ভারতীয় ও আমেরিকান ভারতীয় মহিলা তথ্যচিত্র নির্মাতাদের পাশে বিচিত্রা কালেকটিভ

বিচিত্রা কালেকটিভ (Bitchitra Collective: Indian Women in Documentary), মহিলা ও নন বাইনারি তথ্যচিত্র পরিচালকদের জন্য বিশেষ ফেলোশিপ/অনুদান ও মেন্টরের ব্যবস্থা করেছে। এবছর ভারতীয়, আমেরিকান ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত পরিচালকদের মধ্যে থেকে সাতজনকে নির্বাচিত করা হয়েছে। বছরব্যাপী মেন্টরশিপ পাওয়ার পাশাপাশি স্বল্প/পূর্ণ দৈর্ঘ্যের তথ্যচিত্র প্রকল্পের জন্য ২০০০ ডলার (ভারতীয় মূল্যে প্রায় ১ লক্ষ ৬৪ হাজার) অনুদানের ব্যবস্থা করেছে বিচিত্রা কালেকটিভ। তথ্যচিত্র বা প্রামাণ্যচিত্র সবসময় দর্শকদের সত্যের সামনে দাঁড় করায়। একটি দেশ এবং তার সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতি ও জনতার মনমর্জি বোঝার জন্য তথ্যচিত্র খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ভারতীয় তথ্যচিত্রও ব্যতিক্রমী কাজ করে চলেছে বিশ্বের নিরিখে। সেখানে এ দেশে একটিও সিনেমাহল নেই যেখানে তথ্যচিত্র মুক্তি পায়। এমনকি হাউজফুলের সঙ্গেও তথ্যচিত্রের কোনো সম্পর্ক তৈরি হল না। অথচ এমনটা হবার কথা ছিল না। কয়েকটি চলচ্চিত্র উৎসব আর ওটিটি ছাড়া তথ্যচিত্র কীভাবে পৌঁছে যাবে সাধারণ মানুষের কাছে?
বিচিত্রা কালেকটিভ সদস্যদের নির্মিত তথ্যচিত্র
তথ্যচিত্র নির্মাতাদের পাশে দাঁড়াতে জরুরি তহবিল সংগ্রহের জন্য কোভিড মহামারীর সময় শুরু হয়েছিল বিচিত্রা কালেকটিভ। এ প্রসঙ্গে বিচিত্রার অন্যতম সদস্য তথা তথ্যচিত্র নির্মাতা ফারহা খাতুন (Farha Khatun) বঙ্গদর্শন.কম-কে বলেন, “কোভিডের সময় আমরা সবাই ভাবছিলাম যে, চারদিকে এত মানুষ মারা যাচ্ছেন, আমরা তাঁদের জন্য কী করতে পারি! আমাদের গ্রুপের প্রায় সকলেই তথ্যচিত্র নির্মাতা। ঠিক করলাম, মহিলা তথ্যচিত্র পরিচালকদের জন্য একটা গ্র্যান্টের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। গত বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কালার কংগ্রেস (Color Congress) সংগঠন দুই বছরের জন্য আমাদের বিচিত্রা কালেকটিভে ফান্ডের ব্যবস্থা করে। সেই অনুদান থেকে আমরা বিভিন্ন অনুষ্ঠান করি, এমনকি আমাদের গ্রুপের একজনকে জরুরি মেডিক্যাল ফান্ডের ব্যবস্থাও করে দিই।”
ফারহা খাতুন
ফিল্মস ডিভিশন (Films Division of India) বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ভারতীয় তথ্যচিত্র নির্মাতারা বিকল্প রাস্তা খুঁজে চলেছেন। আজ বিচিত্রা কালেকটিভের মতো জায়গা তৈরি হবার ফলে নির্বাচিত সাতজনকে অনুদানের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। ২০২১ সাল থেকে তাঁদের নিজেদের অন্যান্য কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয় নানান বিষয় নিয়ে কথোপকথন এবং যতজন এই গ্রুপে রয়েছেন, সেইসব মহিলা ও নন বাইনারি পরিচালকদের একটা তথ্যপঞ্জি তৈরি করা হয়। বিচিত্রা কালেকটিভের যাত্রা শুরু হয় একটি ফেসবুক গ্রুপ থেকে। সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন নিষ্ঠা জৈন, মৃদু চন্দ্র, পৌলোমি দাস, ফারহা খাতুন, বৈশালী সিনহা, প্রেরণা ঠাকুরদেশাই, জুহি শর্মা প্রমুখেরা।
এবছর ভারতীয়, আমেরিকান ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত পরিচালকদের মধ্যে থেকে সাতজনকে নির্বাচিত করা হয়েছে। বছরব্যাপী মেন্টরশিপ পাওয়ার পাশাপাশি স্বল্প/পূর্ণ দৈর্ঘ্যের তথ্যচিত্র প্রকল্পের জন্য ২০০০ ডলার অনুদানের ব্যবস্থা করেছে বিচিত্রা কালেকটিভ।
