“ভরোসা কোরে দেখুন” : হাস্যকর ‘বাংলা’ বিজ্ঞাপনে অযৌক্তিক ‘হিন্দির’ দাপট

কিছুদিন আগে বাংলা মাধ্যম নিয়ে এক রেডিও-জকির মন্তব্যে সারা বাংলা কীভাবে তোলপাড় হয়েছিল, তা আমরা জানি। বাঙালির পান থেকে চুন খসে পড়েছিল। কিন্তু, যেসব বাঙালিরা এই কাণ্ডে রে রে করে তেড়ে এসেছিলেন, তাঁরা কি কলকাতার পথে-ঘাটে বের হন না? বাড়িতে বসে কেবলই ফেসবুক করেন? তা না হলে, দেশের সাংস্কৃতিক রাজধানীর রাস্তায় প্রমাণ সাইজের হোর্ডিংয়ে (উপরের ছবিটি দ্রষ্টব্য) বাংলা বানানের বহর দেখে নিশ্চয়ই তাঁদের রাতের ঘুম উড়ে যেত।
কথায় কথায় বলি, “বাংলা ভাষা কী মধুর!” আমরা ব্যক্তিগত বিপ্লবে যতটা মুখর, কর্মে ততটা নই। তাই আজও ভুল বাংলা বাক্য ও বানান দেখে আমাদের কেমন গা সয়ে গেছে। কিংবা নিজেরাই সচেতন নই। ভয়ংকর পরিস্থিতি যেদিন বাড়িতে এসে হানা দেবে, সেইদিন উগড়ে পড়বে আমাদের ক্ষোভ রাগ। তার আগে? ওর হচ্ছে হোক, আমি তো ঠিক আছি – সাতেপাঁচে থাকব না বাবাহ! কী হবে প্রতিবাদ করে! ইত্যাদি প্রভৃতি। আমরা ভুলে যাই বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। আমরা ভুলে যাই ভারতের কোনো নির্দিষ্ট রাষ্ট্রভাষা নেই। আমরা ভুলে যাই ভারতের সকল ভাষাই সংবিধান স্বীকৃত। দিল্লির সরকার যতই হিন্দিকে আমাদের উপর চাপিয়ে দিক না কেন, আমরা ফেসবুক বা ট্যুইটারে বেশ প্রতিবাদ করব। কিন্তু সন্তানের স্কুল হবে বিখ্যাত ইংরেজি মিডিয়াম। সেখানে তার তৃতীয় ভাষা হবে বাংলা। অর্থাৎ ইংরেজি ও হিন্দির পর। আমরাই অঘোষিতভাবে বাংলাকে সমস্ত জায়গা থেকে বঞ্চিত করব। আস্ত একটা বাঙালি জাতি – তার যে কী হবে!
কলকাতার রাস্তায় সর্বত্র বড়ো বড়ো করে হোর্ডিং পড়েছে বেসরকারি একটি গাড়ি-কোম্পানির। যেখানে কপিতে লেখা, “ভরোসা কোরে দেখুন”। এবার আপনারাই বলুন, এভাবে কি ভরসা করা যায়? বাংলা বিজ্ঞাপনের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁদের শরীর রাগে রি-রি করতে বাধ্য। কিন্তু কলকাতার মতো রাজধানী এলাকায় কেন এই বিজ্ঞাপন এক সপ্তাহের বেশিদিন ধরে দেখা যাচ্ছে? দ্রুতসম্ভব এই বিজ্ঞাপন তুলে ফেলার আর্জি কেউ কি কোম্পানিকে জানিয়েছেন? আমাদের জানা নেই। ফেসবুকে এ নিয়ে মিম-ট্রোল ইত্যাদির বাকি নেই। কিন্তু সবকিছুর আড়ালে বাংলা ভাষার শোচনীয় অবস্থাটি কি আদৌ উঠে আসছে? বিষয়টি খেয়াল করলে দেখা যাবে হিন্দির উচ্চারণের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে বাংলা ভাষায় সেটি করা হয়েছে “ভরোসা”। সাধারণ অক্ষর ও ভাষাজ্ঞান না থাকলে এই সাধারণ ভুলটা কেউ করতে পারে না। সেই গাড়ি-কোম্পানির ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখা গেল তাদের ট্যাগলাইন “ভরোসা কর কে দেখো”। সেটার সরাসরি অনুবাদ করা হয়েছে “ভরোসা কোরে দেখুন”। যেমনঃ “আগে দেখো” থেকে “আগে দ্যাখো”, “কিউ কি” থেকে “কেন কি”, “বহুত আচ্ছে লাগরাহি হো” থেকে “খুব সুন্দর লাগছিস” এরকম অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে, সেখানে বেশ জোর করেই অনুবাদ করে দেওয়া হয়েছে।
সাধারণ অক্ষর ও ভাষাজ্ঞান না থাকলে এই সাধারণ ভুলটা কেউ করতে পারে না। সেই গাড়ি-কোম্পানির ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখা গেল তাদের ট্যাগলাইন “ভরোসা কর কে দেখো”। সেটার সরাসরি অনুবাদ করা হয়েছে “ভরোসা কোরে দেখুন”। যেমনঃ “আগে দেখো” থেকে “আগে দ্যাখো”, “কিউ কি” থেকে “কেন কি”, “বহুত আচ্ছে লাগরাহি হো” থেকে “খুব সুন্দর লাগছিস” এরকম অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে, সেখানে বেশ জোর করেই অনুবাদ করে দেওয়া হয়েছে।
এই ঘটনা প্রথমবার নয়। মূল বিজ্ঞাপন যদি ইংরেজি বা হিন্দি ভাষায় হয়, তা থেকে কিম্ভূতকিমাকার একটা বাংলা অনুবাদ করে বাজারে ছেড়ে দেওয়াটা যেন কোনও ব্যাপারই নয় বিজ্ঞাপন সংস্থাগুলির কাছে। এই ‘হলেই হলো’ মনোভাব কীভাবে জন্মালো তাঁদের? তাঁরা কি পারেন না বাংলায় দক্ষ এরকম কাউকে দিয়ে সঠিক বানানের সঙ্গে সঠিক অনুবাদটুকু করিয়ে নিতে? না, পারেন না। তাঁরা গুগল-ট্রান্সলেটর বোঝেন। বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলির কর্মকর্তাদের বাংলা ভাষা নিয়ে কোনও মাথা ব্যথা বা দায় নেই, তা বারবার দায়িত্ব নিয়ে প্রমাণ করেছেন তাঁরা।
আরও পড়ুন: ঠিকঠাক বাংলা বলছেন তো?
বাঙালি মুসলমান জলকে ‘পানি’ বললে, স্নানকে ‘গোসল’ বললে হিন্দু বাঙালিরা এখনও চেপে হাসেন অথবা তাঁদের নাক কুঁচকে যায়। অথচ, রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য যখন জোর করে বাংলা ভাষার ‘বিকৃত’ ব্যবহার করা হয় অথবা অন্য ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার মনোভাব তাদের কানেও লাগে না, মনেও লাগে না। শুধু, বাংলা ভাষা বাঁচাও কমিটির ঘাঁটি গড়তে গিয়ে অনেকেই ভুলে যান কখন প্রতিবাদ করা উচিত, কখন নয়। ভিন্ন ভিন্ন ভাষার প্রয়োজন ও তার ব্যবহার আগেও ছিল, এখনও আছে। সমস্যা দেখা দেয় তখনই, যখন ভাষার সঙ্গে নিরবিচ্ছিন্নভাবে জড়িয়ে থাকা ব্যক্তি স্বাধীনতা খর্ব করা হয়, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বাক স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়, ক্ষমতায়নের জন্য যেকোনও একটি ভাষাকে নির্বাচন করা হয়।
উল্লিখিত বিজ্ঞাপনটিতে ঝকঝক করছেন বলিউডের সুপারস্টার অক্ষয় কুমার। তাঁর কোলে এক শিশু। “ভরোসা কোরে দেখুন” – অবক্ষয়ের দুনিয়ায় কেউ কাউকে ‘ভরোসা কোরতে’ পারছে না। উক্ত বিজ্ঞাপনটি যে এজেন্সি করেছেন, তাঁদের দুর্দশার কথা ভেবে আমরা শিহরিত। এ কেবল হাসিচ্ছলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আমরা চাই, অবিলম্বে বিজ্ঞাপনটি তুলে নিয়ে সঠিক বাংলা ভাষা ও বানানে উক্ত কোম্পানির কাজ শোভা পাক। তাতে দেশের মঙ্গল – দশের মঙ্গল। এমনকি বিজ্ঞাপন এজেন্সিরও মঙ্গল।