শাড়ির অভিধানে বডি-শেমিং ছিল না কখনোই, শাড়ি নদীর মতো বহতা

শাড়ির সঙ্গে আমার সম্পর্কটি দ্বান্দ্বিক। টানাপোড়েনের। শাড়ি, এককালে ভেবেছি, সভ্যতার উলটোবাগে চলে। সে স্রেফ এক খণ্ড বস্ত্র বৈ তো নয়! সেলাইয়ের বালাই নেই। অথচ নব্য প্রস্তর যুগেও পাথরের সূচ ছিল। সে সূচ অন্য কাজ করত। পরিধানের বেলায়, কাপড় জুড়ে জুড়ে পোশাক বানানোর চেয়ে কটিদেশে কাপড়ের একটি খণ্ড জড়িয়ে নেওয়া সহজ মনে হয়েছিল পূর্বনারী ও পূর্বপুরুষদের। শাড়ি সেই সরল আচ্ছাদনের উত্তরসূরী বা ফসিল।
সিন্ধুসভ্যতায় মাতৃমূর্তিরা কখনও সামান্য বস্ত্রখণ্ড আচ্ছাদিত। কখনও নিরাবরণ। ঢিলেঢালা বস্ত্রখণ্ড দেহে পেঁচিয়ে নেওয়ার সাক্ষ্য বহন করে প্রাচীন বৈদিক সভ্যতা বা প্রাচীন গ্রিক সভ্যতাও। মৌর্য যুগে সেলাইকৃত বস্ত্রের নজির মেলে মূলত অভিজাত-দেহে। সাধারণের ব্যবহারের উপযোগী সেলাই-করা জামাকাপড়ের প্রচলন, শোনা যায়, বেড়েছিল শক-দের আগমনের পর। আস্তে আস্তে এসেছে পাঞ্জাবি, চাপকান, কামিজ। স্পষ্টতই, সেলাই-করা জামা-ই প্রগতি৷ শাড়ি আদ্দিকালের অবশেষ। সেলাইকল যখন দেহের মাপে কাপড়কে কেটে-জুড়ে দিচ্ছেই, তখন কেন কসরৎ?
গেরুয়া শাড়ি পরিহিতা ভারতমাতা দেখা দিলেন অবনীন্দ্রনাথের আঁকাজোকায়। সে কালে শাড়িই পরতে দেখেছি আমরা কল্পনা-প্রীতিলতার মতো দামাল বিপ্লবিনীদের। কংগ্রেসের মেয়েদের পরিধানও শাড়ি। শাড়ি তখন স্বদেশিয়ানার মূর্ত প্রতীক।
শাড়ির গায়ে অন্ধ ঘরের গন্ধ— রোদ না পাওয়া আচারে যেমন থাকে। শ্রাদ্ধে বা পুজো-আচ্চায় মূল অংশগ্রহণকারী কী পরেন? সেলাবিহীন কাপড়— ধুতি বা শাড়ি। সেলাই ব্যাপারটাই নাকি ‘শুচি’ নয়। শাড়ি ঘিরে এমন নানা অযাচিত সংস্কারের পাহাড়।
একদিকে, শাড়ি পরলে তুমি ‘ভালো মেয়ে’, অতএব সম্মাননীয়া। অতএব শিক্ষিকা বা অধ্যাপিকার পোশাক শাড়ি ভিন্ন অন্য কিছু হবে কিনা, তা নিয়ে বিংশ শতাব্দীর শুরুতেও বিস্তর তরজা হয়েছিল এই রাজ্যে। অন্যদিকে, সরস্বতী পুজোর দিন মেয়েরা শাড়ি পরলে নাকি তাদের ‘বড়ো বড়ো দেখায়।’ এই ‘বড়ো বড়ো দেখানো’ মানে যে শিশু নারীর যৌন নারীতে উত্তরণ, তা বলে দিতে হয় না। একই পোশাক— একদিকে মেয়েকে ‘শুচি’ করছে। আরেকদিকে করছে পুরুষচোখে লোভনীয়। এত রকম গোলমেলে স্বীকৃতির ভার বহন করে শাড়ি৷ শাড়ির থেকে তাই কোনো না কোনো সময়ে নাক সিঁটকে দূরত্ব বজায় রাখতে চেয়েছেন আমার মতো কেউ কেউ।
আরও পড়ুন: শনিবারের কড়চা : শাড়ি
কবিতায় ছিল, ‘পরনে ঢাকাই শাড়ি, সিঁথিতে সিঁদুর’। অমনি শাড়িতে যোগ হয়েছিল সাবেক নারী-সৌন্দর্যের মাপকাঠি। আবার আরেক কবিতায় ছিল, ‘ধর্ষিতা বোনের শাড়ি, সেই আমার রক্তাক্ত জাতীয় পতাকা’। শাড়িতে তখন যোগ হল অসহায়তা। একদিন গলায় শাড়ি পেঁচিয়ে ঝুলে পড়েছিল আমারই পরিচিত কোনো মেয়ে। শাড়িকে সেদিন রাক্ষুসে লেগেছিল।
***
আবার এই যে শালীন শুচিশুভ্র নারীসৌন্দর্যের ধারণা, তাও কালে কালে বদলায়। এককালে যেভাবে শাড়ি পরতেন বাংলার মেয়েরা, তাকে আজ আর সুন্দর বা শ্লীল বলবেন কিনা সমালোচকরা, তা সন্দেহাতীত নয়। বাংলার মেয়েদের শাড়ি পরার ধরনটি ছিল ঔপনিবেশিক চোখে অশালীন। একবস্ত্রা নারী আর নগ্ন নারীতে তারা বড়ো একটা তফাৎ দেখত না। ঔপনিবেশিক প্রভুর দৃষ্টির উত্তরাধিকার বহন করল উপনিবেশ। যতক্ষণ নারী পর্দানসীন, ততক্ষণ সমস্যা নেই। কিন্তু বাইরে বেরোতে হলে, পার্সিদের মতো করে ব্লাউজ পরার চল হল। আর ব্রিটিশ মেয়েদের মতো করে শাড়ির তলায় পেটিকোট। জ্ঞানদানন্দিনী দেবী আনলেন ‘নিভি’ শাড়ি শৈলী— খানিক পার্শি, খানিক মারাঠি, খানিক বাঙালি ধাঁচ মিশিয়ে। সেইটে হল ‘মান্য’, অন্য ধরনটি হয়ে গেল ‘আটপৌরে’। ধারণ বদলালো, ধরন বদলালো; কিন্তু ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়ের’ যুগে শাড়িকে পরিত্যাগ করা সমীচীন মনে হল না৷ বরং গেরুয়া শাড়ি পরিহিতা ভারতমাতা দেখা দিলেন অবনীন্দ্রনাথের আঁকাজোকায়। সে কালে শাড়িই পরতে দেখেছি আমরা কল্পনা-প্রীতিলতার মতো দামাল বিপ্লবিনীদের। কংগ্রেসের মেয়েদের পরিধানও শাড়ি। শাড়ি তখন স্বদেশিয়ানার মূর্ত প্রতীক। কিন্তু সেই যে নারী রাজনীতিবিদরা শাড়ি পরা ধরলেন, তা যেন উত্তর-উপনিবেশেও ইউনিফর্মে পরিণত হল৷ আজও রাজনৈতিক নেত্রী শাড়ি ভিন্ন অন্য পোশাকে গ্রহণযোগ্য নন তত— তিনি ডান বা বাম যে পন্থীই হোন। শাড়ির তাহলে এক ইতিহাস যেমন আছে, তেমনই আছে রাজনীতি। শাড়ি নারীশরীরকে স্বীকৃত ‘ডিসিপ্লিনে’ বাঁধে৷
