বনবিতানের পাখি

ভাবছেন পাখির ছবি তোলা শিখবেন? তাহলে চলুন বনবিতানে। বড় বড় গাছ, জলাশয়, অল্পবিস্তর ঝোপঝাড়, সুসজ্জিত বাগানে প্রকৃতির সঙ্গে মানষের এক অপূর্ব মেলবন্ধন। সারা বছরের জনসমাবেশ পাখিরাও অভ্যস্ত। তারা আপনাকে দেখে বা সামান্য শব্দ হলেই উড়ে পালায় না। সুতরাং আপনি তুলতে পারেন এক একটা মাস্টার শ্যুট। আমারও পাখির ছবি তোলার হাতেখড়ি হয়েছিল এখানেই। বনবিতান ছিল আমার আউটডোরে পাখিদের ফোটোশ্যুটের স্থান।



সল্টলেক সেন্ট্রাল পার্ক বা বনবিতান, রয়েছে বিস্তৃত জলাশয়, এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত। মাঝখানে বাদিক বেঁকে ঢুকেছে পার্কের ভেতরে। প্রাতঃভ্রমণকারীদের জন্য রাস্তা এঁকেবেঁকে ঢুকে গেছে পার্কের আনাচে কানাচে। প্রতিদিন সকালে অনেক মানুষ ভিড় জমায় এখানে। প্রাণায়াম যোগাসনের সঙ্গে সঙ্গে চলে প্রাতঃভ্রমণকারীদের মুক্ত অক্সিজেন কার্বন-ডাই-অক্সাইডের দেওয়া নেওয়া। সেই জন্যই বনবিতানের আরেক নাম সল্টলেকের ফুসফুস। আমার সঙ্গে পরিচয় শুরু হয় ২০১৩ সাল থেকে। বাড়ির বাগানের পর বনবিতানই ছিল আমার কাছে পাখির ছবি তোলার মোক্ষম জায়গা।



সেই নেশায় আমি প্রায় প্রতি রবিবারেই যেতাম বনবিতানে। খুব সকাল থেকেই এখানে মানুষ আসে। বিস্তৃত জলাশয়ের চারধারে বড় বড় গাছের সারি জলের উপর ছায়া ফেলে দাঁড়িয়ে। এখানে পরিযায়ী পাখিদের সঙ্গে সঙ্গে দেখা মেলে বাংলার নিজস্ব পাখিদেরও। এখন সেই রকম পাখিদের সমাবেশ দেখা না গেলেও হারিয়ে যায়নি পাখিদের আনাগোনা। এক রবিবার সেদিনই আমার প্রথম পরিচয় হয় বনবিতানের সঙ্গে। দেখি প্রায় ১৫০-২০০ লেজার উইসলার লেসার হুইসলিং ডাক কাঁদা আর ঘাসের দ্বীপে সূর্যের প্রথম আলো উপভোগ করতে ব্যস্ত। দল বেঁধে থাকতে ভালবাসে। উড়ার সময় হুইসেলের মত শব্দ করে বলে এর নাম লেসার হুইসলিং ডাক। দেখতে পেলাম মোরহ্যান্ড, লিটিল গ্রেবে, হোয়াইট ব্রেস্টেটড ওয়াটার হেন।



বনবিতানের সঙ্গে আমার আন্তরিক যোগাযোগ হয় পরে। সকালবেলায় বনবিতান এতই মনোরম সবুজের মাঝে জলাশয়, তার উপর শীতল হাওয়া বয়ে চলেছে। পাখিদের আনাগোনা, শুধু চোখে দেখেই আনন্দ হয়। এই সব দৃশ্য সজীব করে মনকে। ইচ্ছে করে বার বার ফিরে আসি এখানে। একদিন জলাশয়ে পাশ ধরে হাঁটছি, এমন সময় দেখি একটা হোয়াইট থ্রোটেড কিংফিশার ঘুপটি মেরে জলের দিকে তাকিয়ে আছে। আমার দিকে ওর কোনও দৃষ্টিই নেই। হঠাৎ ঝাঁপ দিয়ে জল থেকে কিছু নিয়ে গাছে গিয়ে বসল। একে পরে অনেক বার গেলেও দেখেছি। আসলে সে এখানকার আদি বাসিন্দা। একবুক জলে ফুটে আছে শাপলাফুল। পার্কের ভেতরে গোটা ১৫-১৬ টি পর্ণহিরন এবং লিটিল ইটগ্রেট ঘুরে ঘুরে ঘাস থেকে পোকা খেতে ব্যস্ত। পানকৌড়িগুলি আপন মনে জলে ডুব দিছে আর মাছ ধরে খাচ্ছে। টিয়াপাখিরা জোড়ায় জোড়ায় বসে প্রেমালাপ জমিয়েছে। তাদের মধ্যে একটিকে দেখি গর্ত থেকে মাথা বের করে পথচলতি মানুষদের দেখছে। একটি পানকৌড়ি জলে আধ ডোবা বাঁশের মাথায় বসে ডানা শুকোচ্ছে।



বনবিতানের শান্ত পরিবেশ এবং এখানকার পাখিদের চরিত্র আমাকে খুব আকর্ষণ করে। এমনই একদিন খুব সকালে বনবিতানের জলাশয়ের ধার দিয়ে এগোচ্ছি। দেখি প্রথম সূর্যের আলোর ছটা এসে মিলেছে জলে। জলের ঢেউয়ের উপর দিয়ে সাঁতরে যাচ্ছে একটা পানকৌড়ি। আহা, সে এক অপূর্ব দৃশ্য। সোনালি রোদের ঝিকিমিকিতে জল যেন গলানো সোনা। দেখি একটু দূরেই গাছের ডালে বসে আছে দুটো ইয়োল ফুটেট গ্রিন পিজন। কয়েকজনকে দেখলাম ছিপ নিয়ে মাছ ধরার জন্য বসেছে জলশয়ের উল্টোদিকে। বাঁদিকে পার্কের মাঝখানে প্রবেশ করেছি দেখি বেশ কয়টি সার্নবার্ড ফুলের মধু খেতে ব্যস্ত। কিংফিশারের ডাকাডাকি আর ছোটাছুটি লেগেই আছে জলাশয়ের ধার দিয়ে। এখানে দেখা পেয়েছি কমন হুপে, গ্রিন-বি ইটার, ট্রায়াগ্রা ফ্লাইক্যাচার। এখানে পাখির সঙ্গে সঙ্গে দেখা মেলে হরেকরকমের প্রজাপতির। সাজানো বাটারফ্লাই কর্নারে উড়ে বেড়াচ্ছে প্রজাপতি ফুলে ফুলে। এই অংশটিতে নজর রাখা হয় বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে। কিন্তু বছর তিন থেকে শুরু হয়েছে বনবিতানের বুক কেটে কংক্রিটের নির্মাণ কর্মকাণ্ড। ফলে এখন সেখানে পরিযায়ী পাখিদের আনাগোনা কমেছে। লেজার উইসলার ডাক, মোর হ্যান্ড লিটিল গ্রেভের মত জলের পাখিদেরও। এখানে দেখলাম ব্ল্যাক হুটেড ওরিয়াল, রুফস ট্রিপাই, কপারস্মিথ বারবেট, ব্লু-থোটেড বারবেট, গোলডেন ওরিওলের মতো পাখিদের। দেখি গাছে উপরে পাতার আড়ালে বসে আছে দুটো স্পটেড আওলেট, সামান্য দূরে গাছে আর একটা। মনে হল সংসার পেতেছে কর্তা গিন্নি ও ছানাপোনা নিয়ে।



এই সুন্দর সাজানো বাগান ও প্রাকৃতিক পরিবেশ পাখিদের একটা অভয়ারণ্যের মতো, এখানে ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে পাখিদের আনাগোনা। উঁচু উঁচু বাড়ির পাখিদের ওড়ার পথে বাধার সৃষ্টি করে। গাছ কমে যাওয়াও এর প্রভাব পরেছে। ভেবে দুঃখ হয় মন। তবে আমার কাছে স্মৃতি হয়ে থাকবে বনবিতানের ছবি তোলার দিনগুলো। কখনও বনবিতান থেকে ফিরিনি আমি খালি হাতে, আমার মনের মতো কোনো-না-কোনো ছবি না তুলে।