দেওঘরে নজরুল

নজরুলকে দেওঘরে পাঠানো নিয়ে বহু বিতর্ক আছে। তবে যেটুকু জানা যায়, কবি তাঁর ভগ্ন স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য যাননি, গিয়েছিলেন প্রকাশক আর পত্রিকা সম্পাদকদের দুরভিসন্ধিতে। কাউকে বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ একদিন বেরিয়ে পড়লেন কবি। নজরুল চলার পথে কোনোদিনই কারও মুখাপেক্ষী ছিলেন না। তাঁর গবেষকরা বলছেন, সে সময় নবযুগ পত্রিকার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন তিনি। তারপর যোগ দেন মোসলেম ভারতে। পত্রিকার দুই কর্তা আলি আকবর খান আর আফজাজুল হক মনে করেছিলেন কবিকে নির্জন জায়গায় সরিয়ে দিতে পারলে নবযুগ ছেড়ে মোসলেম ভারতে যোগ দেবেন। তখন জীবন যুদ্ধে লড়াই করছেন তিনি। নজরুলকে আফজাজুল সাহেব কথা দিলেন প্রতিমাসে দেওঘরে একশ টাকা করে পাঠিয়ে দেওয়া হবে, বদলে লেখা দিতে। তাঁর সমস্ত লেখা এবার থেকে মোসলেম ভারত পত্রিকায় প্রকাশিত হবে।
মধুপুর স্টেশনে নামলে, পাণ্ডারা তাঁকে ঘিরে ধরলেন। পুজো দেওয়ার সমস্ত ব্যবস্থা তাঁরাই করে দেবেন, জানিয়েও দিলেন। কিন্তু নজরুল পুজো দেবেন না। কবি বারবার বলছেন, তিনি হিন্দু নন, মুসলমান। কিন্তু তাঁর চেহারা দেখে পাণ্ডারা বিশ্বাস করছেন না। পাণ্ডারা তারপর তাঁকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে গেল নিজেদের ডেরায়। নজরুল এরপর বাঁচার জন্য পকেট থেকে বের করলেন মুসলমানি টুপি। তখন দেওঘরে থাকতেন রাজনারায়ণ বসু, তাঁর বাড়িতে উঠলেন নজরুল। সব ব্যবস্থা আগে থেকেই করা ছিল। এরপর তাঁর থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল ব্যবসা বাণিজ্য পত্রিকার সম্পাদক শচীন্দ্র বসুর কাছে।
দেওঘরে কবিকে যে উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়ছিল, তা সফল হয়নি। আফজাজুল সাহেবরা চুক্তি ভাঙলেন। একসময় টাকা পাঠানো বন্ধ করে দিলেন। দেওঘরে বসে তিনি লিখলেন, ‘আমার ঘরের পাশ দিয়ে সে চলত নিতুই, সকাল সাঁঝে’। পরবর্তীকালে এই গান ‘বেদনহারা’ নামে প্রকাশিত হয়েছিল। আফজাজুল হক আর টাকা পাঠালেন না, নজরুলও আর লেখা পাঠালেন না। তাঁর গবেষকরা বলছেন, ঠিক এসময় আফজাজুল সাহেব চিঠি লিখলেন নজরুলকে। চিঠিতে বললেন, তোমার অমুক মেয়েটা ভাল আছে(একটা মেয়ের নাম)। কিন্তু তাড়াতাড়ি লেখা পাঠাও। আফজাজুল সাহেব জানতেন, মেয়েটিকে নজরুল ভালবাসে। মেয়েটি তখন কবিতা লিখতেন, নজরুল তাঁর কবিতা পছন্দ করতেন।
আরও পড়ুন
নজরুলের জীবনে বুলবুল
নজরুলের দেওঘর প্রসঙ্গে মুজাফফর আহমেদ লিখছেন, 'কথা হয়েছিল নজরুল দেওঘর থেকে মোসলেম ভারতের জন্য লেখা পাঠাবে। এবং আফজাজুল সাহেব মাসে মাসে খরচের জন্য একশ টাকা পাঠাবেন। আমি জানতাম হাজার সদিচ্ছা সত্ত্বেও মাসে মাসে একশ টাকা আফজাজুল সাহেব জোগাড় করতে পারবেন না।' একদিন নজরুল এ নিয়ে মুখ খুললেন। পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়কে চিঠি লিখলেন তিনি। বললেন, টাকা ফুরিয়ে গেছে। আফজাজুল কিম্বা খাঁ সাহেব যেন শিগগিরি টাকা পাঠায়। খোঁজ নিবি আর বলবি আমার মাঝে মানুষের রক্ত আছে। আজ যদি তাঁরা সাহায্য করে তা ব্যর্থ হবে না। আমি তা সুদে আসলে পুরে দেব।
টাকার অভাবে দেওঘর থেকে ফেরা হচ্ছিল না নজরুলের। উদ্ধার করলেন মুজাফফর আহমেদ। আলি আকবর খাঁ চেয়েছিলেন তাঁর ভাগ্নী সৈয়দা খাতুনের সঙ্গে নজরুলের বিয়ে দিতে। সৈয়দার সঙ্গে কবির মন দেওয়া নেওয়ার পালা শুরু হল। কয়েকদিনের মধ্যে বিয়ের দিন ঠিক হল। মুজাফফর আহমেদ সব জানানো হল। কারণ তিনিই নজরুলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কিন্তু মুজাফফর আহমেদ বুঝতে পেরেছিলেন আলি আকবর সাহেবের কুমতলব।
মোসলেম ভারতে বিয়ের নিমন্ত্রণ পত্র ছাপা হল, কিন্তু মুজাফফর সাহেব নিমন্ত্রণপত্র পেলেন বিয়ের পর। আলি আকবর বুঝেছিলেন মুজাফফরের মতো মানুষ নিমন্ত্রণ না পেলে আসবেন না। আগে পত্র হাতে পেলে হয়তো নজরুলকে সরাসরি তিনি না বলতেন। কারণ মুজাফফর জানতেন, নজরুল যে জীবন চান সৈয়দার সঙ্গে তা মিলবে না। যদিও তাঁর অনেক জীবনীকার লিখেছেন, সৈয়দার সঙ্গে শেষ পর্যন্ত বিয়ে হয়নি নজরুলের। বিয়ের আসর থেকে কবি উঠে পড়েছিলেন। ভাবী শ্বশুরবাড়ির ওপর রাগ করে।