ভূমেন্দ্র গুহ-র দর্শন ও কবিতা

একজন মানুষ নিজের পেশাজীবনের সমগ্রতা দিয়ে যদি চ্যালেঞ্জ জানিয়ে থাকেন মৃত্যুকে আর সাহিত্য গবেষণার উঠোনে এসে নিজেকে সাষ্টাঙ্গে অর্পণ করেন একজনকে যথাযথ উপস্থাপনের ক্ষেত্রে(পাণ্ডুলিপি বা মূলানুগ পাঠ), পণ করেন অপরজনের পাঠক না পাওয়া সম্বুদ্ধ জীবনতৃষাকে প্রতিষ্ঠার, তাহলে যে ধাঁধার জন্ম হয় তার নাম ভূমেন্দ্র গুহ। সেই একজন বলাই বাহুল্য জীবনানন্দ, অপরজন সঞ্জয় ভট্টাচার্য। দ্বিতীয় জন দু-দুবার আত্মঘাতী হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। ভূমেন্দ্রও তিনবার, প্রথমে সঞ্জয় ভট্টাচার্য ও জীবনানন্দ দ্বারা ধারাবাহিক ভর্তসিত হয়ে, যে ডাক্তার হয়ে জীবনের যাবতীয় স্বাচ্ছন্দের যোগার করে কাব্যচর্চা হয় না, জীবনানন্দের ভাষায়, ‘বেঁচে থাকার সহজ সাফল্যগুলো সব ছাড়তে শিখতে হয়। অনেকটা কাপালিকের মতো হয়ে যেতে হয় প্রায়’। ব্যাস, তিনি আপাতভাবে সুস্থির করলেন পারিবারিক অভাবের সঙ্গে যুঝতে আপাতত কবিতার সঙ্গে সম্পর্ক শেষ, দ্বিতীয়, জীবনানন্দের মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে ময়ূখের সংখ্যা প্রকাশ এবং তাঁর পাণ্ডুলিপির পাঠোদ্ধারেই সীমিত থাকবে তাঁর সাহিত্যচর্চা। তৃতীয়, ভূমেন্দ্রর নিজের জেনে নেওয়ার মুহূর্ত যে তার প্রস্টেটে ক্যানসার হয়েছে, অথচ মেডিকেল কলেজের থোরাসিক সার্জারি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা তারপর থেকেই একের পর পর এক মুহূর্ত বিন্যাস সাজিয়েছেন, পরিকল্পনা করেছেন প্রায় বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুকে চোখ রাঙাবার, এবার নিজের মৃত্যুর সঙ্গে যাকে বলে ‘আই টু আই চ্যালেঞ্জ’- এ কথা বলেছেন। এবং শেষাবধি নিজেকে সমর্পণ করছেন মৃত্যুতে, ভাবখানা এমন, আমিও দেখে নিতে চেয়ে ছিলাম। তো জীবনের একটা বড় সময় ধরে বিভিন্ন প্রত্যাঘাতে নিজের কবিতাচর্চা থেকে এক ধরণের সচেতন বিচ্ছিন্নতা রচনার প্রয়াস তাঁর মধ্যে ছিল, বা সেটা বাধ্যতামূলক ছিল।
আবার এই বিচ্ছিন্নতার মুহূর্তগুলিতে বিশ্বসাহিত্যের গলিঘুঁজিতে, শিল্পের, দর্শনের ইতিহাসে তাঁর মায়াবী বিচরণ জারী থেকেছে। পুরাণের ধূলি-ধূসরিত পাতায় পড়েছে তাঁর মেধাবী পদচারণার ছাপ। আর সেই সব গ্রহণ এবং গ্রন্থনের প্রস্তুতিতে যে অনেকাংশেই শাসন করেছে কাব্যতৃষা তা তাঁর কবিতাগুলির সামনে দাঁড়ালেই বোঝা যায়। প্রথম বই ‘যম’-এর লিখিত কবিতাগুলির সময় কাল ১৯৫৫-১৯৯৪। বইটি প্রকাশিত হচ্ছে ১৯৯৪ তেই। ১৯৩৩ সালে জন্ম হওয়া এই কবির প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫২ সালে, ‘পূর্বাশা’ পত্রিকায়। এই যে সুদীর্ঘ অপেক্ষা বা উপেক্ষা বা নির্লিপ্তি নিজেকে সংকলিত না করার, একে কী আমরা প্রস্তুতিপর্ব বলব? না কী এও এক ধরণের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া নিজেকে, স্ব-গ্রন্থনার নিবিড় ‘আশ্রয়’ থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসন?
