No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    অনুপম সৌন্দর্য, মাটির ঘ্রাণ, নাগরিক লাস্যের বাইরে আপনি মাধবী

    অনুপম সৌন্দর্য, মাটির ঘ্রাণ, নাগরিক লাস্যের বাইরে আপনি মাধবী

    Story image

    ভাঙাচোরা পিচ রাস্তা, গ্রামের বুক চিরে চলে গেছে সোজা খেজুরির রসুল নদীর মোহনার দিকে। ভ্যান রিক্সা ছুটছে। ব্যাটারিতে তার জুড়ে মাইক বাঁধা চালকের সিটের সঙ্গে বাঁশে। হাতে রুমাল জড়ানো এত্তো বড়ো মাইক্রোফোনে ফুঁ-ফুঁ দিতেই মাইকে ফিড ব্যাকের কুঁউউউ ধ্বনি গ্রামের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে পড়তে ঘরের ভেতরের বউঝি থেকে ধানকাটা জনমজুর, চাষি সবাই উৎকর্ণ। বন্ধুগণ বন্ধুগণ বন্ধুগণ! কামারদা কাঞ্চনচিত্রপুরীর সোনালি পর্দায় কথা-সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অমর কাহিনি কান্নাভেজা মায়ের বেদনা! হারানো সন্তান ফিরে পাওয়ার গল্প। বিন্দুর ছেলে, বিন্দুর ছেলে, বিন্দুর ছেলে! বিকাশ রায়। সন্ধ্যা রানি। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। এবং মাধবী। সন্ধ্যা সাত ঘটিকায়, সাত ঘটিকায়, সাত ঘটিকায়।

    বাইশে শ্রাবণ, মহানগর, চারুলতা-র মাধবীর স্ক্রিন প্রেজেন্সে পৃথক। সহজেই মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত সংসারে খাপ খেয়ে যাবেন অমন তাঁর সৌন্দর্য। রূপে শরীরে সহজে বাঙালি গ্রহণ করবে। প্রথম প্রথম তাঁকে শহুরে নায়িকা মনে হচ্ছে। সুপারহিট বিন্দুর ছেলেতে তিনি নায়িকা নন কিন্তু কেন্দ্রীয় চরিত্র।

    সামাজিক চিত্র বিন্দুর ছেলে। নুটু পণ্ডার কর্কশ স্বরে সে উত্তেজনা রাতের টিকিটের বাড়তি বিক্রি নিশ্চিত করে চলেছে। আকাশচুম্বী বাঁশের ডগায় একশো ওয়াটের বালব জ্বলছে কাঞ্চনচিত্রপুরীর চালের গায়ে। সে আলো নিভে গেলেই বুঝতে হবে সিনেমা শুরু হয়ে গেছে। কোলেকাঁখে-কাঁধে ছেলেমেয়ে নিয়ে ছুটছে সামাজিক চিত্র বিন্দুর ছেলে দেখতে। ১৯ পয়সার টিকিটে খড়বিছানো মেঝেয় গাদাগাদি করে বসার খানিক পরেই স্লাইডে ধূমপান নিষেধ। ছবি শুরু। সেদিন বিন্ধ্যবাসিনী অমূল্য নরেনের কাহিনিতে কিশোর হাপুস নয়নে কেঁদে আকুল। সেই যখন অনাহার অনিদ্রায় মৃত্যু পথগামী বিন্দুর কানে এলো অমূল্যর মা ডাক… সেই রাতে কিশোরের স্বপ্নে নরেন অমূল্য।  বিন্দুর মতো স্নেহপরায়ণ কড়া শাসনের মা, যদিও সে কাকিমা, কিন্তু অমূল্যর মা ভালো না খারাপ এ ভাবনাও এসেছিল। ১৯৭৩। ১৯৭৯ গণদেবতা, ১৯৮০ বাঞ্ছারামের বাগান, সেই বিন্দুবেশী মাধবীর কী রূপান্তর!

