গৌতমের ভাঙা-পায়ের প্লাস্টারে সই করতেন মহীনের ঘোড়াগুলি

প্রেসিডেন্সির বাউন্ডুলে ছেলেটা দিব্বি মজে ছিল গানবাজনা নিয়ে। বাড়িতেও গানবাজনার পরিবেশ ছিল। তাঁরও বাজনার হাত ভালো ছোটো থেকেই। বিশেষ করে তবলার হাত। তবে, গিটারই তাঁর প্রেমের রাজধানী। অ্যাংলো ইনডিয়ান বন্ধুদের নিয়ে সে তৈরি করল ‘দ্য আর্জ’ নামের একটা ব্যান্ড। ষাট দশকের শেষ। ইন্টারনেট নেই সেযুগে, তার মধ্যেই ‘বিটলস’-এর অ্যালবাম জোগাড় করেছে শুনেছে সে। কান তৈরি করেছে সমকালীন বিশ্বের নানা ব্যান্ডের গান শুনে। মাথাভর্তি ঝাঁকরা চুল, হিপিদের মতো হাবভাব। পার্ক স্ট্রিটের ট্রিংকাস, মুলারুজ়ের বারে গাইছিল, বাজাচ্ছিল। তারপর হঠাৎই বদল। উত্তাল সত্তর দশক মুক্তির ঘোর বুনে দিল তাঁর চোখে। নকশাল আন্দোলনে জড়িয়ে ঘর ছাড়ল ছেলেটি।
ছেলেটির নাম গৌতম চট্টোপাধ্যায়। ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র গৌতম। বাংলা গানের দিক বদলে দেওয়ার কারিগর গৌতম। আজন্ম খ্যাপাটে, রোমান্টিক, সুরবিভোর একটা মানুষ। অথচ, রক-ব্লুজে মেতে থাকা ছেলেটাই রাজনীতির পাঠ নিয়ে চলে গেল সুন্দরবনের গ্রামে। তারপর পুলিশে ধরল। এনকাউন্টার হয়ে যাওয়ার ভয়ও তৈরি হল। ছাড়া পাওয়ার পর গৌতমকে পাঠিয়ে দেওয়া হল জব্বলপুরে। তারপর, মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভের কাজ নিয়ে গৌতম চলে গেলেন ভোপাল। গান কিন্তু তাঁকে ছাড়েনি। নানা রকমের সাউন্ডস্কেপ খুঁজেই চলেছিলেন তিনি। এর আগে নকশাল আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে গ্রামে গিয়ে শোনা নবান্নের গান, ধান বোনা, চাষের সুরও বিছিয়েছিল তাঁর সুরের চাতালে। কলেজ জীবন থেকে বেদেদের সঙ্গেও ঘুরেছেন গৌতম, বৃহন্নলা, বাউলদের সঙ্গে মিশেছেন। তাঁদের গান তুলে নিয়েছেন কানে-কণ্ঠে। এইসবই পুষ্ট করেছে গৌতমকে। সেই সব সুর মিশিয়ে দিয়েছেন নিজের গানেও।
চাকরি ছেড়ে ’৭৪ সালে ফের কলকাতায়। গৌতম নাকতলার বাড়ির নাম দিলেন বেকার হাউস। প্রেসিডেন্সির বেকার ল্যাবরেটরির স্মৃতি মিশে এই নামে। শুরু হল গানের আখড়া। এরমধ্যেই পা ভাঙল গৌতমের। আর গৃহবন্দি গৌতমকে ঘিরেই জমাট বেঁধে উঠল নতুন গানের দল। রিহার্সালের সময় নাকি গৌতমের পায়ের প্লাস্টারে হাজিরার সই করতেন সবাই। সাতজনের দল। রাতে রিহার্সালের অত্যাচারে পড়শিরার জানতে পারলেন নতুন ব্যান্ডের এই জন্মবৃত্তান্ত। দ্রুত জানতে পারল কলকাতাও। ব্যান্ড ব্যাপারটার সঙ্গে অবশ্য তখনো সড়গড় হয়নি শহর। গৌতমদের ব্যান্ডের নামও ঠিক হয়নি প্রথমে। অনুষ্ঠানে ডাক পেলে নানা সময় নানা নাম বলতেন গৌতম। কখনো ‘সপ্তর্ষি’, কখনো ‘গৌতম চ্যাটার্জি বিএসসি অ্যান্ড সম্প্রদায়’। একদিন রঞ্জন ঘোষাল নতুন নামের প্রস্তাব দিলেন-- ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’। সেই নাম আর বদলায়নি।
আরও পড়ুন
একশোয় পড়লেন কফি হাউজের কবিয়াল
সময়ের আগেই জন্মেছিলেন গৌতম, জন্মেছিল মহীনের ঘোড়াগুলি। তাই শুরুতে তাঁরা সমালোচনা কুড়িয়েছে বিস্তর। অবশ্য সমালোচনাকে অলংকারের মতোই গ্রহণ করেছিলেন গৌতম। এরপর আশির দশকের গোড়ায় দল ভাঙল। গৌতম গানে আটকে রইলেন। নতুন সুর, নতুন সাউন্ডস্কেপ, নতুন শব্দ। বাউল-সঙ্গ, ডকুমেন্টরি তৈরি তো ছিলই। ‘নাগমতী’ নামে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবিও বানিয়ে ফেললেন। জাতীয় পুরস্কার পেল সেই ছবি। অদ্ভুত সব সুরেলা দৃশ্য ছিল এই ছবিতে। ক্যামেরা নিয়ে নতুন এক দিগন্ত যেন ছুঁতে চাইছিলেন গৌতম। কখনো ঢাকিদের জীবন, কখনো বাউল, কখনো হাবিব তনভির, কখনো বিভিন্ন জনজাতিদের জীবন। গৌতম বুঁদ এই নতুন খোঁজে।
কিন্তু গান ডাকে। কয়েকজন কলেজপড়ুয়া তাঁর কাছে এসে দাবি জুড়ল, ফের নতুন করে বাঁচিয়ে তুলতে হবে ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’-কে। গৌতম সাড়া না দিয়ে পারেন না। চারটি অ্যালবাম বেরোলো গৌতমের সম্পাদনায়। ‘আবার বছর কুড়ি পর’, ‘ক্ষ্যাপার গান’, ‘ঝরা সময়ের গান’, ‘মায়া’। তাতে মহীনের ঘোড়াগুলির পুরোনো গান ছাড়াও আরো অনেক গান জুড়ল। সময়ের ভিতরেই লুকিয়ে থাকা একটা ভিন্ন সুরদরিয়াকে ফের সামনে আনলেন গৌতম। সেই গান, সেই সুরকে যখন সত্যিই চিনতে শিখছে তাঁর শহর, তখনই হঠাৎ করে নশ্বর পৃথিবী থেকে উধাও হয়ে গেলেন মানুষটি। কার্বি জনজাতির মানুষদের নিয়ে একটা তথ্যচিত্র তৈরিতে বুঁদ হয়ে ছিলেন। শেষ হল না সেই কাজ।
‘মহীনের ঘোড়াগুলি’-র গান আজ ছুটে চলেছে শহর থেকে মফস্সলের পথে প্রান্তরে। গৌতমের আবিষ্কার করা সুরভূমিতে আশ্রয়ের জন্য ছুটছেন অনেকেই। ‘ফিরব বললে ফেরা যায় না কি’—তবু আমরা ফিরতে চাইছি মহীনের ঘোড়াগুলির কাছে। গৌতমের কাছে। গৌতম দেখলে খুশি হতেন নিশ্চয়ই। নাকি স্বভাব-মগ্নতায় ফের বয়ে যেতেন অন্য কোনো খোঁজে!
আজ সেই সুর-খ্যাপা মানুষটার জন্মদিন।