No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    খোড়োকিস্তি : বাংলার কারিগরি কৌশলের নিদর্শন গেঁওখালির এই নৌকা

    খোড়োকিস্তি : বাংলার কারিগরি কৌশলের নিদর্শন গেঁওখালির এই নৌকা

    Story image

    খোড়োকিস্তি

    কটা সময় ছিল যখন বাংলায় স্থলপথের চাইতে অনেক বেশি ব্যবহার হতো জলপথ। চলত বাণিজ্য, খাদ্যদ্রব্য থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিংবা পোশাক-পরিচ্ছদের আমদানি-রপ্তানি। বাংলার নদী জুড়ে নানা ধরনের নৌকা চলত এই সময়ে। ডিঙি, ডোঙা, বজরা, পানসি, খেড়ো, ময়ূরপঙ্খী, সুলতানি, সাঙ্গারা, সাঙ্গোর, মেড়লি – নানা নামের নৌকা, প্রাচীন বাংলা তথা ভারতের সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে।

    আজ থেকে এক শতাব্দী আগে শুধুমাত্র বাংলাদেশেই আনুমানিক ১৭৯টি ভিন্ন ধরনের নৌকো ছিল। গত তিরিশ বছরে ছোট্, সাঙ্গারা, সাঙ্গোরের মতো নৌকোগুলি হারিয়ে গেছে, গত দশ বছরে হারিয়েছে বেতনাই, সুলতানি, খোড়োকিস্তি।

    পশ্চিমবঙ্গের নৃতত্ত্ববীদ ড. স্বরূপ ভট্টাচার্যের জীবনের সমস্তটা জুড়ে রয়েছে বাংলার নৌকা। নৌকার প্রতি তাঁর অদম্য ভালোবাসা ও আগ্রহের কারণে তিনি পশ্চিমবঙ্গের ‘নৌকা মানব’ নামে খ্যাত হয়েছেন। জীবনের বিগত ২৬টি বছর শুধু নৌকা নিয়ে চর্চা করে কাটানোর পরেও, আজও তিনি একই রকম উৎসাহের সঙ্গে সহজ সরল ভাষায় নৌকো নিয়ে তিনি এক টানা বলে যেতে পারেন। তাঁর নৌ-প্রেম ও এ বিষয়ে জ্ঞানের সম্ভার মুগ্ধকর। বঙ্গদর্শন.কম-কে সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, “নৌকোর ব্যবহার কমেছে। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে যত সংখ্যক নৌকো ছিল, সেই সংখ্যাটা অনেক কমে গেছে এবং ভবিষ্যতে আরও কমবে। তবে যতদিন জল আছে, মানুষের মাছ ধরা আছে, নৌকো থাকবেই।… নৌকোর মিস্ত্রি চিরকাল কমই ছিল। তবে ইদানীং নদীর নাব্যতা হারিয়ে গেছে, খেয়া পারাপারের বদলে এখন ব্রিজ পেরোয় মানুষ, তাই নৌকোর চাহিদা কমেছে। পেশা পাল্টে নৌ কারিগরেরা এখন ইটভাটায় বা দৈনিক শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে। নৌকোর অর্ডার এলে তবেই তারা নৌকো বানায়। দক্ষতানির্ভর একটা পেশা এভাবে হারিয়ে যাচ্ছে।”

    আজ থেকে এক শতাব্দী আগে শুধুমাত্র বাংলাদেশেই আনুমানিক ১৭৯টি ভিন্ন ধরনের নৌকো ছিল। তবে প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বেশিরভাগ নৌকা তাদের ব্যবহারযোগ্যতা হারিয়ে, নাম লিখিয়েছে বাদের খাতায়। গত তিরিশ বছরে ছোট্, সাঙ্গারা, সাঙ্গোরের মতো নৌকোগুলি হারিয়ে গেছে, গত দশ বছরে হারিয়েছে বেতনাই, সুলতানি, খোড়োকিস্তি। ড. স্বরূপ ভট্টাচার্য বলেন, “…পশ্চিমবঙ্গে আমি কাজ করে দেখেছি ৩০ রকমের নৌকো ছিল। তার অনেকগুলোই শেষ হয়ে গিয়েছে আজ। আর ব্যবহার হয় না বলে সেই নৌকোগুলো বানানো বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তবে আমরা জানি না যে ১০০ বছর আগে ৩০ সংখ্যাটা ১০০ বা তার বেশি ছিল কিনা।”

    বাংলার ‘নৌকো মানব’ ড. স্বরূপ ভট্টাচার্য

    বাংলার ঐতিহ্যবাহী খোড়োকিস্তি নৌকার প্রতিলিপি নিজের হাতে, অসামান্য কারিগরি দক্ষতায় নির্মাণ করেছেন বাংলার ‘নৌকো মানব’ স্বরূপ ভট্টাচার্য।

    ড. স্বরূপ ভট্টাচার্যের তৈরি বিবিধ রকমের নৌকাগুলির মধ্যে অন্যতম হল ‘খোড়োকিস্তি’। বাংলায় অন্য সে সকল ‘খোল’ গড়নের নৌকো দেখতে পাওয়া যায়, খোড়োকিস্তি তার চাইতে বেশ খানিকটা আলাদা। এই নৌকো তৈরির ক্ষেত্রে সবার আগে বসানো হয় নৌকোর ভিতরের খাঁচা। এতে থাকে এক বিশেষ ধরনের পাল, যার নাম ‘লাগ’। নৌকোটির গতি নিয়ন্ত্রণ ও দিক নির্ধারণের ক্ষেত্রে ‘লাগ’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। খোড়োকিস্তি-র জন্ম পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার গেঁওখালি অঞ্চলে। মুখ্য কাজ, সুন্দরবন থেকে প্রায় ৩৫০-৪০০ কাহন খড় নিয়ে এসে তা কলকাতায় জোগান দেওয়া। খড় থেকেই নৌকোর নাম খোড়োকিস্তি।

    মজার বিষয় হল, খড় বোঝাই খোড়োকিস্তি নিজে নিজে চলতে পারে না। ‘ছোট্’ নামক একটি ছোটো নৌকো একে টেনে নিয়ে এগিয়ে চলে। পরবর্তীকালে যদিও ছোট্-এর বদলে মোটরচালিত লঞ্চ ব্যবহার হত। তবে বর্তমানে এমন কাজের আর কোনো প্রয়োজন না থাকায় খোড়োকিস্তি গুরুত্ব হারিয়েছে। বাংলার কোথাওই তাই আর এই নৌকো দেখতে পাওয়া যায় না। শুধুমাত্র ঐতিহাসিক গুরুত্বের জন্যই নয়, কারিগরি কৌশলেরও এক অসাধারণ নিদর্শন খোড়োকিস্তি। এই ঐতিহ্যবাহী নৌকোর প্রতিলিপি নিজের হাতে, অসামান্য কারিগরি দক্ষতায় নির্মাণ করেছেন নৃতত্ত্ববিদ ড. স্বরূপ ভট্টাচার্য। তাঁর নির্মিত খোড়োকিস্তি নৌকোর রেপ্লিকা মডেলটি (১৭X৭X১৯ সেমি) পাওয়া যাচ্ছে কলকাতার বিপণি দ্য বেঙ্গল স্টোর-এ। এখান থেকে এটি সহজেই সংগ্রহ করা যেতে পারে। এই প্রথম বাংলার নৌকোর মডেল সকলের হাতের কাছে।

    তবে, শুধুমাত্র খোড়োকিস্তি নয় কাঠ, ধাতু ও কাপড় ব্যবহার করে নিজের হাতে অজস্র নৌকোর মডেল তৈরি করেছেন স্বরূপবাবু। নৌকোগুলির বৈজ্ঞানিক ও ঐতিহাসিক যথোপযুক্ততা এবং নিখুঁত কারিগরি বিশেষ দ্রষ্টব্য। শহর কলকাতার বুকে তাঁর গড়া নৌকোর মডেলগুলি নিয়ে একাধিকবার প্রদর্শনীর আয়োজন হয়েছে ইতিমধ্যেই। নৌকোর সুদীর্ঘ ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে কেন্দ্র করে তিনি একাগ্রতার সঙ্গে গবেষণা করে গেছেন দীর্ঘদিন ধরে। যাত্রা করেছেন ডেনমার্কের ‘ভাইকিং শিপ মিউজিয়াম’ থেকে কাঁকুড়গাছির ‘হেরিটেজ বোটস অফ বেঙ্গল’ গ্যালারি অবধি। হুগলির বলাগড়ের নৌশিল্প ও নৌ কারিগরদের সঙ্গে থেকে এ সংক্রান্ত তাদের যাবতীয় অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিয়েছেন তিনি।

    প্রসঙ্গত, বলাগড়ের কমবেশি ২০টা কারখানা সারা বছর নৌকো বানায়। চাহিদা অনুযায়ী সেটা ৩০-৩৫ –এও পৌঁছে যায়। বেশিরভাগ নৌকো তৈরি হওয়ার পর কারখানা অর্থাৎ নৌ কারিগরের বাড়িতেই সাজিয়ে রেখে দেওয়া হয় ক্রেতার অপেক্ষায়। ক্রেতা নৌকোটা কিনে নিলে রিকশা ভ্যান অথবা নদীপথে পৌঁছে দেওয়া হয়।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @