হারিয়ে গেলেন বিনয়ভূষণ

কথা বলেন কম। বন্ধু আরও কম। নিজের খেয়াল খুশি নিয়ে সময় কাটে বিনয়ভূষণ মজুমদারের। শিয়ালদার কাছে আয়কর দপ্তরে কাজ করেন। আর পাঁচ জনের মতোই সাধারণ একজন কর্মচারী। খুব বেশি বিষয়ে কৌতুহল নেই বিনয়ভূষণের। স্টিং অপারেশনের প্রভাব ভোটে পড়বে কি না, জোট কত আসন পেতে পারে, টি-২০ নিয়ে উত্তেজনা, সিনেমা, চায়ের দোকানে তর্ক, এ সব থেকে বিনয়বাবু একটু দূরেই থাকেন। সহকর্মীর বাড়িতে বিয়ে, অন্নপ্রাশন, শ্রাদ্ধের নেমন্তন্নে খুব একটা বিনয়বাবুকে দেখা যায় না। সময়মতো অফিসে আসেন, ফাইল-টাইল যা দেখার দেখেন, ক্যান্টিনে গিয়ে টিফিন খান, আবার ঠিক ছ’টা বাজলে চেয়ার ঠেলে উঠে সিঁড়ি দিয়ে নেমে কিছুটা হেঁটে গিয়ে শিয়ালদা থেকে ট্রেন ধরে বাড়ি ফেরেন। বাড়ি গড়িয়া ছাড়িয়ে আরও মাইল চারেক যেতে হয়। স্টেশনেই সাইকেল রেখে যান বিনয়ভূষণ। একা থাকেন। বয়স ৪৭-৪৮ হবে। বিনয়ভূষণের তিনকুলে আর কে কে আছেন, কেউ তা জানে না। হয়তো নেই বলেই জানা যায় না।
শখ বললে শখ। খেয়াল বললে খেয়াল। ছুটি পেলেই বিনয়বাবাবু ব্যাগ কাঁধে বেরিয়ে পড়েন। চলে যান সেই সব জায়গায়, যেখানে তাঁর শৈশব বা কৈশোর কেটেছে। বিনয়বাবুর বাবার ছিল বদলির চাকরি। উত্তরবঙ্গ, দক্ষিণবঙ্গের নানা জায়গায় কেটেছে বিনয়বাবাবুর ছোটবেলা এবং কিছুটা বড়বেলাও। বা বলা যায় স্কুল কলেজের জীবন। কোথাও থাকতে হয়েছে ছ’মাস। কোথাও বা দু’তিন বছর। প্রতিটি জায়গার সঙ্গে বিনয়বাবাবুর নানা স্মৃতি জড়িয়ে আছে। নানা ঘটনা। দুর্ঘটনা। কোনওটা মন ভালো করে দেবার মতো, কোনওটা আবার মন খারাপ করে। ছুটি পেলেই বিনয়বাবাবু চলে যান সেই সব অতীতের ঘটনাস্থলে। সেখানে গিয়ে নিজের পরিচয় না দিয়ে চুপ করে দু’এক ঘন্টা বসে থাকেন। নিজের ডায়রিতে নোট নেন। ছবি তোলেন। তার পর আবার ট্রেনে বা বাসে চেপে ফিরে চলে আসেন। কখনও কার্শিয়ং কখনও পুরুলিয়া, কখনও ঝাড়গ্রাম আবার কখনও মালদহে। উত্তরপ্রদেশ, বিহারেরও ছোটখাটো চার পাঁচটি শহরে গেছেন কয়েক বার। কোথাও কোথাও একাধিকবারও গেছেন। গত পুজোয় গিয়েছিলেন পুরুলিয়ায়। আদ্রা স্টেশন থেকে কিছুটা দূরে বছর চল্লিশ আগে বিনয়বাবাবুর খুব ছেলেবেলার কয়েকটা মাস এখানে কেটেছিল। সাত আট মাসের বেশি নয়। শ্যাওলা পড়া দেয়ালের সেই বাড়িটার সামনে বসে থাকতে থাকতে মনে পড়ে গেল ছোটবেলার বন্ধু সমরের ঠাকুমার রাত ভর চিৎকারের কথা। প্রায় প্রতি দিনই মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে যেত সমরের ঠাকুমার চিৎকারে। দুম দুম করে দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে সেই বৃদ্ধা সমরের মাকে ডাকতেন আর বলতেন, ‘খেতে দে নমিতা খেতে দে’। সমর বলেছিল ঠাকুমা তাড়াতাড়ি খেয়ে রাতে শুয়ে পড়তেন। তার পর ভুলে যেতেন সব। মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে উঠে চিৎকার করে খেতে চাইতেন। ঘণ্টাখানেক দরজা ধাক্কানো আর চিৎকারের পর ভেসে আসত ঠাকুমার কান্নার শব্দ। বিনয়বাবাবুর মনে আছে ঠাকুমা দেখা হলেই তাকে এক বার করে জিজ্ঞাসা করতেন খোকা তোমার নাম কী? সমর ঠিকই বলত, ঠাকুমার কিছু মনে থাকে না। বিনয়বাবাবুর মনে আছে পাড়ায় বড়রা এসব কথা বিশ্বাস করত না। সাবাই সমরের বাবা মায়ের নিন্দে করতেন। এর পর এক দিন সমরের ঠাকুমা বাড়ি থেকে পান কিনতে বেরিয়ে আর ফিরলেন না। হারিয়ে গেলেন। অনেক খোঁজা খুঁজি হল। কোনও খবর পাওয়া গেল না। সাইকেল নিয়ে সমরের বাবা আর বিনয়ের বাবা অনেক দূর পর্যন্ত বড় রাস্তা দিয়ে গিয়ে রাতে ফিরে এলেন। সমরের বন্ধু মন্টুর বাবা অনন্তকাকা রেলের ইঞ্জিনে কয়লা দেওয়ার চাকরি করতেন। বেলচা কাঁধে অফিস যেতেন। সবাই বলত ফায়ারম্যান। অনন্তকাকা বললেন ঠাকুমার সাথে নাকি তাঁর দেখা হয়েছিল পুরুলিয়া রেল স্টেশনে। হাতে নাকি টিকিটও ছিল। ঠাকুমা নাকি অনন্তকাকাকে বলেছেন, হাওড়া হয়ে বেনারস যাবেন। অনন্তকাকা ব্যস্ততার মধ্যে আর বেশি কথা বলেননি। ভেবেছিলেন সঙ্গে নিশ্চয়ই কেউ আছে, হয়তো এদিক ওদিক গেছে। অনন্তকাকার এই কথা অবশ্য সবাই বিশ্বাস করেনি। সবাই বলত অনন্তকাকার চোখে এমনিতেই হাই পাওয়ারের চশমা। একটু দূরের জিনিস দেখতে পায় না। তার উপর আনন্তকাকা ভিষণ লোক চিনতে ভুল করেন।প্রথম কয়েক দিন ঠাকুমার নিখোঁজ হওয়া নিয়ে খুব আলোচনা চলল। তার পর সবাই ভুলেও গেল। মাঝে মাঝে শুধু বড়রা বলত, সব খারাপ জিনিসের একটা ভাল দিক থাকে। এখন অন্তত একটু নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারছি। তবে তার পরও বিনয়ের কখনও মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে গেলে মনে হত যেন ঠাকুমার কান্নার শব্দ ভেসে আসছে।
ওখানে বেড়াতে গিয়ে বাড়িটার সামনে বসে থাকতে থাকতে বিনয়বাবাবুর এই সব পুরোনো কথা মনে পড়ছিল। পাশাপাশি বাড়ি ছিল সমরদের আর বিনয়দের। এখন দু’টি বাড়ির সামনেই সুন্দর বাগান করা হয়েছে। বাগানে শীতকালের ফুল ফুটেছে একটা দু’টো গাছে। সমররাও আর থাকে না ওই বাড়িতে। ঠাকুমা হারিয়ে যাওয়ার এক বছর পরেই সমরের বাবা বদলি হয়ে মেদিনীপুর চলে গিয়েছিলেন। মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় দু’টো বাড়িরই বেশ কয়েকটা ছবি তুললেন বিনয়বাবু। এখন এই বাড়ির সামনে একটা ছোট চায়ের দোকান হয়েছে। সেখানে গিয়ে এক কাপ চা বানাতে বললেন । দোকানে তখন অন্য খদ্দের নেই। ছোট গেলাস গরম জলে ধুয়ে চা বানিয়ে দিলেন দোকানি। বিনয়বাবাবু লোকটাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ওই ডান দিকের বাড়িটায় কারা থাকেন’? লোকটা মন দিয়ে ছাকনি পরিষ্কার করতে করতে এক বার মুখ তুলে কোন বাড়িটার কথা বলছে বিনয়বাবাবু তা দেখে নিয়ে ফের ছাকনিতে মন দিয়ে কিছু ক্ষণ চুপ করে থেকে বলে উঠল, ‘ওটা তো বোসদাদের বাড়ি। বোসদা, বৌদি, একটা বাচ্চা আর বোসদার মা থাকে। কেন চেনেন নাকি’? বিনয়বাবাবু বললেন, ‘না, এমনি। মনে হল তাই জানতে চাইলাম’।
বহু বছর ধরে এই ভাবে পুরোনো জায়গায় বার বার ফিরে গিয়ে বিনয়বাবাবুর মনে একটা অদ্ভুত ধারণা তৈরি হয়েছে। হারিয়ে যাওয়া সভ্যতা যেমন নিদর্শন রেখে যায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য, তেমনি প্রতিটি মানুষ, প্রত্যেকটি সংসার, প্রতিটি পাড়া, গ্রামও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলায়, কখনও বিলীন হয়, কিন্তু চিহ্ন রেখে যায়। নিদর্শন রেখে যায়। সবাই হয়তো সেসব দেখতে পায় না। হয়তো সভ্যতার চিহ্ন যতটা স্পষ্ট, ছোট ছোট সংসারের চিহ্ন ততটা স্পষ্ট নয়। অনেক বেশি আবছায়া ঘিরে থাকে এই ছোট-খাটো চিহ্নকে। কিন্তু বিনয়বাবাবু বহু বছর ধরে এই সব চিহ্ন খুঁজে খুঁজে চেষ্টা করেছেন নিজের অতীত ফিরে দেখতে। তৈরি করেছেন নিজের অজানা জগৎ। এক বার বিনয়বাবাবু তার এই ভাবনার কথা ভূতত্ত্বের এক অধ্যাপককে বলেছিলেন। ভদ্রলোক রিটায়ার করে বিনয়বাবাবুদের পাড়ায় ফ্ল্যাট কিনেছেন। সেই অধ্যাপক সব শুনে হেসে বলেছিলেন, ‘দেখুন সিভিলাইজেশন অনেক বড় ব্যাপার। হাজার হাজার বছরের ইতিহাস। তার সঙ্গে কি দশটা লোক, ছ’টা পরিবার বা দু’একটা পাড়ার কোনও তুলনা চলে! আপনি যদি খুঁজে পান এমন কিছু, ভালো। তাতে যদি আপনার মনে আনন্দ হয়, তো আরও ভালো। থাকুননা আপনি এই সব নিয়ে। আপনাকে তো আর কেউ বাধা দিচ্ছে না। কিন্তু এসব নিয়ে ভাবা বা গবেষণা করা অর্থহীন। বিনয়বাবু সেদিন একটু হতাশ হয়েই ফিরে এসেছিলেন। সেদিনই ঠিক করেছিলেন, এসব কথা আর কখনও কাউকে বলবেন না।
পুরুলিয়া থেকে ফিরে এক দিন স্পিড পোস্টে একটা চিঠি পেলেন। খামের উপর হাতের লেখা দেখে চেনা যাচ্ছে না কার চিঠি। চিঠি আজকাল প্রায় আসেই না। যাও বা দু’একটা আসে তার বেশির ভাগই হয় মোবাইলের বিল নয়তো ইলেকট্রিক বিল। না হলে ক্রেডিট কার্ডের স্টেটমেন্ট। কার হতে পারে? খাম খুলে চার লাইনের ওই চিঠি পড়ে অনেক পুরোনো কথা মনে পড়ে গেল।
নলিনাক্ষর চিঠি। জলপাইগুড়ির কাছে এক চা বাগানের একটি প্রাথমিক স্কুলে দু’বছর পড়েছিলেন বিনয়বাবু। ক্লাস ওয়ান থেকে টু’তে উঠতে নলিনাক্ষ ফার্স্ট হয়েছিল। ওই স্কুলের অনেক কথাই এখন আর মনে নেই। নলিনাক্ষর কথাও হয়তো মনে থকতো না যদি না ক্লাসে ওই হারিয়ে যাওয়ার ঘটনাটা ঘটত! বিনয়বাবুর বাবা বিনয়বাবুকে শহর থেকে একটা চুম্বক কিনে এনে দিয়েছিলেন। সেটা নিয়ে ক্লাসে গিয়েছিল দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র বিনয়। সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল চুম্বকের নানা খেলা দেখিয়ে। টিফিন পিরিয়ডে ভিড় জমিয়ে যখন চুম্বক দিয়ে সিকি আধুলি তোলা দেখে সবাই মুগ্ধ হয়ে দেখছে, এমন সময় সেটা এ হাত ও হাত হতে হতে হঠাৎই নিখৌঁজ হয়ে গেল। বিনয়ভূষণের স্পষ্ট মনে আছে নলিনাক্ষের হাতে ও চুম্বকটা শেষ বার দেখেছিল। তার পরই চুম্বক হারিয়ে যায়। বিনয় নালিশও করেছিল স্যারের কাছে নলিনাক্ষের নামে। কিন্তু ফার্স্ট বয়ের নামে নালিশ স্যার কানে তো তুললেনই না উলটে ক্লাসে খেলার জিনিস আনার জন্য বকা খেয়েছিল বিনয়। এর পর দু’জনের কথা বন্ধ হয়ে যায়।
এর মাস ছ’য়েক পরে বিনয়ের বাবা ফের বদলি হয়ে অন্য খানে চলে যান। ফলে বিনয়কেও স্কুল ছেড়ে অন্য স্কুলে ভরতি হতে হয়। তার পর কয়েক দশক কেটে গেছে। হঠাৎ এই চিঠি পেয়ে শৈশবের অনেক স্মৃতি ফিরে এল। নলিনাক্ষ লিখেছে. ‘তুই তো নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াস। পারলে এখানে এক বার আয়। বহু বছর কেটে গেল। এখনও তোর কথা খুব মনে পড়ে। ইতি। নলিনাক্ষ।
নলিনাক্ষর চিঠির মাথা মুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারলেন না বিনয়। কিন্তু চিঠিটা পুরোনো স্মৃতি এমন উসকে দিল যে তাতেই কয়েক দিন বিভোর হয়ে থাকলেন বিনয়ভূষণ। শেষ পর্যন্ত ঠিক করলেন এক বার ঘুরেই আসবেন। সবে বর্ষার শুরু। অফিসে দু’দিনের ছুটি নিয়ে এক শুক্রবার রাতে ব্যাগ গুছিয়ে দার্জিলিং মেলে উঠে জলপাইগুড়ির উদ্দেশে রওনা দিলেন বিনয়ভূষণ।
সকালবেলা নিউজলপাইগুড়িতে নেমে বাসে জলপাইগুড়ি। সেখান থেকে বাস বদলে আরও ঘণ্টা খানেক। এসব করে যখন সেই ছেলেবেলার স্কুলের সামনে গিয়ে পৌঁছলেন তখন সকালের স্কুল সবে ছুটি হয়েছে। মায়েদের হাত ধরে বাচ্চারা বাড়ি ফিরছে। পাল্টায়নি কিছুই। তবে অনেক কিছুই আগের থেকে ঝক ঝকে হয়েছে। তখন স্কুল ড্রেস ছিল না। এখন হয়েছে। তখন চা-বাগানের অনেক বাচ্চা খালি পায়ে স্কুলে আসত। এখন সবার পায়েই জুতো। মায়েদের শাড়িও অনেক বেশি রঙিন মনে হল। নলিনাক্ষর বাড়িটা মনে পড়ে গেল। বাজার ছাড়িয়ে রেল লাইন পেরিয়ে সেই বাড়ির সামনে গিয়ে দেখা গেল, সেখানে একটা তিনতলা বাড়ি উঠে গেছে। কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলেও নলিনাক্ষর কোনও খোঁজ পাওয়া গেল না। কত কাল আগের কথা কেউ চিনতেও পারল না। বিনয়ভূষণের মনে হল, নলিনাক্ষরাও হয়তো বহু কাল আগেই এখান থেকে চলে গেছে। লোকে ভুলেও গেছে। যা হয় আর কি! হয়তো নলিনাক্ষর ডাক নাম বা বাবার নাম জানা থাকলে আরও একটু খোঁজ খবর করা যেত। কিন্তু সে সব আর বিনয়ভূষণের মনে নেই। হাল ছেড়ে দিয়ে বিনয়ভূষণ এবার গেলেন তাঁর নিজের ছেলেবেলার বাড়িটার খোঁজে। হাতে সময় কম। ততক্ষণে বিকেল হয়ে এসেছে। ফেরার বাস ধরতে হলে আধ ঘণ্টার মধ্যে আবার ফিরে আসতে হবে বড় রাস্তায়। মিনিট পনেরো হেঁটে চা-বাগানের ধারে বিনয়ভূষণ খুঁজে পেলেন বাড়িটা। প্রায় একই রকম আছে। প্রায় চার দশক পর। আশ্চর্য, কাঠের গেটটাও যেন বদলায়নি মনে হল। বাড়ির পাশের বিশাল পাথরটাও এখনও আছে। তবে তাতে কারা যেন রং দিয়ে আয়া সেন্টারের বিজ্ঞাপন লিখে দিয়েছে। সেই পাথরের উপরেই বিনয়ভূষণ বসলেন। ঠিক যেমন ছোটবেলায় বসতেন। ওই পাথরটায় একটা ছোট্ট কিন্তু গভীর গর্ত ছিল। তখন সবাই বলেছিল, ডিনামাইট দিয়ে পাহাড় ফাটানোর গর্ত ওটা। ওই ফুটোয় একটা সিকি পড়ে গিয়েছিল বিনয়ভূষণের। কাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে অনেক চেষ্টা করেও সেটা তখন বার করতে পারেনি। সেই ফুটোটা ওই পাথরে এখনও আছে। তবে ধুলো, মাটি পড়ে অনেকটাই বুজে এসেছে।
বাড়ির বারান্দায় একটা বাচ্চা ছেলে দিদিমা বা ঠাকুমার ভারি পাওয়ারে চশমা পরে আস্তে আস্তে হাঁটছে। এই খেলাটা বিনয়ভুষণেরও চেনা। ছোটবেলায় ঠিক এই ভাবেই তিনিও হেঁটেছেন এই বারান্দায়। ওই রকম ভারি বাই ফোকাল চশমা পরলে মেঝে উচু নিচু দেখায়। হাঁটতে ভয় ভয় করে। মনে হয় এখুনি যেন পড়ে যাব। মনে মনে হাসলেন। নিজেকেই প্রশ্ন করলেন, সময় কি তাহলে এখানে থেমে আছে? ছেলেটাকে হাত নেড়ে ডাকলেন। কাছে আসতে বুঝলেন, ছেলেটি কথা বলতে পারে না। মনটা খারাপ হয়ে গেল। বাড়িটার পিছনে বিরাট মাঠ। বিনয়ের মনে পড়ে গেল। ওই মাঠে চা-বাগানের মালিক, ম্যানেজাররা গলফ্ খেলতেন। এক বার ওদের গলফ্ বল হারিয়ে গিয়েছিল। বল কুড়োনোর ছেলেটা বল খুঁজতে খুঁজতে বিনয়দের বাড়ির কাছে চলে এসেছিল।পায়নি। তার অনেক দিন পর বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে মাঠের প্রান্তে একটা গাছের নীচে একটা গলফ্ বল কুড়িয়ে পেয়েছিল বিনয়। বলটা হাতে তুলে নিয়ে জামা দিয়ে মুছতেই তার সাদাটে ভাব ফিরে এল। মনে মনে ভাবল, এটা নিশ্চয়ই সেই বলটা। বিনয়ের ইচ্ছে হল বলটা নিয়ে বাড়ি ফেরে। কিন্তু অন্যের জিনিস নেওয়া ঠিক নয়। দোটানায় পড়ল। তার পর, যাতে আর কেউ না পায়, বোধ হয় এই ভেবেই, যত জোরে পারল বলটাকে ছুড়ে মারল। বলটা আবার হারিয়ে গেল বিরাট মাঠে। সন্ধে হয়ে এসেছে। একটু একটু হাওয়া উঠেছে। জায়গাটায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বিনয় দেখতে পেল ফ্যাকাশে একটা সাপের খোলস গাছের নীচে পড়ে আছে। হাওয়ায় একটু একটু নড়ছে। একটু দূর থেকে বিনয় সেটা মন দিয়ে দেখতে থাকল। একটা দমকা হাওয়া খোলসটাকে উড়িয়ে নিয়ে চলে গেল। হাওয়ার টানে খোলসটা ঘাসের উপর দিয়ে যেতে যেতে মিলিয়ে গেল। আর দেখা গেল না।
এই সব ভাবতে ভাবতেই ঘড়ির দিকে তাকালেন বিনয়ভূষণ। মাত্র সাত মিনিট বাকি বাস আসতে। তড়িঘড়ি হাঁটা দিলেন বাস স্ট্যান্ডের দিকে। বড় রাস্তার মোড়ে এসে দেখলেন, আরও কয়েক জন দাঁড়িয়ে। বাস ধরার জন্য। সবাই জলপাইগুড়ির বাস ধরবে। বাস তখনও আসেনি। পাশের চায়ের দোকান থেকে চা চেয়ে নিয়ে সবে প্রথম চুমুকটা দিয়েছেন, এমন সময় কানে এল, কে এক জন যেন বলে উঠল, ওই বাস আসছে। গরম চায়ে দু'বার চুমুক দিলেন বিনয়ভুষণ। হঠাৎ এক জন যেন পিঠে হাত রাখল। ফিরে তাকাতেই সে বলে উঠল, কীরে চিনতে পারলি না! আমি নলিনাক্ষ। সত্যিই চিনতে পারেননি বিনয়ভূষণ। কিন্তু মুহূর্তেই সব মনে পড়ে গেল। বাস এসে দাঁড়িয়েছে। নলিনাক্ষ বলল, দেরি হয়ে গেল। কথা তো হল না। আমার মোবাইল নম্বরটা লিখে নে। ফোন করিস। বিনয়ভূষণ পকেট থেকে পেন বার করে নিজের হাতের পাতায় নম্বরটা লিখে নিলেন। তাড়াহুড়োয় আর নিজের নম্বরটা দেওয়াই হল না। বাস স্টার্ট দিয়েছে। দু’জনে দু’জনকে জড়িয়ে ধরল। তার পর বিনয়ভূষণ বাসের পাদানিতে পা রেখে বলল, আমি ফোন করব। ভাল থাকিস। এমন সময় ছুটে এসে নলিনাক্ষ কাগজে মোড়ানো কি যেন একটা বিনয়ভূষণের হাতে দিয়ে বলল, 'এটা তোর জন্য এনেছিলাম'। হাসল নলিনাক্ষ। বাস ততক্ষণে ধুলো উড়িয়ে অনেক দূরে। সন্ধ্যা নেমেছে। বাসের ভেতর প্রবল গরম। কয়েকটা স্টপেজ পেরোনোর পর পেছনের দিকে জানলার ধারে একটা বসার জায়গা পেলেন বিনয়ভূষণ। গুছিয়ে বসে হাওয়ায় একটু আরাম হল। হঠাৎ নলিনাক্ষর দেওয়া প্যাকেটটার কথা মনে পড়ল। কাগজের মোড়ক খুলতেই গা শির শির করে উঠল। সেই ছেলেবেলায় হারিয়ে যাওয়া চুম্বক। তার এখানে ওখানে মরচে পড়েছে। ভাবলেন তখনই মোবাইলে ফোন করবেন নলিনাক্ষকে। কিন্তু ততক্ষণে ঘামে হাতে লেখা নম্বর ধেবড়ে গেছে। মুছেও গেছে কয়েকটা সংখ্যা। আন্দাজ করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বিভিন্ন নম্বরে কয়েক বার ফোন করার চেষ্টা করলেন বিনয়ভূষণ। তবে তাতে লাভ হল না।
সামান্য ঘটনা অনেকের জীবনে অসামান্য প্রভাব ফেলে। কেন এমন হয়, তার উত্তর সচারচর মেলে না। যদিও বা মেলে, যার বা যাদের জীবন সম্পূর্ণ অন্য অজানা পথে চলতে শুরু করে এমন ঘটনায়, তার বা তাদের কোনও কাজে আসে না সেই উত্তর। বিনয়ভূষণের জীবনেও তেমনই কিছু ঘটেছিল। জলপাইগুড়ি থেকে ফিরে খুব চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলেন বিনয়ভূষণ। কী এক অজানা চিন্তায় ছেলেবেলার সেই ফিরে আসা চুম্বক যেন বিনয়ভূষণের মন এবং সব বোধকে একটা আলপিনের মতো টেনে ধরেছিল। অফিসে অনিয়মিত হয়ে পড়লেন বিনয়ভূষণ। বাড়ি থেকে বেরোতেন কম। এই ভাবে চলতে থাকল। কয়েক মাস। বা, বছরও হতে পারে। এক দিন সকালে পাড়ার সবাই দেখল, বিনয়ভূষণের বাড়ির সদর দরজা হাট করে খোলা। কেউ নেই। সারা দিন এই ভাবে কাটল। সন্ধ্যায় স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য এসে দরজায় তালা দিয়ে গেলেন। আশপাশের লোক জনকে বলে গেলেন, বিনয়ভূষণ ফিরে এলে তাঁকে যেন বলা হয় চাবি পঞ্চায়েত অফিসে রাখা আছে। কিন্তু বিনয়ভূষণ ফিরলেন না। দশ-বারো বছর এই ভাবে বন্ধ থাকলো বিনয়ভূষণের বাড়ি। তার পর এক দিন পাড়ার লোক জন সবাই মিলে ঠিক করল, ওই বাড়িতে তারা 'বিনয়ভূষণ স্মৃতি পাঠাগার' তৈরি করবে। এক রবিবার সবাই মিলে পোকায় খাওয়া, ভেঙে পড়া বিনয়ভূষণের সমস্ত আসবাব ট্রাক বোঝাই করে তুলে ধাপা্য় পাঠিয়ে দিল। ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে একটা রাইটিং প্যাড পাওয়া গেল। তাতে বিনয় ভূষণ লিখেছেন, 'রাতে যখন সব নীরব হয়ে যায়, টিউবলাইটের আলোয় আমি এক দিন দেখতে পাই কালো পিচ রাস্তা দিয়ে সাদা শাড়ি পরে সমরের ঠাকুমা হেঁটে যাচ্ছেন। কথাও বলেছি। কথা দিয়েছেন, আমাকেও নিয়ে যাবেন। কাল সেই দিন। আমি চলে যাচ্ছি'। নীচে বিনয়ভূষণের নাম লেখা।
কাগজটা এ হাত ও হাত ঘুরতে থাকল। সবাই বলল, লোকটা পাগল হয়ে গিয়েছিল। কেউ কেউ বলল, আগে বুঝলে লোকটাকে ডাক্তার দেখানোর ব্যবস্থা করা যেত।
এখন 'বিনয়ভূষণ স্মৃতি পাঠাগার'-এর সামনে বাগান হয়েছে। নানা রকম ফুল ফোটে সেখানে। মৌমাছি, প্রজাপতি ওড়ে সকাল, দুপুর। পাড়ায় অনেক নতুন ফ্ল্যাট বাড়ি হয়েছে। পাড়ার নতুন লোকেরা কেউ কেউ মাঝে মাঝে 'বিনয়ভূষণ স্মৃতি পাঠাগার' নাম দেখে জানতে চায়, বিনয়ভূষণ লোকটা কে ছিল!