No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    বিষমুক্ত খাবার অর্জনের যুদ্ধে সৈনিক ভৈরবের কথা

    বিষমুক্ত খাবার অর্জনের যুদ্ধে সৈনিক ভৈরবের কথা

    Story image

    গল্পটা প্রথমত এক সৈনিকের। তবে গল্প যত এগোবে দেখা যাবে সৈনিকের সংখ্যা মোটেই এক নয়। যেন একটা সেনাবাহিনীরই ছায়া দেখা যাচ্ছে। আর এই বাহিনীকে যদি সেনা বাহিনী বলি, তবে সেই সেনাবাহিনীর প্রধান কমান্ডারের নাম কৃষি বিজ্ঞানী ডঃ দেবল দেব। গল্পের শুরু বাঁকুড়ার পাচাল গ্রামে। কী হচ্ছে ওই অপরিচিত পাচাল গ্রামে? লক্ষ কোটি টাকার যে হাইব্রিড ধানের ব্যবসা, ততোধিক বৃহৎ বহুজাতিক কোম্পানিগুলির সারের বাণিজ্যকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন বাঁকুড়ার পাচাল গ্রামের গুটিকয় ‘যুবক’। আজকের যুগে আধুনিক বিপ্লব কী হতে পারে, তা বুঝতে হলে যেতে হবে এই পাচাল গ্রামে। আজ ওঁরা সংখ্যায় ৫০ জন। কিন্তু এমন দিন আসতেই পারে যে দিন ওঁরা হয়ে যেতে পারেন পাঁচ লক্ষ, পাঁচ কোটি বা তার চেয়েও বেশি।কী ভাবে?

    সংরক্ষিত বাংলার বীজ

    পাচাল, শিল্পী যামিনী রায়ের বাড়ি বেলিয়াতোড় থেকে মাইল দশেক। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পিচরাস্তা। রাস্তা ভাঙা-চোরা। তবে বাস চলে। পাচাল গ্রাম থেকে কিলোমিটার খানেক দূরে ধানখেতের মধ্যে ছোট্ট খড়ের কুড়েতে বসে কথা হচ্ছিল ভৈরব সাইনির সঙ্গে। সঙ্গী ছিলেন তুলসি দে আর কানাই দে। ওদের একটিই স্লোগান, ‘নিজের জল নিজের মাটি বিষাব না’।

    একটা প্রায় ছিঁড়ে যাওয়া মলিন বই, ‘লুঠ হয়ে যায় স্বদেশ ভূমি’(উৎস মানুষ প্রকাশন), সেটাই ওঁদের গীতা। এই বই পড়ে জীবনটা বদলে গিয়েছে ভৈরব সাইনির। ভৈরবের এখন বয়স ৪২। আর পাঁচ জনের মতো ভৈরবও স্কুল কলেজে পড়েছে। কিন্তু এক জন পুরো দস্তুর চাষি ভৈরব। কৃষি বিজ্ঞানী দেবল দেব তখন পাচাল গ্রামের কাছেই অর্জুনপুরে তাঁর গ্রাম বাংলা সহ দেশের প্রায় হারিয়ে যাওয়া ধানবীজ সংরক্ষণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এই বীজ যদি পৃথিবী থেকে মুছে দেওয়া যায় তাহলে রাসয়ানিক সার নির্ভর হাইব্রিড ধান ছাড়া মানুষের আর গতি থাকবে না। ফলে বাংলা সহ দেশের প্রায় দেড় হাজার প্রাচীন ধানবীজকে কংসের হাত থেকে কৃষ্ণকে রক্ষা করার মতো করেই বাঁচিয়ে রেখেছেন এই কৃষিবিজ্ঞানী।

    বীজতলা

    ধানবীজ যেহেতু রাখা যায় না, প্রতি বছর চাষ করে নতুন বীজ তৈরি করে সংরক্ষণ করতে হয়, সেই কাজটাই করে যাচ্ছেন দেবল দেব। এছাড়াও আর যা যা তিনি করে চলেছেন আমাদের চোখের আড়ালে, তা জানতে হলে যেতে হবে তাঁর ওয়েবসাইটে। যার ঠিকানা- cintdis.org ।বলে রাখা ভালো, দেবল দেবের এই এনজিও কোনও সরকারের টাকায় চলে না। চলে বন্ধু এবং শুভানুধ্যায়ীদের সহায়তায়। টেলিফোনে দেবল দেব জানালেন প্রায় ২৪ বছর থরে তিনি এই কাজ করে চলেছেন।