    তিনি মাধবী মুখোপাধ্যায় (Madhabi Mukherjee)। সে সময় পরপর সন্ধারানি, মলিনাদেবী, কাননদেবী, সরযূবালাদের সময় পেরিয়ে সুচিত্রা, সুপ্রিয়া, সন্ধ্যা, সাবিত্রী, লিলি, অনুভা খানিক পরে অপর্ণা এলেন। বাইশে শ্রাবণ, মহানগর, চারুলতা-র মাধবীর স্ক্রিন প্রেজেন্সে পৃথক। সহজেই মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত সংসারে খাপ খেয়ে যাবেন অমন তাঁর সৌন্দর্য। রূপে শরীরে সহজে বাঙালি গ্রহণ করবে। প্রথম প্রথম তাঁকে শহুরে নায়িকা মনে হচ্ছে। সুপারহিট বিন্দুর ছেলেতে তিনি নায়িকা নন কিন্তু কেন্দ্রীয় চরিত্র। অতিস্নেহপ্রবণ রগচটা ফিটের ব্যামোর বিন্দুর এক ঢাল কালো চুল ছাড়া থাকে অমূল্যর মা হয়ে থাকার তাগিদে। সব্বার কাছেই তরুণী মা। সেই মাধবী দশ বছর পরে গণদেবতায় অনিরুদ্ধ কামারের বৌ। কামারবৌ পদ্ম। সেখানে তাঁকে অভিনয় করতে হচ্ছে সন্ধ্যা রায়ের পাশাপাশি। উপন্যাসের থেকেও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন “খারাপ মেয়ে” ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের চরিত্র দুর্গা। ছবি জুড়ে তাঁর দামাল কীর্তিকলাপ। কিন্তু দরিদ্র, স্বামী সোহাগ বঞ্চিত পদ্ম। কোথায় সেই চারু কোথায় বা কাপুরুষের অপরূপা করুণা গুপ্ত যার মোহজাল অনন্ত বিস্তারী। পদ্ম। এই পদ্ম আবছা হয়ে আসা মস্ত লাল টিপ কপালে, কোরা কাপড়ের সাজে চুলোর আলোয় বা লম্ফের হলুদ আলোয় অতিদরিদ্র জীবন গুজরান, বাউন্ডুলে বেপরোয়া পদ্মপ্রেমিক অনি কামারের পরিবার। চকিতে ছিটকে আসে পদ্মের ক্ষোভ রাগ অভিমান। একটি জীবন-এর হতদরিদ্র গবেষক অভিধানকার গুরুদাস ভট্টাচার্যের স্ত্রীও তাই। তবে এখানে তিনি শান্ত নিরীহ স্বামীব্রতা।

    আপনার আঁধার পেরিয়ে! দৃষ্টিমান থেকে অসুস্থতায় দৃষ্টিহীন হয়ে পড়লেন। কঠিন এক জটিল চরিত্র। অন্ধ হয়ে পড়া একদা বিমানকর্মী পরে লেখিকা আপনি হাতের আঙুল ছড়িয়ে আন্দাজ করে করে বাসনপত্র নিয়ে রান্না, চায়ের ব্যবস্থা! আমিই দিচ্ছি বলে যে কঠিন প্রত্যয় প্রকাশ!

    তপন সিংহের অসাধারণ ছবি বাঞ্ছারামের বাগানে জমিলোভী মাতাল দুশ্চরিত্র জমিদার ছকড়ির ছেলে মামলাবাজ জমিদার নকড়ির বউ মাধবী অবিশ্বাস্য! হোঁৎকা কোঁৎকা জমজ দুই ছেলের আবদার সামলানোর ফাঁকে নকড়ির শুশ্রূষায় যখন স্বামীর খাটে উদগ্রীব উৎকণ্ঠায় মেঝে থেকে হাঁটু তুলে বাবু হয়ে বসেন তাঁর অভিনয় মুখাবয়ব ছেড়ে সারা শরীরে ছড়িয়ে যায়। তাঁর দ্রুত চলাফেরায় ডান হাতটা কনুই থেকে আরও ডানদিকে বেঁকে থাকে দুলতে থাকে শনশনিয়ে। আহা! এই মাধবীর চারু যখন তাঁর নিজের ঘরে মৃদু হেঁটে জানলার খড়খড়ি তুলে পথ দেখতে যায়! আপনিই মাধবী যখন বাঞ্ছারামের অনুমিত মৃত্যুর খবরে বাঞ্ছা মরেছে বাঞ্ছা মরেছে বলে দুলে দুলে নেচে ওঠেন... মুগ্ধ হতে হয় রসিক দর্শককে! ভাবুন সুবর্ণ গোলাপ-এর আপনি! না মাধবী, আপনি থিয়েটার থেকে এসেছেন অনুভব করা যায়। মাত্র ছয় বছর বয়সে মেজদিদি ছবিতে অভিনয় করলেন। কাননদেবীর শ্রীমতী পিকচার্সের প্রযোজনায় তাঁর নিজের বাছাই মিষ্টি মেয়ে আপনি। বাঞ্ছারামের বাগানের আপনি কি সেই মাধবীই!

    আলেয়ায় মা-এর সঙ্গে পাশের বাড়ির কলেজপড়ুয়া বিজলি পিসির মাঝের সিটে প্রায় পাঁচ বছরের শিশু। স্ক্রিনে নদীর বুকে বোটে উত্তমকুমার-মাধবী-র ঘনিষ্ঠ দৃশ্য ‘কে প্রথম কাছে এসেছি…’। মা বিজলি পিসির কানে কানে বলছে কী সাহস দ্যাখ! শঙ্খবেলা। এই প্রেমিকা তো চারু নয়! এই হাসি তো করুণা গুপ্তের নয়! গালে টোল পড়া মাধবী রোগাক্রান্ত সন্তানের চিকিৎসার জন্য যখন হাসপাতাল সুপারিন্টেন্ডেন্ট বসন্ত চৌধুরীর মুখোমুখি সেই মাধবীর সারা মুখে যে আবেগ উৎকণ্ঠা মাখিয়ে রাখতে জানেন, সেই আপনি সুপারিন্টেন্ডেন্টের গায়ে পড়া চায়ের আমন্ত্রণ এবং বিশেষ সুপারিশে ভিজিটিং আওয়ার্সের পরে সন্তানকে দেখার সুযোগ প্রত্যাখ্যান করছেন সেই আপনি!

    আবার উত্তমকুমারের সঙ্গে প্রেমের অবকাশে বৃষ্টিতে ভেজা আপনি! বা ‘মন চেয়েছে হারিয়ে যাব’ গানের চলন্ত গাড়ির উত্তমকুমার সংলগ্ন হয়ে পড়ে যে আহ্লাদ দেখান!

    ছদ্মবেশী মজার ছবি। সেখানে উত্তমকুমার উত্তমকুমার উত্তমকুমার! তাঁর কৌতুকী চরিত্রে তুমুল অভিনয় পরিচালকের তুরুপের তাস। তবে আপনি কী করবেন! আপনার অভিনয় মেধায় আপনি চিবুক ঠোঁট জুড়ে যে হাস্যময়ী এক নায়িকা, কই সেভাবে তো আমরা আপনার প্রেমে পড়িনি! আমরা নতুন করে প্রেম করি অপেক্ষা করি অমন এক তরুণীর জন্য।

    আচ্ছা, আপনার আঁধার পেরিয়ে! দৃষ্টিমান থেকে অসুস্থতায় দৃষ্টিহীন হয়ে পড়লেন। কঠিন এক জটিল চরিত্র। অন্ধ হয়ে পড়া একদা বিমানকর্মী পরে লেখিকা আপনি হাতের আঙুল ছড়িয়ে আন্দাজ করে করে বাসনপত্র নিয়ে রান্না, চায়ের ব্যবস্থা! আমিই দিচ্ছি বলে যে কঠিন প্রত্যয় প্রকাশ! বেড়াতে গিয়ে অন্য তরুণীর উপস্থিতিতে সংকট!  উৎপ্রেক্ষা! মনের গহনে হারানোর ভয়! সব মিলিয়ে আপনি আরেক অবতার। পূর্ণেন্দু পত্রীর মালঞ্চ সিনেমায় শয্যাশায়ী আপনি বোনের পরিচর্যার ফাঁকে স্বামীর সঙ্গে বোনের আপাত ঘনিষ্ঠতায় ব্যাকুল হতে থাকেন। এ ছবির শেষ দৃশ্যে আপনার আর্তনাদ এবং না… আমি পারবো না, বলতে বলতে দেওয়ালের গায়ে আঁচড় কাটতে কাটতে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন, আপনি অন্য মাত্রায় নিজেকে উত্তীর্ণ করে ফেলেন।

    আপনি শুধু সত্যজিতের নন, আপনি শুধু ঋত্বিকের নন, মৃণাল সেনের নন, পূর্ণেন্দু পত্রীর কবিতা নন; আপনি উৎপল দত্তের ঘুম ভাঙার গানের শ্রমিক সন্তান, বাঁশি বাজানো অনিল চ্যাটার্জির মিষ্টি প্রেমিকাও… আপনি অগ্রগামী থেকে অগ্রদূতের ভরসা। আপনি বিরাজ বউ। আপনি সুলেখা। আপনি বহু থেকে বহু। কোনো কঠিন কর্কশ দর্শক বা চলচ্চিত্র সমালোচকের স্পর্ধ্বা হয়নি বলার, ধুস্ মাধবীকে মানায়নি! প্রায় সত্তরটা বাংলা ছবিতে আপনি স্বরাট। সুচিত্রার অনুপম সৌন্দর্যে সে প্রাণ থাকে কি! সুপ্রিয়ার শারীরিক জৌলুস, অপর্ণার নাগরিক লাস্য, সন্ধ্যার মাটির ঘ্রাণ, তুখোড় অভিনেত্রী খানিক অনাগরিক সাবিত্রীর বাইরে আপনি মাধবী।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @