No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    বাংলার পটচিত্র : ইতিহাস ও ঐতিহ্যের জীবননামা

    বাংলার পটচিত্র : ইতিহাস ও ঐতিহ্যের জীবননামা

    Story image

    প্রায় আড়াই হাজার বছর ধরে ভারতীয় উপমহাদেশের জনজীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে রয়েছে পটচিত্র। নানা সময়ে তা ব্যবহার হয়েছে শৈল্পিক স্বাধীনতার বহিঃপ্রকাশ, শিক্ষার উপকরণ কিংবা ধর্মীয় আচরণবিধির অঙ্গ হিসেবে। প্রাচীনকাল থেকে শিল্পের এই বিশেষ ধারা বাংলা ও বাঙালির চিরাচরিত ঐতিহ্য বহন করে চলেছে।

    বাংলা জুড়ে যে পটচিত্রের সবচাইতে বেশি দেখা মেলে, তাতে বারংবারই বিষয়বস্তু হিসেবে ধর্মীয়, সামাজিক কিংবা আধ্যাত্মিক জীবন পরিস্ফুটিত হয়েছে। তবে এই গতানুগতিক ভাবধারায় আমূল বদল এনেছিলেন নয়াগ্রামের পটুয়া দুখুশ্যাম চিত্রকর।

    ‘পট’ শব্দের প্রকৃত অর্থ ‘কাপড়’; সংস্কৃত ‘পট্ট’ শব্দ থেকে এর উৎপত্তি। যে কাপড় পটচিত্রের জমিন বা ‘বেস’ হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তাতে কাদা, গোবর ও আঠার প্রলেপ মাখিয়ে মজবুত করে নেওয়া হয়। এই মোটা কাপড় বা কাগজের খণ্ডের উপর রং বুলিয়ে পটচিত্র অঙ্কিত হয়। এতে মূলত ধারাবাহিক ভাবে চিত্রিত হয় নানারূপ পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক কাহিনি। পটচিত্রে রং হিসেবে ব্যবহার করা হয় প্রকৃতিজাত নানা ধরনের উপাদান যেমন কাজল, কাঠ-কয়লা, আলতা, সাদা খড়ি মাটি, সিঁদুর, ইটের গুঁড়ো ইত্যাদি।

    বঙ্গদর্শন-এর ক্যামেরায় পটচিত্রী স্বর্ণ চিত্রকর

    তবে শুধুমাত্র আঁকাই শেষ কথা নয়। পটুয়া সম্প্রদায়ের মানুষেরা তাঁদের পটচিত্রগুলি জনসমক্ষে প্রদর্শন করার পাশাপাশি গান গেয়ে পটে অঙ্কিত কাহিনি বর্ণনা করেন। এক সময়ে বাংলার ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানগুলিতে বিনোদনের অন্যতম উপাদানই ছিল পটচিত্র ও পটের গান। এর বিনিময়ে সাম্মানিক পেতেন পটুয়ারা। পটচিত্র ও পটগানের প্রচলন রাঢ় অঞ্চল ছাড়িয়ে, ছড়িয়ে পড়েছে বীরভূম, পশ্চিম মেদিনীপুর, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ প্রভৃতি জেলায়। মেদিনীপুর জেলার পিংলার অন্তর্গত নয়াগ্রামের পটুয়ারা বরাবরই দৃঢ় হাতে এই শিল্পের সংরক্ষণ করে গিয়েছেন। এখানকার প্রায় পঞ্চাশ-বাহান্নটি পরিবার আজও পটশিল্পের সঙ্গে জড়িত।

    বঙ্গদর্শন-এর ক্যামেরায় পটচিত্রী মামনি চিত্রকর

    ক্রেতারা অনেকেই এখন দেবদেবী অঙ্কিত পটের বদলে বাবু কালচার বিষয়ক ক্যারিকেচার আঁকা পট কিনতে চান। এতে পটচিত্রের বিক্রি বাড়ে ঠিকই, কিন্তু প্রাচীন গৌরব ক্ষুণ্ণ হয়।