    ‘লুঠ হয়ে যায় স্বদেশ ভূমি’, বইটি ভৈরব পেয়েছিলেন দেবল দেবের কাছ থেকে। পড়ে মনে হল, পৃথিবীর এই জল এই মাটি বিষাক্ত করার অধিকার কারও নেই। এক দিন সারের দোকানে গিয়ে ধারের টাকা মিটিয়ে এলেন ভৈরব। বাড়িতে যেটুকু রাসায়নিক সার ছিল নষ্ট করে ফেললেন। শুরু হল জৈব চাষ। সঙ্গে চলল জৈব চাষ নিয়ে পড়াশোনা। সবাই তখন ভৈরবকে রাস্তায় দেখলে ঠাট্টা করে বলত ওই দেখ কৃষি বিজ্ঞানী যাচ্ছে। এসব ১১-১২ বছর আগের কথা।

    এমন সময় দেবল দেব বাঁকুড়া ছেড়ে চলে গেলেন দক্ষিণ ওড়িশায়। যাওয়ার সময় ভৈরবকে দিয়ে গেলেন ১২০ প্রজাতির বাংলা এবং অন্যান্য রাজ্য থেকে সংগ্রহ করা আদি ধানবীজ। ভৈরব হাইব্রিড ধানের চাষ ছেড়ে বাংলার প্রাচীন ধানের চাষ শুরু করলেন। এবং সবটাই জৈব চাষ। কাজটা সহজ হল না। বাড়ি থেকে বাধা এসেছিল। বাড়ি ছেড়ে প্রায় ১০ মাস গুজরাটে কাজ নিয়ে চলে গিয়েছিলেন । তার পর বাড়ি, মানে বাবা মা রাজি হলেন। স্ত্রী শ্যমলী অবশ্য বরাবর পাশে ছিলেন। তার অবশ্য কারণও আছে। শ্যামলীর সঙ্গে ভৈরবের আলাপ গ্রামে বিজ্ঞান আন্দোলন করতে গিয়ে। সে সময় ভৈরবের শখ ছিল অন্য বন্ধুদের সঙ্গে ছোট্ট একটা চার ইঞ্চি টেলিস্কোপ দিয়ে আকাশের তারা চেনা।

    বীজতলায় ভৈরব সাইনি

    ২০০৫ সালে ভৈরব প্রথম বার চাষ করলেন পাঁচ প্রজাতির ধান। সে সব ধানের নাম, বহুরূপি, গোবিন্দভোগ, বকুলফুল, কেরালা সুন্দরী এবং দ্বারকাশাল। ব্যবহার করলেন, এক গ্রামও রাসায়নিক সার নয়, সবটাই জৈব সার। সেই শুরু।বাজার ছিল না। আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বছরের পর বছর। হাইব্রিড স্বর্ণের চেয়েও কম দামে ধান বিক্রি করতে হয়েছে। কিন্তু থামেননি ভৈরব। উপরন্তু সঙ্গে পেলেন কানাই, তুলসিদের মতো আরও কয়েক জনকে। ২০১১ সালে দেবল দেব চলে গেলেন দক্ষিণ ওড়িশায়। কিন্তু তাঁর আদর্শ থেকে পাচাল গ্রামে। ধীরে ধীরে ছবিটা বদলালো। এখন ১২টি রাজ্যে চাল পাঠাচ্ছেন ভৈরবরা। বাজার বাড়ছে।লাভও বাড়ছে। জৈব সারে চাষ করা প্রাচীন ধানের জনপ্রিয়তা বাড়ছে প্রতিদিনই। তা দেখে এখন ভৈরবরা ৫০ জন মিলে তৈরি করেছেন বিশেষ ক্লাস্টার। সেই ক্লাস্টারের নাম বসুন্ধরা সুস্থায়ী কৃষি খামার। মোট ১৫০ বিঘা জমিতে এই চাষ হচ্ছে। কেন্দ্রীয় প্রকল্প, ‘পরম্পরাগত কৃষি বিকাশ যোজনা’, ভৈরবদের ‘বসুন্ধরা সুস্থায়ী কৃষি খামার’ এই প্রকল্পের অধীন। ২০১৬ থেকে শুরু হয়েছে এই প্রকল্প। জৈব কীটনাশক, জৈব সার, চাষের ষন্ত্রপাতি, বীজ ইত্যাদি কিছু সরকারি সাহায্যও তাঁরা এখন পাচ্ছেন।

    বিষমুক্ত এই কৃষির ফসল যেদিন সরকারি ‘গ্রিন সার্টফিকেট’ পাবে, তাদের বিদেশে রফতানির দরজাও খুলে যাবে বলে আশা। দেবল দেবের ভাবনা যে ভৈরবদের মধ্যে দিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে, তা বোঝা যায়। কারণ এই মুহূর্তে বাঁকুড়ায় এমন ক্লাস্টারে সংখ্যা ২০টি। গোটা রাজ্য ১২০টি। ফলে বোঝাই যায় আরও অনেক ‘দেবল দেব’ অলক্ষ্যে কাজ করে চলেছেন বিভিন্ন জেলায়।

    ভৈরবদের এখন দরকার হল, এই ধরনের চালের জন্য ঠিকঠাক একটা মিল। সাধারণ মিলে বিক্রির জন্য চালকে ঘষে মেজে চকচকে করে দেওয়া হবে। দেখতে হয়তো সুন্দর লাগে, কিন্তু, সেই চালে কোনও খাদ্যগুণ থাকে না। বলা যায় সেই চাল, যা আমরা কলকাতায় খেয়ে থাকি, শুধু গ্লুকোজে ভরপুর। যা ডায়বেটিস ছাড়া আর কিছু উপহার দিতে পারে না।

    ভৈরবদের অফিস ঘর

    এখনও ভৈরবরা যে চাল করেন, তার পুরো আতপটাই ওঁরা করেন বাড়িতে কড়াই সেদ্ধ করে। তার পর কালো চাল ইত্যাদি বাছাই করা হয় হাতে। তবে এটা ঠিকই চাহিদা আরও বাড়লে যদি বাড়ির বাইরে শ্রম ব্যবহার করতে হবে তবে চালের দাম বাড়বে। কিন্তু, ভালো জিনিসের জন্য, বিষমুক্ত খাবারের জন্য মানুষ বোধহয় দাম দিতে প্রস্তুত। অন্তত ভৈরবদের অভিজ্ঞতা এমনই। ভৈরব জানালেন, এখন  সব থেকে বেশি চাহিদা, যে সব চালের সেগুলি হল, কালাভাতি (কালো চাল, খিচুড়ি, পায়েসের জন্য তা ছাড়া ক্যান্সারের রোগীকেও খাওয়ানো হয়), কেলাস, দেরাদুন গন্ধেশ্বরী, গোবিন্দভোগ, রাধুনি পাগল, রাধাতিলক ইত্যাদি। এছাড়াও তাঁদের জৈব চাষের তালিকায় আছে তিল, সর্ষে, ডাল, আলু (অল্প), গম (অল্প), ভুট্টা, কাপাস তুলো। ভৈরবরা মাটির নীচের জল-সম্পদ সেচের জন্য ব্যবহার করেন না। মাটি যাতে নষ্ট না হয়, জলে আর্সেনিক যাতে না আসে। তাই ওঁরা বোরো চাষ করেন না। এমনকী নিজেদের অফিস ঘরে লাগিয়ে নিয়েছেন একটা সোলার ল্যাম্প।

    ভৈরব জানালেন, যদি কোনও চাষি এই ধানের চাষ করতে চান, তাঁরা তাঁকে বীজ দিয়ে সহায়তা করেন। কিন্তু বীজ ওঁরা বিক্রি করেন না। ‘ভৈরব বললেন, বীজের কোনও মালিকানা হয় না, ওটা তো প্রকৃতির দান। তাই বীজ আমরা বিক্রি করি না’। এই হল মাল্টি ন্যাশনালের থাবার নীচে দু’একটা প্রদীপের গল্প।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @