কলকাতার রাতের রজনীগন্ধারা

“নিশি ফুরালে কেহ চায় না আমায় জানি গো আর…”
স্বকীয় গায়কির মূর্ছনায় মাত করে দেওয়াই হোক কিংবা নাচ বা অভিনয়ের জাদুতে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখা শৌখিন জলসাঘর, অথবা নাট্যমঞ্চ বা পাঁচতারা হোটেলের বলরুমের সান্ধ্য মজলিসের প্রাণভোমরা ‘রাতের রজনীগন্ধা’-র মতন সুবাসিত শিল্পীরা তাঁদের প্রাপ্য সম্মানের পরিবর্তে বঞ্চনা বা কদর্য প্রস্তাবের সম্মুখীন হয়েছেন বরাবর।
রাতকে দিন করে রাখা এই ‘নিশিপদ্ম’ শিল্পীদের মগ্ন সাধিকার সম্মান পাওয়া তো দূরস্থান, রাতের বেলায় নেশাতুর ‘কেয়া বাৎ’-এর তারিফ বর্ষণ, আর দিনের আলোয় কার্যত ব্রাত্যজন করে রেখে রুচিশীল বাবুদের ছুৎমার্গ বাঁচিয়ে চলতে চাওয়ার দ্বিচারিতা সর্বজন বিদিত।
অভিনয়ের বাঙ্ময়তায় বা সুরের মূর্ছনার রোশনাইতে মুগ্ধ করে দেওয়া, কিংবা শরীরী বিভঙ্গের মাপা লাস্যে পুরুষ-হৃদয়ে ঝড় তোলা এই রাতপরীদের কুহকীনির সঙ্গে তুলনা নতুন কিছু নয়। অথচ রাতকে দিন করে রাখা এই ‘নিশিপদ্ম’ শিল্পীদের মগ্ন সাধিকার সম্মান পাওয়া তো দূরস্থান, রাতের বেলায় নেশাতুর ‘কেয়া বাৎ’-এর তারিফ বর্ষণ, আর দিনের আলোয় কার্যত ব্রাত্যজন করে রেখে রুচিশীল বাবুদের ছুৎমার্গ বাঁচিয়ে চলতে চাওয়ার দ্বিচারিতা সর্বজন বিদিত। অথচ রাত বাড়লেই রং-বোতলের রঙিন ঘোলাটে আলোয় হোক বা চোখ টাটানো নিয়ন আলো আর রাতের অন্ধকারের সুযোগে, এই বাবু বা ধনীক শ্রেণির পুরুষদেরই বক্ষলগ্না বা সজ্জা সঙ্গিনী হওয়ার অহরহ প্রস্তাবে তথাকথিত শিক্ষিত রুচিশীল বাঙালির চারিত্রিক স্খলন যুগে যুগে প্রত্যক্ষ করেছে বিনোদিনী থেকে গওহর জান হয়ে মিস শেফালিরা।
বিনোদিনী দাসী
ভোগবাদী, অর্থবান পিতৃতান্ত্রিক পুরুষ সমাজের প্রতিনিধিরা অর্থের বলিয়ানে করায়ত্ত করতে চেয়েছে যেকোনো কিছু। তৎকালীন সমাজের রেস্তওয়ালা প্রতিনিধিদেরই নির্ধারিত কিছু বিশ্রী শব্দবন্ধনী যেমন ‘নটি’, ‘তাওয়ায়েফ’ কিংবা ‘ক্যাবারে ক্যুইন’ – কোথাও যেন শিল্পীর আত্মমর্যাদাকে পদদলিত করে কালিমালিপ্ত করবারই প্রয়াস। কেবলমাত্র মঞ্চের বা রুপোলি জগতের পেশার সঙ্গে যুক্ত কোনো নারী শিল্পী মাত্রই সে সস্তা ভোগ্যপণ্য, এমনটা যে কিছুতেই নয়, এই কদর্য ভাবনার বিরুদ্ধে বারবার সোচ্চার হতে চেয়েছেন এই প্রথিতযশা শিল্পীরা। কিন্তু ‘সেই ট্রাডিশান সমানে চলছে’-র মতোই তথাকথিত শিক্ষিত, উর্দ্ধতন সামাজিক প্রতিপত্তির ব্যক্তিবর্গের এই ‘নাইট ক্যুইন’-দের প্রতি হামলে পড়তে চাওয়া আদতে যে তাঁদের চারিত্রিক স্খলনেরই প্রমাণ, সঙ্গে তাদের আরোপিত রুচিশীল মুখোশের খসে পড়বার সাক্ষী যুগে যুগে বিনোদিনী দাসী থেকে গওহর জান থেকে মায় মিস শেফালি-রা।
শিল্পীর শৈল্পিক মাধুর্য বরাবর হার মানায় নানান প্রতিকূলতাকে। নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে সাধনালব্ধ প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হন না কেউই। সেখানে কোনোকালেই নেই কোনো উচ্চ-নীচ ভেদাভেদ। নিষাদ বংশজাত একলব্য যেরকম আয়ত্ত করেন নিজ স্বকীয়তায় ধনুর্বিদ্যা; বিনোদিনী কিংবা মিস শেফালিদের গল্পটাও কোথাও যেন একই। ওঁদের জীবনের শুধুমাত্র টিকে থাকবার বিরামহীন লড়াই ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী-গদ্যময়…’ এই শ্লেষাত্মক উপমারই যেন জীবন্ত বাস্তব উদাহরণ। তাই ভুখা পেটের খুদা নিবারণের দায়ে, দু-মুঠো অন্য সংস্থানের তাগিদেই গরিবীনি, অনাথা মেয়েগুলির মধ্যে থেকেই কেউ কেউ আব্রুর অবগুন্ঠন সরিয়ে সামাজিক রীতিনীতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে হয়ে ওঠে জ্যান্ত ‘নিশিপদ্ম’। একদা অনাম্নী, অপাংক্তেয়, অশিক্ষিত কিশোরীই তাঁর অভিনয়ের নৈপুণ্যে জিতে নেয় গোটা কলকাতার রঙ্গমঞ্চকে। হয়ে ওঠে হাতিবাগান থিয়েটার পাড়ার অবিসংবাদী ‘স্টার’ বিনোদিনী। যাঁর অভিনীত ‘চৈতন্যলীলা’ দেখতে ছুটে আসেন খোদ পরমহংস। স্নেহাশিস ঢেলে বলে ওঠেন ‘তোমার চৈতন্য হোক’ বা সেই অমোঘ বাণী ‘থেটারে লোক শিক্ষা হয়’।
শুধুই আশরাফির ঝঙ্কারেই ‘সাত মন তেল পুড়িয়ে রাধা নাচবে না তো চাঁদু’ এই বোধ; বা নটি-নর্তকী বা গাইয়ে মাত্রই সে সস্তা ভোগ্যপণ্য কিছুতেই নয়। তাঁর একমাত্র পরিচিতি তিনি শিল্পী।
গওহর জান
সদ্য আগত ডিস্ক ফরম্যাটের লং প্লেয়িং রেকর্ডারে হিন্দুস্তানি মার্গ সংগীতের শ্রেষ্ঠ শাস্ত্রীয় নারী সংগীত শিল্পীর কণ্ঠে ঠুমরি শেষে শুনতে পাওয়া চোস্ত ইংরেজি উচ্চারণে – মাই নেম ইজ গওহর জান। অর্থের ঝনঝনানিকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে একদা পিতৃপরিচয় বিচ্ছিনা ‘কলকেত্তাওয়ালি’ গওহর জান পোষা বেড়ালের সন্তান প্রসবের উদযাপনে, দাওয়াত বাবদ খরচ করেন তৎকালীন বিশ হাজার টাকা। সেকালের বৃটিশ সমাজের নিয়মকে পরোয়া না করে নিজেই তুলে নেন হাতে ছয় ঘোড়ায় টানা জুড়ি গাড়ির চাবুক। তৎকালীন ব্রিটিশ যুগে কোনো ভারতীয়ের জুড়ি গাড়ি করে ভ্রমণে নির্ধারিত ফাইন হাজার টাকাকে হেলায় উপেক্ষা করে।
মিস শেফালি
কিংবা আরতি দাস-এর মতন অপরিচিত কোনো অষ্টাদশী, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মালিকের বাড়িতে ফাই ফরমাশ খাটবার ফাঁকে ফাঁকে শিখে নেওয়া হাওয়াইয়ান, টুইস্ট, কিংবা চা-চা-চা-র মতন বিদেশি স্বল্পবসনা নৃত্যশৈলীর ওপর ভর করে বনে যান কলকাতার সন্ধ্যারাতের সম্রাজ্ঞী মিস শেফালি। তাঁকে ছুঁতে চাওয়ায়, একান্ত সান্নিধ্য লাভে সামিল হতে চান তৎকালীন ম্যাটিনি আইডল থেকে শুরু করে বিত্তবান, অর্থবান সমাজের সর্বোচ্চ স্তরে থাকা সফল পুরুষেরাও। কলকাতায় উঠলে যাঁর গুণমুগ্ধে সামিল হতেন খোদ অ্যাংরি ইয়ং ম্যান অবধি। কলকাতা তথা ভারতবর্ষের সর্বকালীন অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পরিচালকের একাধিক সিনেমাতে সুযোগ পান নিজ গুণে। এখানেই যেন কোথাও জিতে জান বিনোদিনী, গওহর জান, মিস শেফালির মতন শিল্পীরা।
শুধুই আশরাফির ঝঙ্কারেই ‘সাত মন তেল পুড়িয়ে রাধা নাচবে না তো চাঁদু’ এই বোধ; বা নটি-নর্তকী বা গাইয়ে মাত্রই সে সস্তা ভোগ্যপণ্য কিছুতেই নয়। তাঁর একমাত্র পরিচিতি তিনি শিল্পী। তাঁর একান্ত দাবি, গুণমুগ্ধের প্রাপ্য তারিফি নজরানায় দু-হাত ভরে উজাড় করে দেওয়া কুর্নিশি সম্মানের ডালি। এই রুচিবোধ বা শিক্ষা আজও মুষ্টিমেয় জনগণের মধ্যেই বর্তমান। যুগপথকাল ধরে শিল্পীর মর্যাদা কার্যত লড়াই করে ছিনিয়ে নিতে হয়েছে রাতের কলকাতার সবচেয়ে উজ্বল এই নক্ষত্রত্রয়ীকে।