    মনে করা হয়, সপ্তম ও অষ্টম শতকে বাংলার শৈল্পিক মানচিত্রে পটচিত্রের সূচনা ঘটেছিল। সপ্তম শতকের শুরুর দিকে বাণভট্ট রচিত ‘হর্ষচরিত’-এ দেখা যায়, এক পটুয়াকে কতকগুলি ছেলের মাঝে বসে পট বোঝাতে দেখছেন স্বয়ং রাজা হর্ষবর্ধন। আবার অষ্টম শতকে রচিত বিশাখ দত্তের ‘মুদ্রারাক্ষস’ নাটকে পট ও পটুয়াদের উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়াও, কালিদাসের ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’ ও ‘মালবিকাগ্নিমিত্র’ নাটক, ভবভূতি ও ভট্ট রচিত যথাক্রমে ‘উত্তররামচরিত’ ও ‘হরিভক্তি বিলাস’ গ্রন্থে নানা প্রসঙ্গে পটচিত্রের উল্লেখ মেলে। অনেকে আবার মনে করেন, বাংলার পটশিল্পীরা আদতে বৌদ্ধযুগের চিত্রকরদের উত্তরসাধক। বৌদ্ধ ও হিন্দু পৌরাণিক কাহিনির পাশাপাশি, মুসলিম-সংস্কৃতিভিত্তিক পটের নিদর্শনও দেখা যায়, যার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ হল গাজী কানহুর পট।

    বাংলা জুড়ে যে পটচিত্রের সবচাইতে বেশি দেখা মেলে, তাতে বারবারই বিষয়বস্তু হিসেবে সামাজিক কিংবা আধ্যাত্মিক জীবন পরিস্ফুটিত হয়েছে। তবে এই গতানুগতিক ভাবধারায় আমূল বদল এনেছিলেন নয়াগ্রামের পটুয়া দুখুশ্যাম চিত্রকর। বলা ভালো, বাংলায় পটচিত্রের বিষয়ভাবনায় বিপ্লব এনেছিলেন। কেবল হিন্দু দেবদেবী নয়, তাঁর অঙ্কিত পটে ধরা পড়েছিল রাজনৈতিক ও সামাজিক নানান বিষয়, যেমন ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম, জঙ্গল কেটে ফেলা অথবা এইচ আই ভি রোগের ভয়াবহতা; আবার দৈনন্দিন জীবনে পরিচ্ছন্নতা কিংবা ডিপ টিউবওয়েলের গুরুত্ব। এমনকি অতুল্য ঘোষ, প্রফুল্ল সেনকে ব্যঙ্গ করে এঁকেছিলেন ‘কংগ্রেস বিপ্লবী’ পটও। সেই পট সঙ্গে নিয়ে তিনি গান গেয়েছেন বহু মঞ্চে। পুরাণ, ভাগবত, চণ্ডিমঙ্গলের পাশাপাশি নেতাজি ও রবীন্দ্রনাথের জীবন আলেখ্য নিয়েও পট এঁকেছেন দুখুশ্যাম, বেঁধেছেন গানও। বাংলার অনবদ্য সব পটচিত্র সংগ্রহের সঙ্গে দুখুশ্যাম অঙ্কিত ‘প্রায়শ্চিত্ত পট’টির দেখা মেলে দ্য বেঙ্গল স্টোর-এ (১২৭, যোধপুর পার্ক)।

    দ্য বেঙ্গল স্টোর-এ দুখুশ্যাম চিত্রকরের ‘প্রায়শ্চিত্ত পট’

     

    দুখুশ্যাম চিত্রকরের জন্ম ১৯৪৬ সালে, কলকাতার এক হাসপাতালে। পট আঁকার কাজে যখন হাত দিয়েছিলেন, তখন নেহাতই দৈন্যদশার মধ্যে দিয়ে দিন কাটাচ্ছেন তিনি। অর্থের অভাবে নিজেই বিভিন্ন গাছ-গাছালি ও মাটি থেকে রং তৈরি করে নিতেন। যেমন লাল রঙের জন্য সিঁদুর, আলতা, হিঙুল পাথর, পুঁই দানা, হলুদ রঙের জন্য কাঁচা হলুদ, হরিতাল পাথর, সবুজ রঙের জন্য সিম পাতার রস, কালো রঙের জন্য উনুনে পোড়া হাঁড়ির তোলার ভুষো, পোড়া চাল, সাদা রঙের জন্য শঙ্খ ও খড়িমাটি ইত্যাদির ব্যবহার করতেন। বাবলা গাছের রস থেকে আঠা তৈরি করে তা রঙের সঙ্গে মেশাতেন যাতে সেইসব রঙ কাপড় বা কাগজে ধরে থাকে; উঠে যায় না। ১৯৭০ সালে গ্রামীণ মহিলাদের পটশিল্প ও পটগান বিষয়ে শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে একটি বিদ্যালয় স্থাপন করেন দুখুশ্যাম। তাঁর শিল্পসৃষ্টিগুলি ভারত ছাড়িয়ে ফ্রান্স, ইতালি, অস্ট্রেলিয়া এবং বাংলাদেশে সংরক্ষিত রয়েছে। এছাড়াও, লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড এলবার্ট মিউজিয়ামে দুখুশ্যাম চিত্রকর অঙ্কিত পটচিত্র দেখতে পাওয়া যায়।

    তবে বাংলার বহু প্রাচীন শিল্পের মতোই সমসাময়িক কালে পটশিল্প তার প্রাচীন গৌরবের অনেকখানি হারিয়ে ফেলেছে। বিদ্যুতের ব্যবহার বাংলার বহু পুরাতন শিল্পের ক্ষেত্রে নতুন ধারার সূচনা করলেও পটচিত্রের ক্ষেত্রে তা সম্ভব হয়নি। পটচিত্র অঙ্কন করা সময়সাপেক্ষ কাজ, তাছাড়া বর্তমান গতিময় জীবনে ধৈর্য ধরে পটগান শুনবার মতন অবকাশের বড্ড অভাব মানুষের জীবনে। বহু পটুয়াই হতাশার সঙ্গে জানান যে খাঁটি পটচিত্র অপেক্ষাকৃত দামী হওয়ায়, বর্তমানে অনেক ক্রেতাই কম দামে মধ্যমানের পটচিত্র কেনেন। ফলে, প্রকৃত শিল্পী যথাযথ মূল্য পান না। এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশী পটশিল্পী শম্ভু আচার্য বলেছিলেন যে, এই শিল্পকে সংরক্ষণ করতে চাইলে বিদ্যালয় ও আর্ট ইন্সটিটিউট’গুলিতে পটচিত্র বিষয়ক কর্মশালার আয়োজন করতে হবে। কারণ শুধুমাত্র পটুয়াদের থেকে পট ক্রয়ই নয়, পরিশ্রমসাধ্য এই শিল্পটির সৃষ্টির পিছনে থাকা ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে সাধারণ মানুষের পরিচয় ঘটানোই পটচিত্রের প্রচলনঅব্যহত রাখবার একমাত্র উপায়।

    বঙ্গদর্শন-এর ক্যামেরায় পটচিত্রী দুখুশ্যাম চিত্রকর

    পটচিত্রের ধারা বাঁচিয়ে রাখতে, বর্তমানে অনেকাংশে এই শিল্পের বাণিজ্যিকীকরণ করা হয়েছে। প্রাকৃতিক রঙের বদলে কৃত্রিম রঙের ব্যবহার বেড়েছে। প্রচলিত ১৫-৩০ ফুট অবধি লম্বা জড়ানো পটের বদলে ছোটো সরায় অঙ্কিত পটচিত্র (যেমন – কালীঘাটের পট) -এর চাহিদা বেড়েছে। এ প্রসঙ্গে কালীঘাটের পটশিল্পী ভাস্কর চিত্রকর একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে, ক্রেতারা অনেকেই এখন দেবদেবী অঙ্কিত পটের বদলে বাবু কালচার বিষয়ক ক্যারিকেচার আঁকা পট কিনতে চান। এতে পটচিত্রের বিক্রি বাড়ে ঠিকই, কিন্তু প্রাচীন গৌরব ক্ষুণ্ণ হয়।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @