বিষ্ণুপুরের কামান

বিষ্ণুপুর আজ বাংলার বুকে এক চমৎকার পর্যটন স্থান। লোকে ঘুরে ঘুরে সেখানে দেখে বাংলার চালামন্দির, যুগল চালামন্দির ইত্যাদির মনোরম স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য। বাংলা হল জল-মাটির দেশ, এখানে পাথর তেমন মেলে না। তা বলে কী নগর দেবতার মন্দির তৈরি হবে না? বাংলার শিল্পীরা মাটি দিয়ে ইট বানিয়ে আর সেই ইট পুড়িয়ে তৈরি করে ফেললেন লাল পোড়া মাটির আশ্চর্য সব মন্দির। শুধু তাই নয় ভারতের ধ্রুপদী মন্দিরগুলির মত সেই পোড়ামাটির মন্দিরে তারা বসিয়ে দিলেন আশ্চর্য সব নকশাদার ফলক। এই সব যখন চলছিল তখন বিষ্ণুপুর ছিল বীর মল্লরাজাদের রাজভূমি। আজ সেই পর্যটন স্থানে যে সব দোকানপাট রয়েছে তারা বিক্রি করেন বিষ্ণুপুরের রাজকীয় পোড়ামাটির ঘোড়া। কিন্তু তারই মাঝে দোকানদাররা হেঁকে বলেন ‘দাদা একটা দল মাদল নিয়ে যান। এমন কামান চালিয়ে ছিলেন বর্গী হানার যুগে স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। আমাদের দেশে তিনি হলেন গিয়ে মদন মোহন।’
দোকানদারের কথার সূত্র ধরে আমাদের মন পারি দিতে পারে সেই ১৬০০ খ্রিঃব্দের বাংলা মানচিত্রে। তখন হল যুদ্ধের বাংলা। আজ বর্গী আসে তো কাল আসে অন্য দেশের রাজা। এমন এক বর্গী হানার দিনে রাজা বীর হাম্বির দেখলেন মদন মোহনের জন্য তৈরি মন্দির থেকে বেরিয়ে এসে স্বয়ং ঠাকুর কামান চালাচ্ছেন দুর্ধর্ষ বর্গীদের দিকে। সেই থেকে এই দল মাদল কামানটি বাংলার বুকে বীরত্বের প্রতীক হয়ে রইলো। কামানের নামটিকে একটু শিকড়ে গিয়ে ভাঙলে দেখা যায় এর নাম হল ‘দল মর্দন’ অর্থাৎ দলকে (বর্গীর দলকে) যে কামান মর্দন মানে বিনাশ করেন।
এতো গেল ভগবানের মাহাত্ম্য। কিন্তু এর পিছনে লুকিয়ে আছে বাংলার কামার সম্প্রদায়ের যুদ্ধ কৌশলের গল্প। লোহা দিয়ে যে কামার হাঁড়ি-কড়াই কিংবা ধানকাটার কাস্তে বানাতে ব্যস্ত সেই কামার সম্প্রদায় এবার মেতে উঠলেন শত্রুকে বাঘ বন্দী খেলায়। সে তৈরি করতে লাগলো নানারকমের লোহার ছিটকিনি, খিল ও তালা। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার অন্য ভাবে ভাবেন। সেই অন্য ভাবার লোকগুলি এবার বানাতে লাগলেন কামান। তারা ভেবেছিলেন শুধুমাত্র ঢাল তরোয়াল বর্ষা বল্লম দিয়ে শত্রুকে রোখা যায় না। বাংলার এই কামারদের কথা আজ আর জানা যায় না। যদিও গুটি কয়েক পুঁথিপত্রে কিংবা কোন কোন কামানের গায়ে খোদিত অক্ষরে অপাংক্তেয় ভাবে রয়ে গেছে সেই সব কামারদের নাম। যেমন- এই দল মাদলের বিশ্বকর্মা জগন্নাথ কর্মকার। পাঠকদের একটু মনে করিয়ে দেওয়া যাক মুর্শিদাবাদের হাজার দুয়ারির কাছে একটি কামান আছে যার নাম বাচ্চাওয়ালি তোপ। এটিও তৈরি করেছিলেন বাংলার আরেক কামার জনার্দন কর্মকার।
ফিরে আসি ফের দলমাদল প্রসঙ্গে এটির নির্মাতা সত্যিকারের এক মানুষ ‘জগন্নাথ’। নামের মানুষটি থাকেন বাংলায়। কিন্তু মিথের দেবতাটি থাকেন ওড়িষার পুরীতে। তা হলে কী বলতে হয় স্বয়ং জগন্নাথ (কর্মকার) দল মাদল কামানটি দেগে ছিলেন?