রান্নাগুলি শিখেছিলেন, সেগুলি যাতে হারিয়ে না যায় তাই সেসব তিনি লিপিবদ্ধ করেছিলেন ‘ঠাকুরবাড়ির রান্না’য়।
এবার আসা যাক আসল কথায়। কীভাবে বানাবেন ‘দামেদো’?
যা যা লাগবে
জমাট বাঁধা খোয়া ক্ষীর
সুজি
চিনি
বাদাম
এলাচদানা
জাফরান
(কত জনের জন্য বানাবেন তার উপর নির্ভর করছে উপকরণের পরিমান। সেই মতো বুঝে নিন)
যেভাবে বানাবেন
চিনির রস করে রাখতে হবে আগে থেকে।
খোয়া ক্ষীর বেশি ঘিয়ে (খাঁটি ঘি ব্যবহার করুন) একটু নেড়েচেড়ে অল্প সুজি দিতে হবে।
লাল হয়ে এলে, চিনির ঘন রস ঢেলে দিতে হবে। ক্রমাগত নাড়তে হবে।
বাদামকুচি, এলাচদানা ও জাফরানের জল দিতে হবে।
একটু থকথকে হয়ে এলে ঘিমাখা থালায় ঢেলে দিতে হবে।
এবার অল্প শক্ত হলে বরফির মত কেটে নিতে হবে।
বাঙালি জাতির মতো মিষ্টিখোর প্রাণী এই পৃথিবীতে বিরল বলাই ভালো। তবে, মধুমেহ জাতীয় রোগের প্রভাবে এই স্বভাব ঠিকিয়ে রাখাই দায়! তাই পরিশেষে বলি, এই পদে মিষ্টি যদি কিছু কম মনে হয়, সামান্য ‘মনের মাধুরী’ মিশিয়ে নিতে পারেন। যেমনটা সেই বহু বছর আগে পূর্ণিমা ঠাকুর বলেছিলেন, “আধুনিকের প্যাকেটে পোরা এক মিনিটে প্রস্তুত খাবারের যুগে ‘সেবামাধুর্যে-ছোঁয়া’ রান্নার অবসর এখন কোথায়? বহু গৃহকল্যাণের আয়োজনের সঙ্গে রান্নার প্রয়োজনও আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। কিন্তু তারই সঙ্গে চলে যাচ্ছে স্নেহ, প্রেম, দয়ামায়া আরও কত কি।” অনেকটা সময় দিয়ে, ধৈর্যের সঙ্গে, ‘মনের মাধুরী’ মিশিয়ে রান্নার আয়োজন করে যে, তাঁর উদ্দেশেই রান্নার বইটি সংকলিত করেছিলেন। ছড়া কেটে বলেছিলেন-
শোভন হাতের সন্দেশ-পান্তোয়া
মাছ-মাংসের পোলাও ইত্যাদিও
যবে দেখা দেয় সেবামাধুর্যে-ছোঁয়া
তখন সে হয় কী অনির্বচনীয়!
__________________
তথ্যসূত্রঃ ঠাকুরবাড়ির রান্না, পূর্ণিমা ঠাকুর
**বঙ্গদর্শন-এর নতুন বিভাগ ‘বনেদিবাড়ির পাকঘর’। ইতিহাস আর নির্ভরযোগ্য রেসিপিতে পরিপূর্ণ বাঙালি পদের রকমারি। প্রতি সপ্তাহে নিয়মিত।