বিচিত্রা কালেক্টিভ আসলে কী: ভারতীয় বংশোদ্ভূত ১৫০+ তথ্যচিত্র নির্মাতাদের একটি ক্রমবর্ধমান সংগঠন, যা শিল্পীদের কাজ আরও অসংখ্য মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে এবং যথাযথ নেটওয়ার্ক তৈরি করতে বিশেষ ভাবে সাহায্য করে। সদস্যরা মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতে অবস্থিত। তাঁরা কেউ কেউ পরিচালক, প্রযোজক, সম্পাদক, ফিল্ম প্রোগ্রামার, সমালোচক অথবা চলচ্চিত্র অধ্যাপক, রেডিও ও পডকাস্ট গল্পকার, চিত্রগ্রাহক এবং সম্পাদক। ফারহা খাতুন বঙ্গদর্শন.কম-কে জানিয়েছেন, “আমরা মূলত মহিলা এবং নন-বাইনারী শিল্পীদের জন্য কাজ করছি। যাঁদের কাজ বর্তমান বৈশ্বিক এবং স্থানীয় পরিস্থিতির সঙ্গে প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলি তুলে আনছে। সমষ্টিগত বা পৃথক শিল্পী সকলকেই আমরা গুরুত্বের চোখে দেখতে চাই।”
বিচিত্রা কালেকটিভ : ইন্ডিয়ান উওম্যান ইন ডক্যুমেন্টারি
সম্প্রতি একটি প্রেস বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, “সাতজন তথ্যচিত্র নির্মাতাকে চূড়ান্ত হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এই চূড়ান্ত সাতে পৌঁছানো আমাদের পক্ষে খুব কঠিন সিদ্ধান্ত ছিল। প্রত্যেক নির্মাতাকে তাঁদের প্রকল্পগুলির জন্য শুভকামনা জানাই। আশাকরি, এই প্রতিভাবান চলচ্চিত্র নির্মাতারা তাঁদের প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা পাবেন।” সাতজন অনুদান প্রাপকরা হলেন দেবলীনা মজুমদার, মুনতাহা আমিন, বিনীতা নেগি, আশিয়া চ্যাকো ল্যান্স, নূপুর আগরওয়াল, টিনা কৌর পস্রিচা এবং রাজভী দেশাই।
দেবলীনা মজুমদার
ভারতীয় বংশোদ্ভূত ১৫০+ তথ্যচিত্র নির্মাতাদের একটি ক্রমবর্ধমান সংগঠন, যা শিল্পীদের কাজ আরও অসংখ্য মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে এবং যথাযথ নেটওয়ার্ক তৈরি করতে বিশেষ ভাবে সাহায্য করে। সদস্যরা মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতে অবস্থিত।
ভারতের মতো দেশে এই ধরনের অনুদান এবং কথার আদানপ্রদানের জন্য উন্মুক্ত পরিবেশ কতখানি গুরুত্বপূর্ণ? এ প্রসঙ্গে বিচিত্রা কালেকটিভের অন্যতম ফেলো এবং তথ্যচিত্র নির্মাতা দেবলীনা মজুমদার (Debalina Majumder) বঙ্গদর্শন.কম-কে জানিয়েছেন, “স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতাদের জন্য অনেক জায়গাই এখন সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। সেখানে কয়েকজন তথ্যচিত্র নির্মাতারাই আবার নানারকম কালেকটিভ বা ফেলোশিপ চালু করেছেন। এটা সত্যিই প্রশংসাযোগ্য। থেমে গেলে চলবে না, এভাবেই আমাদের নিজেদের জন্য একটা জায়গা তৈরি করে নিতে হবে। তাছাড়া শুধুমাত্র অনুদান নয়, দলগত ভাবে কাজ করতে শেখায় এই ধরনের উদ্যোগ। গুরুত্বপূর্ণ সব পরিচালক/প্রযোজকদের মেন্টর হিসেবে পাওয়া আনন্দের। বিচিত্রা কালেকটিভের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।”
সঠিক তথ্য পরিবেশনের মধ্যে একপ্রকার যাচাই করা সত্যতা থাকে। সে সত্যতা পরবর্তীকালে গবেষণার কাজে প্রবল সাহায্য করে। এক্ষেত্রে তথ্যচিত্রের ভূমিকা অসীম। ভারতে তথ্যচিত্র বা প্রামাণ্যচিত্র এখনও, এই ২০২৩ সালেও বিনোদনের অন্যান্য মাধ্যমগুলির তুলনায় খানিক পিছিয়ে৷ এর মধ্যে অবশ্যই কিছু রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক কারণ রয়েছে৷ তথ্যচিত্রের মধ্যে তথাকথিত বাজারি উপাদান কম। প্রযোজকের লাভ-ক্ষতির অঙ্কে আসে কেবল শূন্য৷ অতএব এই মাধ্যমটি ভারতবর্ষীয় স্ট্রাকচারে খানিক প্রান্তিক হয়েই থেকে গেছে। কারণ ওই একটিই, পণ্যের সঙ্গে তথ্যচিত্রের দূরত্ব। যদিও পরিচালকরা হাল ছাড়েননি৷ স্ব-স্ব উদ্যোগে, কখনও বেসরকারি বা সরকারি সহায়তায় নানান আঙ্গিকে তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন, আজও করছেন। বিচিত্রা কালেকটিভের এমন উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাচ্ছেন ভারতীয় এবং অন্যান্য দেশের তথ্যচিত্র নির্মাতারা।
বিচিত্রা কালেকটিভ এবং নির্বাচিত ফেলোদের সম্পর্কে আরও তথ্য জানতে দেখুন: https://bitchitracollective.org/