চিন্তামণি কর অভয়ারণ্যের পাখি

চিন্তামণি কর পাখিরালয়-এর সঙ্গে আমার পরিচয় একটু অন্য ধরনের। বারবার যাওয়া, তারপর খালি হাতে ফিরে আসা। ক্রমে একটা জেদ চেপে বসল। মাথায় ভূত চাপার মতো ছুটির দিনেও কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম চিন্তামণি করের উদ্দেশ্যে। মনে মনে ভাবতাম, আজ নিশ্চয়ই দেখা মিলবে। এখানে ছবি তোলা যেমন কঠিন তেমনই আনন্দের। পাখির দেখা মেলে সকালে নয়, দুপুরে স্নানের সময়। অন্য সময় এরা বাসায় বিশ্রাম নেয়।


চিন্তামণি কর পাখিরালয়ের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় এক বিদেশি বন্ধুর হাত ধরে। একদিন গল্পের ছলে বেশ কিছু পাখির ছবি দেখিয়ে সে বলল এইগুলি দক্ষিণ কলকাতার চিন্তামণি কর অভয়ারণ্যে তোলা। মনে-মনে একটু দুঃখ হল। বাড়ির কাছে আর আমি জানি না! ঠিক করলাম আমিও যাব চিন্তামণি কর অভয়ারণ্যে। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। ‘Bengal Bird Day’তে দিনটি ঠিক করা হল। ক্যামেরা নিয়ে চলাম চিন্তামণি করের উদ্দেশ্যে।


দক্ষিণ কলকাতার নরেন্দ্রপুরে অবস্থিত এই পাখিরালয় সারা ভারতবর্ষে বিখ্যাত। দেশ-বিদেশ থেকে অনেকে আসেন এখানে পাখির ছবি তুলতে। ১৭ একর জমির ওপর তৈরি এই অভয়ারণ্য বাকিদের থেকে চেহারা ও অবস্থানে অনেক আলাদা। নরেন্দ্রপুরের মতো কোলাহলপূর্ণ উঁচু উঁচু কংক্রিটের বাড়িঘরের মধ্যে যে এমন ঘন অভয়ারণ্য থাকতে পারে সেটাই বোঝা মুশকিল। আগে এই অভয়ারণ্যের নাম ছিল ‘কয়ালের বাগানে’। পরে বিশিষ্ট স্থপতি চিন্তামণি করের নাম অনুসারেই অভয়ারণ্যের নামকরণ করা হয়।


বিশাল এলাকা জুড়ে ঘন ঝোপ, বাঁশবন ও আম-কাঁঠালের বাগান। ১৯৮২ সালে এই বাগানকে অভয়ারণ্যের তকমা দেওয়া হয়। এখানে ছবি তোলা আমার কাছে জেদ বললে হয় তো কিছু ভুল হবে না। এই অভয়ারণ্যে আমার প্রথম দিনটি ছিল খুব মেঘলা। ক্যামেরা নিয়ে এগিয়ে চলাম আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে। ঘন এবং গভীর বন। ঢুকেই দেখলাম একটি ঝোপের মাথায় ‘ওয়াট-ব্রো-ফনটেইল’ সাদা-কালো লেজটি নেড়ে ‘তাতা থৈ থৈ’ করছে। দুটো কাঠঠোকরাকে দেখলাম একটা লম্বা নারকেল গাছের গা বেয়ে ঠকঠক শব্দ করে উঠে চলেছে উপর দিকে। ক্রমে মিশে গেল কুয়াশার মধ্যে। কয়কটা রোজ রিং প্যারাকিট খাবার সংগ্রহ করতে ব্যস্ত। খারাপ আলো, তাছাড়া ঘন জঙ্গলের জন্য কোনও ছবিই তোলা হল না সেদিন। নিক্কন ডি-৯০ আর নিক্কন ৭০-৩০০ এম.এম. লেন্স দিয়ে ছবি তোলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ফিরলাম শূন্য হাতেই। কখনও জঙ্গলের ভিতরে তাপমাত্রা এত বেশি থাকে যে চশমার কাচ ঝাপসা হয়ে আসে। হাতের উপর এসে বসে মশাগুলো। কাটা গাছ ও লতাগাছের জড়ানো এই জঙ্গলটির ভিতরে ঢোকা খুব কষ্টসাধ্য। একবার ‘অরেঞ্জ হেডেড থ্রাস’ (দামা) পিছনে অনুসরণ করে জঙ্গলের ভেতরে চলে গেলাম। পাখিটি মাটির ওপর দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঢুকে গেল জঙ্গলের মধ্যে। সঠিক জায়গায় ফিরে আসতে প্রায় ১৫ মিনিট সময় লাগল আমার। অন্য একদিন জঙ্গলের ভিতরে ছবি নিচ্ছিলাম আমরা নজর পাখির দিকে। হঠাৎই হুড়মুড় করে প্রবল হুটোপুটি করে ছুটে এল দু’খানা প্রাপ্ত বয়স্ক মনিটার লিজার (গোসাপ)। লেজটা তিন হাত লম্বা। আমার গায়ের খুব কাছ দিয়ে বেরিয়ে গেল। আমি একটুর জন্য রক্ষা পেলাম। লেজের আঘাতে আহত হতে পারতাম। এখানে অন্যান্য সাপও আছে। গোসাপদের খাবারের জন্য এদের বংশবৃদ্ধি কমে গেছে।


একবার এপ্রিল মাসে চিন্তামণি করে গিয়ে দেখা হল এই জঙ্গলের গ্রান্ড ফাদার ফিস আউল-এর সঙ্গে। বড় আমগাছের উপর বসে আছে জবুথবু হয়ে। এখানে পাখি দেখতে হলে যেতে হবে দুপুরবেলা। গরমকাল হল উপযুক্ত সময়। যখন পাখিদের জল পিপাসা বেশি পায় বা স্নানের মাত্রা বেড়ে যায়। বাকি সময়টা এরা গভীর জঙ্গলে ভেতরেই থাকে। কেবলমাত্র জল খাবার জন্য ও স্নানের জন্যই পাখিরা বাইরে আসে। এই জঙ্গলে পাখি দেখার সময়টা সকাল নয়। বেশ কিছু দুর্লভ পাখির দেখা মেলে এখানে। জঙ্গলের বিভিন্ন জায়গায় কৃত্রিমভাবে জলাধারের ব্যবস্থা করা আছে। দুপুরে জল খেতে আসে পাখিরা।


এবার চিন্তামণি করে হাজির হলাম মে মাসের তপ্ত দুপুরে। দেখলাম আমার মত অনেকেই হাজির তৃষ্ণার্ত ও স্নানযাত্রার পাখিদের ছবি তুলতে। জঙ্গলের ভেতরে উষ্ণতা বাড়ছে। ঘড়িতে দুপুর ২.৩০ দেখাচ্ছে। পাখিপ্রেমিকরা বিভিন্ন দিকে চলে গেছেন। আমিও বাগানে বেশ কিছু পাখিও মুনিয়ার ছবি তুলে আবার ফিরে আসলাম জল খাওয়ার সে-জায়গায়। মনে মনে ভাবছিলাম, হয়তো চিন্তামণি-তে আরেকটি দুপুরে আসতে হবে। আজও খালি হাতে ফিরব হয়তো। আলো অনেক কমে আসছে। ঘড়িতে দুপুর ৩.৪০। হঠাৎই দেখি এদিক-সেদিক তাকাতে তাকাতে স্নান করতে নামল আমার আকাঙ্খিত পাখি ‘স্লেটি লেগ ক্রাক’ (slaty-legged Crake)। মুহূর্তে এল আর স্নান হয়ে গেল। এটা একটা প্রাইজলেস শট আমার জন্য। সকলের অনুমান, চিন্তামণি করেই দুটি-একটি আছে এই পাখি।


অন্য একদিন, এখানেই দেখা পেলাম ‘ওরিয়েন্টাল ওয়াইট আই’-এর। পাখিটি আমার খুব পছন্দের। ঠোঁট থেকে লেজ মাত্র ৪ ইঞ্চি লম্বা। পাখিটির ওপরটা হলদে সবুজ মেশানো। গলাটা ঘন হলুদ। কালো চোখের চারিদিকে সাদা গোল বলয়। কম্পিউটারে ছবি নিয়ে কাজ করার সময় অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম পাখটির দিকে। ছোট পা-দুটি হালকা নীলচে। যেন ছোট সবুজ-হলুদ সাদা উলের বল। এছাড়া বাগানে ছবি পেলাম ‘নাইট জার’। এদের সচরাচর দেখা মেলা ভার। অনেকা পেঁচার মত রাত্রিচর পাখি। জমিতেই বাসা বাঁধে। এছাড়া বাগানে রয়েছে এমারল ডার্ভ(রাজ ঘুঘু), কমন হব টাক্কু(চোখ গেল পাখি), ব্লু-থ্রোটেড বার্বেড, লিনিয়েটেড বার্বেড, কপার স্মিথ বার্বেড, রুফার ট্রি পাই, জঙ্গল বাবলার, চার রকমের কাঠঠোকরা, ফিঙে ও নানা রকমের পাখি যা বাংলার সর্বত্র দেখা যায়।

ভিন রাজ্য থেকেও আসেন অনেকে পাখি দেখতে। কিন্তু নিরাশ হয়ে ফিরে যান। ‘পাখি কোথায়’ - এই কথা শোনা যায় অনেকের মুখে। আসলে চিন্তামণি করে পাখি দেখা জন্য চাই ধৈর্য। আর মশার কামড় খাওয়ার অভ্যাস। কারণ এই জঙ্গলটি লোকালয়ের মধ্যে অবস্থিত। স্থানীয় অধিবাসীদের অনেকের জানা নেই যে এখানে এমন একটি ঘন জঙ্গল আছে। তাছাড়া এই জঙ্গলের সঙ্গে ভারতের অন্য পাখিরালয়ের পার্থক্য হল এখানে জঙ্গলটি কাঁটা ও লতাগাছে ঢাকা। গাছগুলি একে অপরকে জড়িয়ে জাপটে রেখেছে। পাখিরালয়ে রয়েছে নানান প্রজাপতি ফড়িং ও পোকামাকড়। ইতিমধ্যেই জঙ্গলের আয়তনও আগের থেকে কমেছে। জঙ্গলের বেশ কিছু অংশ চলে গেছে কংক্রিটের খপ্পরে। বনের ভেতর আপনি কী করছেন-না-করছেন তা কিন্তু সর্বদা নজরে থাকবে। এই নজরদারি কোনও মানুষ বা যন্ত্রের নয়, ওরা বেজির দল। মাথা উঁচু করে দু-পায়ে দাঁড়িয়ে এগিয়ে চলবে পাশে পাশে। কাটা গাছগুলির জন্য জঙ্গলের ভিতরে প্রবেশ করা দুষ্কর।

একদিন কাঁটাঝোপ ও মশার কামড় উপেক্ষা করে ঢুকলাম জঙ্গলে। এই বছরের এপ্রিল মাসেই বনের গভীরে দেখা আলো আঁধারের মধ্যে বসেছে আছে গ্রিন ক্রাউন ওয়েব্লার। এটি হিমালয় রিজিয়ান পাখি। দু-তিনটে পাখি এসেছিল শীতের দেশ থেকে কিছুদিনের জন্য। এরাও দুর্লভ পাখি। চিন্তামণি করে পাখি দেখতে হলে থাকতে হবে পাখি খোঁজার চোখ। নইলে ফিরতে হবে শুধুই জঙ্গল দেখে। শুধু পাখি নয়, আমি জঙ্গল পরিবেশ সর্বোপরি মুহূর্তে-পাল্টে-যাওয়া আলোর মধ্যে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার এক অপরূপ অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরেছি কোয়েলের বাগান থেকে।