ঘোড়া ডুম সাজে

থানের ঘোড়ার এমন সাজগোজ বাংলা আগে দেখেনি কখনও। ঘোড়ার পিঠে নকশাদার আসন, মুখে জিন আর সারা অঙ্গ জুড়ে রাজবেশ, অলংকারের মহিমা। সব মিলিয়ে লড়াইয়ে যাওয়ার জন্যে যেন সাজো সাজো রব। সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল হাতিগুলিও সেজে উঠেছে যোদ্ধার বেশে। এমন লড়াকু চেহারার হাতি আর ঘোড়া আজও বিষ্ণুপুর অঞ্চলের ডাকসাইটে লোকশিল্প। বাঁকুড়ার পাঁচমুড়ার শিল্পীরা আপন ছন্দে দীর্ঘদিন ধরে বানিয়ে চলেছেন এমন পুতুল। কিন্তু থানের ঘোড়া সহসা কেন এরকম রূপ বদল করে লড়াইয়ের পোশাক পড়ল সে কথা বুঝতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে বর্গী হানার বাংলার সময় ঘড়িতে।

বাংলা মুলুকের রাজপাটে বিষ্ণুপুর সেদিন সাতমহলা রাজবাড়ি, সায়র আর ধ্রুপদীগানের তীর্থ হয়ে উঠেছে। মল্ল রাজাদের বীর কাহিনিরও অনেকটাই লেখা হয়েছে রক্ত মাখা সোনা জলের আলপনায়। তবুও বীরচর্চায় খামতি নেই ওদেশে। বংশ পরম্পরায় সিংহ দেব রাজারা তখন রাজপাটের দায়িত্ব নিয়ে সামাল দিচ্ছেন নিজেদের রাজত্ব। বলতে গেলে বাঁকুড়া, বর্ধমান, বীরভূম তো আছেই সঙ্গে জুড়ে আছে মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, এবং ছোটোনাগপুরের অনেকটা অংশ। এসব অঞ্চল নিয়েই আদি রাজা বীর হাম্বিরের গর্বের মল্লভূম। বীর হাম্বির তাঁর সময়কালেই কর্মকার সম্প্রদায়ের মানুষজনদের এনে শুরু করেছিলেন মল্লভূমে লোহার কামানের প্রচলন। তাই এদেশ তত দিনে পরিচিত হয়ে গিয়েছে বীর রাজাদের দেশ বলে। এরকমই একটা সময়কালে সন ১৭১২ সালে মল্লভূমের রাজা হলেন গোপাল সিংহ দেব। তাঁর রাজত্ব কালের শেষ পর্বে বর্ধমানের দাইহাটে তাঁবু ফেললেন দুর্ধর্ষ বর্গী নেতা ভাস্কর পণ্ডিত। সেটা সন ১৭৪২। পূর্ব বর্ধমানের এই অঞ্চল তখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন ভাস্কর পণ্ডিতের মারাঠা দস্যুরা। এসব দেখেই লড়াই করার প্রস্তুতি নিয়ে নিলেন গোপাল সিংহ দেব। বর্গীরা যখন মল্লভূমের দুয়ারে প্রায় এসে পড়ল তখন লোকে দেখল ঘোড়া শাল থেকে ঘোড়া, হাতিশাল থেকে হাতি-রা সব রণসাজে বেরিয়ে আসতে লাগল। দলমাদল তোপ দাগল হৈ হৈ করে। রব উঠল ‘ভাস্কর পণ্ডিত নিপাত যাও’। বাঙলার ছড়ায় লেখা হল ‘আগে ডুম বাগে ডুম ঘোড়া ডুম সাজে’। ছেলেরা নিজেদের ঘরোয়া খেলায় হাঁটু বাজিয়ে বলতে লাগল এমন ছড়া। সে এক আকাশ বাতাস কাঁপানো উন্মাদনার খেলা হয়ে উঠল হাঁটু বাজানো ‘আগে ডুম বাগে ডুম’। গ্রামীণ খেলায় সেদিন যুদ্ধের রব।

ওদিকে পাঁচমুড়ার শিল্পীরাও আর বসে রইল না। তাঁরা হাতে টেপা ঘোড়া আর হাতির গায় জুড়ে দিলেন নানা অলঙ্কার। শুধু তাই নয় চেহার চরিত্রে ঘোড়াগুলি ছোটখাটো আকার আকৃতি থেকে বেরিয়ে এসে লম্বায় চওড়ায় অনেকগুণ বেড়ে গিয়ে বেশ একটা রাজবেশ ধারণ করল। উটের মতো লম্বা গলা, বাঁশপাতার মতো কান, বিস্ফারিত চোখ তাতে আবার কাজল টানা দাগ, কপালে নক্সাদার রাজতিলক সাজ, সব মিলিয়ে এক অসাধারণ কর্মকাণ্ড। হাতিগুলিও রাজবেশে অনন্য। আসলে বঙ্গভূমের মল্ল জমিতে বর্গীর সঙ্গে লড়ে যাওয়ার এমন প্রচেষ্টাকে গর্বের সাজ পরিয়ে দিতেই শিল্পীর এমন আয়োজন।
বিষ্ণুপুর রাজবাড়ির আশেপাশের বাজার এলাকায় আজও মেলে এমন ঘোড়া আর হাতি। ইতিহাসের পথ বেয়েই মানতের ঘোড়া লড়াইয়ের ঘোড়ার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। এমন শিল্পকর্ম সেদিন মল্লভূমের মানুষের বীরত্বের প্রতিভূ হয়ে উঠেছিল। ঘোড়ার সঙ্গে আজও তাই দোকানদার বিক্রি করেন জগন্নাথ কর্মকারের বানানো ‘দলমাদল কামান’ খেলনাও। সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়ার সাজ আর আকার বেড়েছে। তবে এমন ঘোড়া আজও থানে দেয় মানুষ আর নাগরিক সমাজে এসব ঘোড়া হাতির স্থান হয়েছে গৃহসজ্জায়। যদিও ইতিহাস আড়ালে রয়ে যায় সত্য সূর্যের মতোই।