না, এই প্রশ্নের কোনও একরৈখিক সমাধান পথ বের করতে বসিনি। বিস্ময় থেকে উদ্ভূত এই সব স্বগতকথন জেগে উঠছে বারবার। কেননা পাঠকক্ষে এখন, রাহুল পুরকায়স্থ সম্পাদিত দুই খণ্ডের সুবিশাল গ্রন্থ ভূমেন্দ্র গুহ-র কবিতা। কবির মৃত্যুর আগে ২০১৫-র অগস্ট মাসে ‘এবং মুশায়েরা’ প্রকাশনের উদ্যোগে প্রকাশিত বই দুটির উৎসর্গপত্রে ভূমেন্দ্র গুহ লিখেছেন,
‘যাঁরা আমার কবিতা পড়েছেন
যাঁরা আমার কবিতা পড়েন নি
যাঁরা আমার কবিতা পড়েন
যাঁরা আমার কবিতা পড়েন না
যাঁরা আমার কবিতা পড়বেন
যাঁরা আমার কবিতা পড়বেন না’
দ্বিকোটিক যুক্তিবিজ্ঞানের আশ্রয় নিয়ে মৃত/জীবিত/অনাগত সমগ্র পাঠকসত্তায় নিজেকে নিবেদনের এমন মেধাবী বাসনা নজিরবিহীন। এর মধ্যেই রয়েছে কবিতা নিয়ে সারা জীবন ধরে সইতে থাকা নানা অপমান ও উপেক্ষার বিনীত উত্তরও। কিন্তু সেসব অনীহার উত্তর দিচ্ছে দু খণ্ড মিলিয়ে ১২৫৮ পাতার এই মহাগ্রন্থ। এর মধ্যে কবির কবিতাই কেবল নয়, তাঁর দ্বারা কৃত কবিতার অনুবাদ, রণজিৎ দাশ এবং গৌতম বসুকে দেওয়া দুটি সুদীর্ঘ সাক্ষাৎকার, তাঁর কবিতার বইয়ের দুটি আলোচনা সহ তাঁর আত্মকথনও সংযুক্ত হয়েছে। আমরা তাঁর কবিতার দর্শনকে পড়ার পাশাপাশি চোখ রাখবো একটি কথোপকথনে। বইটির সম্পাদক কবি রাহুল পুরকায়স্থর মুখোমুখি হয়েছিলাম ভূমেন্দ্র গুহ-র মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই। বিষয় ছিল এই মহাগ্রন্থ। সান্ধ্য সান্দ্র আড্ডায় উঠে এসেছিল এমন কিছু জরুরি কথা যা বর্তমান বাচনটিকে অনায়াসেই শাসন করতে পারে। যদিও সেই রচনাটি বেশ কিছু কাল আগে একটি ছোট কবিতাপত্রে প্রকাশিত হয়েছে তবু মনে হয় ভূমেন্দ্র গুহ-র কবিতার মতোই স্বল্প পঠিত বা না-পঠিত। তাই এ লেখার শিরদাঁড়ায় সেই আড্ডার নির্বাচিত স্মৃতি প্রবাহিত হলে মহাভারত অশুদ্ধ হবে না বলেই মনে হয়, বরং ভূমেন্দ্র গুহ-র কবিতাকে দেখার কিছু সম্ভাবনাময় আঙ্গিক তৈরি হতে পারে মাত্র।
সুকল্প- তুমি লিখেছ তোমার ভূমিকায়, যখন একজন মানুষ নিজেকে সন্দেহ করে, তখন শিল্পের জন্ম হয়। এটা তোমার নিজের তত্ত্ব, তোমার বিশ্বাস, তোমার লেখালেখি থেকে উদ্ভুত তত্ত্ব আমি জানি। কিন্তু এটা ভূমেনদার লেখালেখির ক্ষেত্রে তুমি কীভাবে প্রয়োগ করছো?
রাহুল- যে কোনও কবি সম্পর্কেই কথাটা...প্রথমত ভূমেনদা একজন কবি, অনেকের মানতে কী যে কষ্ট হয়, কিন্তু তিনি আগাপাশতলা একজন কবি, প্রয়োজনীয় কবি বলে মনে করি। তো একটা কবি তো সেই দীর্ঘ পথ... একটা সময় ছিল যখন ‘যম’ লিখলেন, ‘ঋতুচক্র’ লিখলেন। অসাধারণ সমস্ত বই। তবে সবকিছু অসাধারণ থাকে না সব সময়। বয়স আছে, অভিজ্ঞতা আছে, একটা মানুষ শেষ পর্যন্ত নিরাভরণ হতে পারে। এই যে আমি এতদিন যা কিছু লিখে এলাম, তা কি সত্যিই কিছু হয়েছে নাকি কিছুই হয়নি। এবার তিনি কাঁদতে শুরু করলেন। সন্দেহ করছেন আর লিখছেন, যত লিখছেন নিরাভরণ হচ্ছেন। ফলে একটা স্টেটমেন্টের দিকে তাঁর যাত্রা, একটা স্টেটমেন্ট। শেষের দিকে মনে হত যখন তিনি নিজেকে সন্দেহ করছেন তখনই একটা আর্ট ফর্ম জন্ম নিচ্ছে। তিনি যখন স্থিরও থাকতেন তখনও সন্দেহ জন্ম নিত কিন্তু। ফলে এই সন্দেহ না থাকলে কিন্তু...পিউরিফিকেশন বা সংশয়...পাগল হচ্ছেন, উন্মাদনা বাড়ছে...চারদিকে তছনছ করছেন, সবকিছু সন্দেহ থেকেই জাগছে। এই লোকটা এতদিন ধরে যে লিখেছেন, কৌশল দেখিয়েছেন, লেখালিখির তো একটা কৌশল থাকে, এ সবকিছুকে সন্দেহ করছেন। আত্মতৃপ্তির কোন জায়গা সাহিত্যে আছে বলে মনে হয় না, ভূমেনবাবু তার উজ্জ্বল নিদর্শন বলে আমার মনে হয়।
সুকল্প—বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে শঙ্খবাবু যেটা বললেন, যা নিয়ে তোমার সাথে তাঁর মতান্তর হল সেটা ফের তোমার সন্দেহ তত্ত্ব। তুমি ভূমিকাতেও বলছ, যে সারা জীবন জীবনানন্দে অবগাহিত ভূমেনদার কবিতাতেও তার গভীর প্রভাব পড়েছিল। শঙ্খবাবু দ্বিমত পোষণ করার পরে তুমি আমাকে বলেছিলে, আজীবন যে মানুষটা জীবনানন্দের পাণ্ডুলিপি যাপন করল, তাঁর রচনায় জীবনানন্দের প্রভাব না থাকলে আমি তাঁকে সন্দেহ করি।
রাহুল-তাঁর লেখালিখির কাঠামোতে জীবনানন্দ ছিলেন, তিনি যখন সাফো অনুবাদ করছেন তখন ‘সফেন’ শব্দটি ব্যবহার করছেন...
সুকল্প-দেখো যতদূর আমার মনে পড়ছে, তুমি ভূমিকায় লিখেছ, জীবনানন্দ তাঁকে তাঁর কাব্য জীবনের প্রথম ভাগে...
রাহুল-দেখো, তিনি প্রথমে আক্রান্ত, পরে আচ্ছন্ন হন। আচ্ছন্নতার ক্ষেত্রে প্রভাবটা অত সরাসরি থাকে না, অনেকটা ফল্গু নদীর মতো বয়ে যায়। জীবনানন্দের জীবনের অন্ধকারটাও উনাকে গ্রাস করেছিল। কঠিন, নিগড় অন্ধকার ভূমেনদার ওপর প্রভাব ফেলেছিল।
সুকল্প—আমার তো মনে হয় কেবল জীবনানন্দ নয়, সঞ্জয় ভট্টাচার্যের অন্ধকারও তাঁর ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। তাছাড়া ভূমেনদার লেখাতেই পড়ছি, তিনি নিজেও জীবনানন্দের প্রভাব এড়ানোর পরীক্ষায় রত।
রাহুল—কিন্তু ১৯৫৪ সালেও ‘সাফো’ অনুবাদেও ‘সফেন’ শব্দটা...
সুকল্প—একটা কথা প্রতিনিয়ত মনে পড়ে, যখন সঞ্জয় ভট্টাচার্যের ডায়রিটা পড়ছি, উনি প্রতিনিয়ত আমাকে জিজ্ঞেস করতেন, কি বুঝছেন? আপনি কি বুঝছেন? আমি বলতাম যে কি বলব, একজন লেখক নিজেকে প্রস্তুত করছেন তাঁর আগামী রচনার জন্য। উনি বলতেন, হ্যাঁ, এটাই মূল কথা। সঞ্জয়বাবুর ডায়রিটা সেঁচে নিয়ে একটাই কথা, নিজেকে কোথাও প্রস্তুত করছেন পরবর্তী লেখার জন্য। সঞ্জয় ভট্টাচার্য না থাকলে ভূমেন্দ্র গুহ হত না। কেবল জীবনানন্দই নয়, উনি তাঁকে বিশ্বসাহিত্যের দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন। প্রথম দিকে ভূমেনদার কবিতার ওপর পুরাণের যে অনিবার্য প্রভাব তা সঞ্জয়বাবুরই অবদান।
রাহুল—এর পরই বোধহয় ওর এই দশাটিকে অস্বীকার পর্ব শুরু হয়। দারুণ কথা বললি, সত্যিই সঞ্জয়বাবু না থাকলে ভূমেন্দ্র গুহ হত না। এরপর তিনি পুরাণকে সাময়িক অবহেলা করে যেখানে পৌঁছলেন সেটা হল, ল্যাঙ্গুয়েজ অফ পাওয়ার ইজ ল্যাঙ্গুয়েজ অফ ফিউসন। ল্যাঙ্গুয়েজ অফ ফিউসন ইজ ল্যাঙ্গুয়েজ অফ আর্ট। বিভিন্ন বিষয় লেখার ভিতর ঢুকে পড়ে। চেতনা, পুরাণ এমনকি সল্টলেক পর্যন্ত। এই যে একটা মিশ্রণ তৈরি হয় এটা হচ্ছে নির্বিকল্প শিল্প।
সুকল্প—একটা বিষয় নিয়ে বোধহয় তুমিও আমার সাথে একমত হবে, সেটা হচ্ছে পুরাণকল্পে প্রোথিত মানবাত্মা, পুরাণের বারান্দায় পায়চারি করতে করতে যে মেলোড্রামা জন্ম নেয়, তা তো ভূমেনদার কবিতাময় ছড়িয়ে রয়েছে...
রাহুল—বাঙাল এবং বাঙালীর পুরাণ সমাজ চেতনায় এটা সংক্রমিত।
সুকল্প—মেলোড্রামা শিল্পের নিয়তি...যদি তাকে সুচারুভাবে ব্যবহার করা যায়। ‘পিতামহ’, ‘যম’, ‘উত্তরপুরুষ’—এ নির্লিপ্তভাবে এই মেলোড্রামা রয়েছে ক্রমাগত। আর...
রাহুল –নির্লিপ্ত ভাবে রয়েছে...
কবি জানাচ্ছেন, ‘একজন কবি/ লেখক সারাজীবন একটি বিষয়েই লেখেন, নানান দিক থেকে তাকে দেখতে চান, খুঁজতে চান। আমার লেখালেখিও মূলত একটি বিষয়কে ঘিরেই, একটি চক্রকে ঘিরেই-জন্ম, যৌনতা, মৃত্যুর একটি চক্র’। এই চক্রের ভিতরেই আবর্তিত হয়েছে ‘যম’ থেকে ‘বেলাশেষের অতিকথন’ সহ অপ্রকাশিত/অমুদ্রিত কবিতাগুলি। আর এই আবর্তনের মধ্যেই রচিত হয়েছে শিল্পের ‘নৈতিক’ সন্দর্ভ।
‘শুধু হাঁটা, হাঁটতে শুরু করা, কৃতজ্ঞতা সঞ্চিত রাখা পশুদের চর্মে মাংসে দুধে, অর্থাৎ তোমাকে ভোলা, হে জননী, তোমার গোপন রক্ত ভোলা, উত্তীর্ণ হবার জন্যে পাপ পঙ্কিলতা দাবি করি। বংশ পরিচয় মানে কিছু মনে রাখা, অভিমুখে রক্ত রক্ত স্থির করা।...বিসদৃশ তাঁতকলে কী বুনতে বলেছ তুমি, আমি কী বুনেছি। আমার রমণী। মাকুর আঘাতে দেখ রক্তকণা ভাঙি, ফের জোড়া দিই। ভবিষ্যৎ ঊর্ণনাভ হয়ে ওঠে ক্রমে। হে জননী, ক্ষেত্রজ্ঞ রমণী, আমি বসবাস চাই।’( যম ১) এই ‘বসবাস’-এর অর্থ অতিক্রমণ। জগতে নিক্ষিপ্ত সত্তার অস্তিত্বের অন্তর্লীন নির্দেশকে অতিক্রমণ, কী বুনতে বলেছ তুমি, আমি কী বুনেছি। এভাবেই জন্ম মুহূর্তের ‘থাকা’ থেকে ক্রম সরণের পথে ‘হয়ে উঠছি’-তে শিফটিং-এর ধারাবাহিকতা। এই বুনন বা বয়নের নিরিখে নিজের কবিতাবিশ্ব গড়ে তুলেছেন কবি। ‘ঋতুচক্র’ কাব্যগ্রন্থে পড়ি, ‘...অসময়। সময়হীনতা। কোষে কোষে অসময় জারিত হয়েছে বলে বিপর্যস্ত ফেনা।নিদ্রাহীন কেটে যায় জলভুক্ত হলে। সম্মুখীন সুনিদ্রা রয়েছে। নুনে ক্ষয়ে যাওয়া ছিল মানবীর কোলের ভিতরে। এইবার শুশ্রূষায় আঙুল গিয়েছে ভিজে জলের নিঃসীমে, গড়িয়েছে ঠোঁটে অক্ষিপটে। শুয়ে থাকা যায়, যেই মাত্র এই আস্থা বয়ন করার কথা ভাবি, দেখি ভঙ্গি গ’ড়ে তোলে মিথ্যুক সময়। চাঁদ ছিল, আর নেই। পরী ছিল, আর নেই। মানবী তেমন ক’রে কখনও ছিল কি? শুধু বুঝে নিতে শিখি গভীরে জলের ধ্বংস গর্জন করেছে। কয়েকটি আঙুল স্মৃতি কৃপণ ষাটটি আয়ু জলে শুতে বলে ব’লে ভোর রাত্রে ফেনশীর্ষে ছলকে উঠেছে।’ (এই ভাবে, ‘যম’)
রাহুল- উনি বিশ্বাস করতেন আত্মপীড়ন হচ্ছে লেখার অন্যতম উৎসস্থল। নিজেকে কষ্টে রাখতেন।
সুকল্প- তুমি বলেছিলে এটা শক্তির মধ্যেও ছিল। লেখা হচ্ছে না বলে নিজেকে উপবাসে রাখা।
রাহুল- হ্যাঁ, শক্তিদারও এটা ভয়ঙ্করভাবে ছিল। কবিতা আসছে না। এই আত্মপীড়ন কিন্তু মানুষকে কিছু একটা দেয়, আলো বা অন্ধকার কিছু একটা দেখায়। সাধকরা আত্মপীড়ন করেন বিভিন্ন ভাবে।
সুকল্প- যৌনতাকে অস্বীকার করার যৌনতা স্বীকার করেন তাঁরা।
রাহুল- হ্যাঁ এটা ভয়ঙ্কর, এই যে বিধ্বংসী চূড়ায় একটা মানুষকে উঠতে হয়। ভূমেনদা বলতেন, আমরা যে লেখায় ‘আমি’ বা ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করি আমরা আসলে আজীবন মৃত্যুর সঙ্গে কথা বলি।
সুকল্প- সব সর্বনামই মৃত্যু।
রাহুল- আমি সর্বনাশের সর্বনামের সঙ্গে কথা বলি। শিল্প সাহিত্যের যাবতীয় ‘তুমি’ বা ‘আমি’ আসলে মৃত্যু। ভূমেনদা এটা খুব বিশ্বাস করতেন। একটা অলৌকিক জায়গা তৈরি হয়। ‘ ও সাঁই, কেমনে ভুলিব আমি তারে’,এই যে ‘তারে’ মানে কারে? সাঁই কে? সাঁইও সেই মৃত্যু। ‘তারে’ও কিন্তু মৃত্যু। আমাদের গোচরে বা অগোচরে মৃত্যুকে আমরা সাজাই। সেই রাস্তা দিয়ে আমরা হেঁটে যাই। ভূমেনদা এই যে অলঙ্কারহীন হচ্ছেন সেই অলঙ্কার পরাচ্ছেন মৃত্যুকে। ওই আর কী।
জীবনানন্দের ‘কাপালিক হয়ে যেতে হয় প্রায়’ কে জীবনে লালন করেছেন ভূমেন্দ্র। ‘... শ্মশান বিবাহবেদী সমার্থক হতে থাকে ক্রমে। রমণীরা ঘুরে-ঘুরে নাচে ও দাঁড়ায়। তারপরও নাচে ও দাঁড়ায়। তারপরও নাচে। সমস্ত শরীর থেকে চৈত্রের চন্দন গলে বর্ণাঢ্য আমিষে। ঝিম গ’ড়ে ওঠে চুলে বাহুমূলে এবং নাভিতে। সঠিক নাভির বৃত্তে চন্দ্রহার দোলে, চুলে দোলে ফুল এবং শ্রীবাস। বিবাহবার্ষিকী। কাপালিক সঙ্গে এনেছি তো। এই চৈত্রমাসে। অন্ধকার নিদারুণ গুপ্ত হয়ে আছে। সাত্ত্বিকতা দেব ব’লে নাচব আমিও? সাত্ত্বিকতা চায়? পুষ্পকোরকের কাছে যখনই ঝুঁকেছি রক্তে ভিজে গেছে সর্বাঙ্গীন আমার শরীর। শিমুল তুলোর কোষে উড়ে গেছে সেই পূর্বাপর।’(বসন্ত- উৎসব-১, ‘ঋতুচক্র’)। কবির অভিযাত্রা মৃত্যু মাখে সারা শরীরে যখন, উচ্চারিত হয়, ‘... মৃত্যু মহান মিনারের মতো জাগিয়া উঠিতেছে, এইটুকু শুধু অশেষ শ্রদ্ধাভরে অনুভব করিবার চেষ্টা করিলাম।/ অথচ অধিগৃহীত প্রথা অনুযায়ী আমি তো জাগরিতই আছি বলিতে হইবে। সুস্থ আছি। (শহর, ‘ঋতুচক্র’)
রাহুল- বাংলা কবিতা যদি সত্য হয়, তাহলে পাঠককে একদিন ভূমেনদার কবিতার কাছে আসতে হবে।