শাড়ির ডিকশনারিতে বডি-শেমিং-এর অ আ ক খ কখনোই ছিল না। সে নিরাকার, জলের মতো। যে তাকে ধারণ করে, তারই আকার নেয়৷ মোটা-রোগা-লম্বা-বেঁটেয় তফাৎ করে না৷
***
অথচ, এসবের জন্য শাড়িকে দায়ী করা যায় না। শাড়ির আশ্রয়-প্রশ্রয় বুঝতে আসলে সময় লাগে। দিল্লির ডিজাইনার লেহেঙ্গা বিপণী সেবার ঘোষণা দিল, তাদের লহেঙ্গা পরার জন্য নাকি মেয়েদের তন্বী হতে হবে। আবার, সুইমশুট পরা ছবি দেখলেই, সমাজমাধ্যমে হামলে পড়ে লোকজন; নারীকে শিখিয়ে দিতে যায়, কোথায় কোন মাপ বাঞ্ছনীয় ছিল। সেই সব মাতব্বরি ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে হবে, ঠিকই। কিন্তু শাড়ির ডিকশনারিতে বডি-শেমিং-এর অ আ ক খ কখনোই ছিল না। সে নিরাকার, জলের মতো। যে তাকে ধারণ করে, তারই আকার নেয়৷ মোটা-রোগা-লম্বা-বেঁটেয় তফাৎ করে না৷
কেটে-ছেঁটে খাপ মতো করে নেওয়া হয়নি বলেই শাড়ি উদার। পুজোর আগে কর্মসহায়িকা দিদিকে যখন জিজ্ঞাসা করি, কী নেবে, সে-ও বলে শাড়ি। বলে, ‘আমিও পরি, মেয়েও পরে।’ সেই কবেকার রীতি! শুধু পরে না, মেয়েরা পায় মায়ের শাড়ির উত্তরাধিকার। দিদিমার ন্যাপথলিন দেওয়া ট্রাঙ্ক খুলে যে সামান্য কটি গরদ, জামদানি, টাঙ্গাইল পাওয়া গিয়েছিল, মা, মাসি আর মামিমা প্রত্যেকে পেয়েছিলেন তার এক একটি। সতীর বাহান্নপীঠের মতো দিদিমা তাই রয়ে গেলেন এখানে সেখানে ছড়িয়ে, নানা আলমারির কোণে।
পুরোনো শাড়ির মূল্য তার গায়ের ঘ্রাণ মাফিক নির্ধারিত হয়। ননদের মেয়ের বিয়েতে ফলস্ পাড় বসানো শাড়ি পেয়েছিল ঝন্টিবৌদি। সে কি রাগ তার! দিলে নতুন শাড়ি দিক! ফলস্ লাগানো শাড়ি দেওয়া কি অপমান নয়? সাত-চড়ে-রা-না-কাড়া বাড়ির বউ বলে কি যা-ইচ্ছে-তাই? অথচ ঝন্টিবৌদির আলমারি আলো করে আছে যে চওড়া পাড় কটকি শাড়ি, সে তার হারিয়ে যাওয়া বন্ধুত্বের খড়কুটো। প্রাণের সইটি বলেছিল, চওড়া পাড়ে তাকে আরও বেঁটে লাগবে; এ শাড়ি ঝন্টিই নিক। ফলস্ তো বসানো ছিল তাতেও!
আরও পড়ুন: ফুলিয়ার হাতে বোনা টাঙ্গাইল
সেবার এক কন্যাসমা জিজ্ঞাসা করল, ‘কোয়ার্কি’ শাড়ি আছে কি আমার? এমন কিছুর নামই শুনিনি। সে বলল, শব্দটি ইংরেজিতে বুঝতে হবে। ‘কোয়ার্কি’, মানে ‘অদ্ভুত’। শাড়ি জুড়ে ডলাল্ড ডাক, বা ট্রাম গাড়ি, বা চায়ের ভাঁড়, হলুদ রিক্সা, হয় না অমন? মূলত সুতির আরামদায়ক সেই সব শাড়ি৷ সনাতনের তোয়াক্কা না করে যা ইচ্ছে ছেপেছে নয় গজ জুড়ে।
এমন শাড়ি পরত আমার এক বন্ধু। শাড়ির নিয়মকানুন তার মতো উদ্ভটমস্তিষ্ক-দের জন্য কালে কালে বদলেছে বৈকি। বদলেছে পরার ধরনও। বাহারি টপ বা কুর্তির সঙ্গে শাড়ি পরা চলে। আঁচল দেওয়ারও সতেরো রকম পন্থা বের করা গেছে। কীভাবে আঁচল দেবে, আদৌ আঁচল দেবে কিনা, সেসব মেয়েরা স্থির করছে নতুন করে। নতুন করে চোখরাঙানিও জারি হচ্ছে— শাড়ি পরলেই ‘ভালো মেয়ে’ হবে না তুমি; সুশীল শাড়ি সুশীল ভাবে পরাটা জরুরি। নিজস্ব যৌন যাপন, নিজস্ব খামখেয়ালের মালকিন যে ‘খারাপ মেয়েরা’, তারা এসবের তোয়াক্কা করছে না। শাড়ি, কী আশ্চর্য, তাদেরও প্রশ্রয় দিচ্ছে! শাড়ি আসলে শব্দের মতো। অমিত সম্ভাবনা তার।
বন্ধুর অদ্ভুত শাড়িগুলোর কটি রয়ে গেছে আমার কাছে। কিছুতেই বুড়োটে হবে না, এই পণ করে বন্ধুটি গাল ফুলিয়ে মিলিয়ে গিয়েছে অসীমে। সেই উদ্ভট শাড়ি দিয়ে কন্যাসমাকে খুশি করা গেল। কিছু উদ্ভটত্ব নদী হয়ে বয়ে গেল ভবিষ্যতের উদ্দেশে।
সেবার বাংলাদেশ থেকে এলেন রুখসানা কাজল। মেসেজ করলেন, ‘তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই।’ দেখা হল বার কয়েক। শেষ দিন বললেন, ‘দুইখান শাড়ি এনেছিলাম এখানকার দুই অনুষ্ঠানে পরার জন্য। আর ফিরিয়ে নিয়ে যেতে মন নাই। তুমি নেবে? ফলস্ বসানো কিন্তু। নতুন নয়।’ কেন মন নেই? কেন পথে ফেলে যাও দিনের সঞ্চয়? এসব প্রশ্ন করিনি। এ প্রশ্ন আলাদা করে করতে হলে, দুদিনের আলাপচারিতা বৃথা। বরং বিবাগী কন্যার স্নেহের ধন মাথায় নিয়ে ফিরি। এ-ও একরকম উত্তরাধিকার, পূর্বজা লেখিকার।
দিদিমার শাড়ি মা তাও পেল একখানি। মায়ের শাড়ি আমি পাব কি? শাড়ি পাওয়া মানে আত্মিক যোগাযোগ। সে আত্মার টান কখনও অনুভব করেছি কি নীরস, কঠিন, রুক্ষ্ম মায়ের সঙ্গে? তাহলে তার শাড়ি কী বা বহন করবে আমার কাছে?
হয়তো পারিশ্রমিকহীন কিছু ঘাম বহন করবে। রুক্ষ্মতার পানে তাঁর অবশ্যম্ভাবী পলায়নহীন যাত্রা বহন করবে। মায়ের শাড়ি থেকে কাঁথা হত৷ রান্নাঘরের পরিচ্ছন্ন ন্যাকড়া কয়েকটি। শাড়িরা শেষ রক্তবিন্দুটুকু নিংড়ে দিত, মায়ের মতো। সেসব কাঁথা-কানি, ন্যাকড়া-চোকড়া যে অতীতে কখনও শাড়ি ছিল, তা অবিশ্বাস্য হয়ে উঠত ক্রমে। যতটা অবিশ্বাস্য ছিল আমাদের কাছে মায়ের নরম কিশোরীবেলা। সেকালে মায়েদের সাদাকালো ছবি একটি করে থাকত অ্যালবামে। শাড়ি পরা, কিন্তু মাথা রাঙানো নেই, এমন। হয়তো পাত্রপক্ষকে পাঠানো ছবি। সে এক কোমল কিশোরী ছবি, যাকে ছিঁড়ে-খুঁড়ে, এঁফোড় ওফোঁড় করে, ব্যবহারোপযোগী কাঁথা কিংবা ন্যাতা বানানো হবে।
দৃষ্টির অভ্যাস, অভ্যাসের আরাম ছারখার করে শাড়িকে পুনরাবিষ্কার করতে শিখিয়েছেন পুরুষ মানুষ। ট্রলিং অগ্রাহ্য করে তারা তা ধারণ করে দেখালেন যে, যা সুন্দর, তা লিঙ্গনির্বিশেষেই সুন্দর। শেখালেন ট্রান্স নারীরাও। ‘ডিসিপ্লিন’ ভেঙে শাড়িকে পুনর্দখল করলেন তারা।
শাশুড়ি যবে থেকে বুঝলেন ছিরিছাঁদহীন নাইটি ছাড়া আর কিছু তাঁর পরা হবে না অথর্ব শরীরে, তবে থেকে তাঁর শাড়িগুলি ভার বর্তাল অন্যদের উপর। তাদের ভাঁজে ভাঁজে ন্যাপথলিন দেওয়া, অথবা দেওয়া শুকনো লংকা কালো জিরে৷ তাদের রোদে মেলা। বালিশ-বিছানার ওমে আর চাপে তাদের পাটে পাটে ইস্ত্রি হয়ে যাওয়া। এসব তদারকি তিনিই শুয়ে শুয়ে করেন। যেন ফেলে আসা দিন ঝেড়ে মুছে তুলে রাখছেন তাকে। আর পুরোনো বাড়িতে বরের দেওয়া দামি শাড়িখানি রয়ে গেছে, সে কথা ভেবে বিলাপও করেন। শশব্যস্ত কেজো লোকজনের সময় হয় না সে শাড়ি ফেরত আনার। হে ন্যাপথলিন, হে শুকনো লংকা-কালোজিরে টোটকা, তোমরা সে শাড়ির সহায় হোয়ো! সে স্মৃতিকে রেখো দংশনমুক্ত।
অথচ, চলৎক্ষম হলেও সে শাড়ি তাঁর ইহজন্মে আর পরা হত না। লালঘেঁষা যাবতীয় শেড তাঁকে পরানো যায় না। তবু মায়া রয়ে যায়। আমি তো সাদাটে শাড়ি বেমালুম পরে ফেলি। সাদার নাম ‘শূন্য’র বদলে ‘স্নিগ্ধ’ রাখি। তেমনই লালের নাম ‘সোহাগের’ বদলে ‘আগুন’ রাখা যায়। ‘ছারখার’ রাখা যায়। বেড়া ভাঙা যায়। চাইলে। যেমন করে দৃষ্টির অভ্যাস, অভ্যাসের আরাম ছারখার করে শাড়িকে পুনরাবিষ্কার করতে শিখিয়েছেন পুরুষ মানুষ। ট্রলিং অগ্রাহ্য করে তারা তা ধারণ করে দেখালেন যে, যা সুন্দর, তা লিঙ্গনির্বিশেষেই সুন্দর। শেখালেন ট্রান্স নারীরাও। ‘ডিসিপ্লিন’ ভেঙে শাড়িকে পুনর্দখল করলেন তারা।
আমার ক্ষেত্রে কবে থেকে পুনরাবিষ্কার শুরু হল? যবে শাড়ি পরার জন্য আর জোরাজুরি হল না। যবে রণক্লান্তরা ক্ষান্ত দিল। তখনই বোঝা গেল, একজন মাত্র মানুষের জন্য নয় গজ কাপড় ঠিক ততটাই অহৈতুকী, যতটা অহৈতুকী পৃথিবীর যাবতীয় শিল্প ও সাহিত্য। কান ধরে কবিতা পড়ানো যায় না। শাড়িকেও গায়ের জোরে ভালো বাসানো যায় না। সে ভালোবাসা যখন আসার, এমনিই আসে।
***
কলকাতার শীতে চিড়িয়াখানার ঝিল যখন মেরুদেশের পরিযায়ী পাখিতে পাখিতে ছেয়ে যায়, তখন নবনীতা দেবসেন বলেন, ‘ঠিক সেন সাদা খোলের হাজারবুটি টাঙ্গাইল শাড়ি।’ এ কথা লেখা ছিল মেয়ের এক বইতে। তাই আমরা এক দুপুরে হাজারবুটি টাঙ্গাইল খুঁজেছিলাম দক্ষিণাপণ জুড়ে। আমরা আসলে নারী শিল্পীর দেখার চোখটি চিনতে চাইছিলাম। পূর্বনারীর দেখার চোখ যেমন ধরা থাকে তাঁর বইয়ের সংগ্রহে, তাঁর লেখায়, তেমনই তাঁর শাড়িতেও থাকে।
আমার শাড়ি উত্তর প্রজন্মকে কী দেবে? নানা প্রদেশের শাড়ি যখন পাশাপাশি বসত করে আমার আলমারিতে, তখন মনে হয়, আস্ত ভারতবর্ষ দিয়ে যাব। যে ভারতবর্ষ মুছে যাচ্ছে।
গড়িয়াহাটের দোকানী বলেন, শান্তিপুরের যুবকরা কেরালায় পাড়ি দিচ্ছেন। কিংবা রাজমিস্ত্রী বা ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রী হয়ে যাচ্ছেন। কাপড় বুনছেন সেই বৃদ্ধরা, যাঁরা আর কিছু পারবেন না। সাধ্য কি কালের গ্রাস রুখে দিই? সেবার তাঁতিদের সম্মেলনে যোগ দিতেই বেনারসে গেছিলাম। তাঁরাও বললেন, হ্যান্ডলুমের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া স্বপ্নাতীত। এক মাস লাগবেই একটা বেনারসি সুচারুভাবে বুনতে। নিদেন কুড়ি দিন। পাওয়ারলুম প্রায় একই দেখতে শাড়ি দিনে শয়ে শয়ে বানায়। তাছাড়া, চিরকাল হিন্দু মেয়েদের বিয়ে হয়েছে যাঁর বোনা শাড়িতে, সেই তাঁতিকে এখন রাস্তায় বেরোলে ‘কাট্টা’, ‘মুল্লা’ শুনতে হয় — এ-ও বড়ো বেদনার। এঁরাও উধাও হবেন।
উদ্বৃত্ত যদি ব্যয় করতেই হয়, তা বৃদ্ধ তাঁতের টানা আর পোড়েন চালু রাখুক না হয় আর কিছু দিন! যুবকের কেরালাগমন আরও দুদিন আটকালে মন্দ কী? ওঁরা বলেন, ‘রাতে গাঁয়ে মেশিনের সুতো ঢোকে, টের পাই।’ ওঁরা আরও বলেন ‘এমন তো কথা ছিল না। সরকারি খাদি প্রতিষ্ঠানেও মেশিনে কাটা সুতো ঢুকছে।’ কলমিলতা, খুন্তিলতা পাড় নিশ্চিহ্ন হওয়ার আগে তাই কিনে রাখি।
আবার গোয়ার উপকূলের তাঁতির বাড়ি থেকে যে শাড়ি আসবে, ওঁরা বললেন, একমাত্র সাধারণ ভারতীয় ডাকেই তা আসতে পারবে। ও গ্রামে বেসরকারি ক্যুরিয়ার নেই। সে শাড়ির পথে দেরি হলে আমি তাকে খুঁজতে পোস্টাপিসে হত্যে দিই৷ তার গায়ে অচেনা ভারতের মেছো গন্ধ খুঁজি। বিহারের মধুবন গাঁয়ে আমার শাড়ির গায়ে মধুবনি আঁকা হয়। তর সয় না। ওঁরা বলেন, সেখানে খুব জোর বৃষ্টি নেমেছে। রোদ না উঠলে শাড়ির রং শুকায় না। দেরি হবে। অমনি আমার নাকে সোঁদা গন্ধ আসে। শরীর শীতল হয় অনাগত ঠান্ডা হাওয়ায়।
শাড়ি জীবনের মতো। টানা আর পোড়েনের ছন্দে দুজনেরই গায়ে ফুল ফোটে। দুজনেই ফেটেফুটে ছিঁড়েখুঁড়ে যায়। পরমযত্নে তাদের রিফু করে নিলে বহুদূর সঙ্গ দেয়। আবার শাড়ি যখন এলিয়ে পড়ে থাকে, তখন সে নদীর মতো। বহতা। পথের মতো। অনিঃশেষ।