বাংলার পাটশিল্প হয়ে উঠেছে কালজয়ী, পৌঁছে যাচ্ছে বিশ্বের ঘরে ঘরে

বাংলার পাটশিল্প আর পাটের তৈরি বিভিন্ন জিনিসের আকর্ষণ সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে চিরন্তন। বাংলার এই অন্যতম প্রাচীন শিল্পের যেমন আছে নান্দনিকতা তেমনই আছে ব্যবহারিক মূল্য। বাংলার পাট চাষের জমি থেকে পৌঁছে যাচ্ছে সারা পৃথিবীর সব মানুষের ঘরে ঘরে। পাটতন্তুকে ‛সোনালি তন্তু’ বা ‛golden fibre’ বলা হয়। এই ভেষজ তন্তুর উৎপাদন খরচ সবচেয়ে কম এবং ব্যবহারিক ভাবে পশমের পরেই পাটতন্তু সারা বিশ্বে সমাদৃত। সেই কারণে বাংলার পাটের জিনিসের ব্যাপ্তি বিশাল এবং সেগুলি বিশ্বব্যাপী সমাদৃত।
পাটশিল্প বাংলার অন্যতম প্রাচীন ঐতিহ্য। বাংলার পাটশিল্পের ইতিহাস খুবই প্রাচীন। এই শিল্পের এবং শিল্পজাত দ্রব্যের উল্লেখ এবং প্রশংসা পাওয়া যায় কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে এবং আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরী গ্রন্থেও। ১৯ শতকের প্রথম দিক থেকে, পাটের তৈরি বিভিন্ন জিনিসের মাধ্যমে, বাংলার পাটশিল্পের নাম সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে, যা আধুনিক সময়ে বেড়ে চলেছে আরও।
পাটতন্তু দিয়ে বিভিন্ন জিনিসপত্র বহুকাল থেকেই তৈরি করে আসছেন বাংলার গ্রামীণ শিল্পীরা। কিন্তু গত পাঁচ-ছয় বছর ধরে বাংলার পাটজাত দ্রব্যের ব্যবহার শুধুমাত্র পাটের বস্তা ছাড়িয়ে দ্রুতবেগে ছড়িয়ে যাচ্ছে অন্যদিকে। পাটের সহজলভ্যতা, তার ভেষজ গুণ বাড়িয়ে তুলেছে পাটজাত দ্রব্যের আকর্ষণ। পাট ১০০ শতাংশ বায়ো-ডিগ্রেডেবল ও পরিবেশবান্ধব, তাই পাটের জিনিসকে বারবার রিসাইকেল করে ব্যবহার করা যায়। পাটজাত জিনিস খুবই হালকা অথচ টেকসই, তাই এইসব জিনিস সহজেই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। পাটজাত দ্রব্যে ব্যবহৃত হয় প্রাকৃতিক রং, তাই এসব দ্রব্য সম্পূর্ণ কেমিক্যাল বিষমুক্ত। পাটতন্তু নরম আর কমনীয়, তাই একে সহজেই বিভিন্ন আকার দেওয়া যায়। এইসব কারণে সমস্ত পৃথিবীর নামকরা ডিজাইনারদের কাছে বাংলার পাট দিনে দিনে আরো মূল্যবান হয়ে উঠছে। আর পরিবেশ সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা বাড়ার কারণে সব ধরনের মানুষই বাংলার তৈরি পাটজাত দ্রব্যের প্রতি আরো বেশি করে আকর্ষিত হচ্ছে। যেমন- ফেলে দেওয়া পাট থেকে তৈরি পুতুল মাতাচ্ছে সারা বাংলা তথা ভারতকে। স্বাস্থ্য ও শিল্পে নতুন দিশা দেখাচ্ছে পাটের তৈরি স্যানিটারি ন্যাপকিন। এছাড়াও পাটের ব্যাগ, পাট দিয়ে তৈরি ঘর সাজানোর সামগ্রী যেমন ঝুলন্ত ল্যাম্প, বাস্কেট, ফুলদানি, পাটের কোস্টার, পাটের গ্লাস-কভার, পাটের তৈরি বিভিন্ন নকশাদার মাদুর ইত্যাদির সমাদর সারা বিশ্বের শিল্পপ্রেমী মানুষের কাছে রয়েছে।
পাটগাছকে প্রথমে জলে কিছুদিন ভিজিয়ে রাখার পর তার থেকে পাটতন্তুকে আলাদা করা হয়। তারপর পাটতন্তুগুলিকে রোদে শুকানো হয়। তারপর সেই তন্তুগুলিকে ছোটো ছোটো টুকরোতে কেটে এবং বাঁকিয়ে বিভিন্ন আকার দেওয়া হয় এবং সেগুলিকে প্রাকৃতিক রঙে ছোপানো হয়, যাতে সেই বস্তুগুলির গঠনশৈলী বিশদে ফুটে ওঠে।
দ্য বেঙ্গল স্টোরের একজন কর্মীর কথায় জানা গেলো- বর্তমানে শিল্পপ্রেমী মানুষের মধ্যে বোলপুরের হস্তশিল্পী গৌরাঙ্গ দাসের তৈরি পাটের ঘোড়া, পাটের পেঁচা, পাটের গণেশ, এছাড়াও বিভিন্ন শিল্পীদের হাতে তৈরি পাটের গয়না বাক্স, পাটের ট্যিসু বক্স, মুর্শিদাবাদের গ্রামের মহিলা শিল্পীদের বানানো পাটের পুতুল সারা বাংলার তথা ভারতের মানুষের কাছে খুবই পছন্দের হয়ে উঠেছে গত কয়েক বছরে।
পাটের গণেশ দেওয়ালে টাঙানো যায়, আবার নিত্যপুজোর জন্য ঘরে অধিষ্ঠানও করানো যায়।
পাটের গণেশ ও পেঁচার একত্রমূর্তিটি অনন্য, যার উপরিভাগে রয়েছে পেঁচা এবং নিচে রয়েছে গণেশের মস্তক।
পাটের ঘোড়া ও পাটের পেঁচার সারা গায়ে রয়েছে রঙিন পাটতন্তুর বিশদ কারুকাজ।
পাটের গয়না বাক্সটি আকারে চতুর্মাত্রিক এবং সহজেই বহনযোগ্য।
এইসমস্ত নিঁখুত ও বিশদ শৈল্পিকগুণসম্পন্ন পাটের জিনিসগুলি সহজেই মানুষের মন জয় করে নেয়।
পাটের বিভিন্ন জিনিসগুলির ওপর করা বাংলার শিল্পীদের নিঁখুত কারুকাজ জিনিসগুলিকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। পাটের জিনিসগুলি হালকা, সহজেই বহনযোগ্য ও স্বল্পমূল্যের। তাই পাটের জিনিসগুলি উপহারসামগ্রী হিসাবেও ব্যবহৃত করা যায়। পাটের জিনিসগুলি ঘরের নান্দনিকতাও বাড়িয়ে তোলে বহুগুণ। তাই এভাবেই বাংলার গ্রামীণ শিল্পীদের হাত ধরে বাংলার পাট আরও বেশি করে ছড়িয়ে পড়ুক বিশ্বের ঘরে ঘরে।