এক ভুলে যাওয়া বাঙালি শিক্ষকের কাহিনি

এ হল এক ভুলে যাওয়া বাঙালি শিক্ষকের কাহিনি। তিনি জন্মেছিলেন নবদ্বীপে আজ থেকে ২৪৭ বছর আগে। নাম রামনাথ তর্কসিদ্ধান্ত। যাকে বলা হত, বুনো রামনাথ। এক সময় কাশী মিথিলার মতো ভাগীরথী জলঙ্গির সঙ্গমস্থলে অবস্থিত নবদ্বীপের জ্ঞান চর্চার কথাও সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। এখানে স্মৃতি, জ্যোতিষ, তন্ত্রশাস্ত্র, বেদ, ব্যাকরণ, পুরাণবিদ্যা, ধর্ম, সংস্কৃতিচর্চার বিস্ময়কর প্রসার ঘটেছিল। এখানকারই একজন পণ্ডিত ছিলেন বুনো রামনাথ।
জন্ম ১৭৭০ সালে। তারিখ নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। গুরুকূল প্রথায় গুরুগৃহে শিক্ষা শেষ করে বিদ্যালয় খোলেন রামনাথ। ছাত্র অবস্থাতেই বাবা তাঁর বিয়ে দিয়েছিলেন। তখন নিয়ম ছিল, কোনও নবীন আচার্য বিদ্যালয় (চতুষ্পাঠী) খুললে, বাড়ি ইত্যাদি তৈরি, ছাত্রদের রাখার খরচের জন্য রাজদরবারের দরজা থাকত অবারিত। রাজকোষ থেকে নিয়মিত আর্থিক অনুদান পেতেন তাঁরা। রামনাথ মনে করতেন বিদ্যাই সব থেকে বড় ধন। তাই তিনি রাজ দরবারে না গিয়ে গ্রামের বাইরে গাছ গাছালির মধ্যে নিজের সীমিত অর্থে কুটির নির্মাণ করে চতুষ্পাঠী চালু করলেন। সেখানেই তিনি তপোবনের আদলে বসবাস এবং অধ্যাপনা করতেন। তখন থেকেই তাঁর নাম হয় বুনো রামনাথ। রামনাথের পাণ্ডিত্যের খবর ছড়িয়ে পড়ল। ফলে ছাত্র সংখ্যাও বাড়তে থাকল।গুরুকুল প্রথায় পাঠরত এই ছাত্রদের বলা হত অন্ত্যেবাসী। এই ছাত্রদের যাবতীয় ব্যয় আচার্যকেই বহন করতে হত। রাজা বা ধনাঢ্য ব্যক্তিরা ভূমি বা অর্থ সাহায্য করতেন। রামনাথ কোনও সাহায্য কারও থেকেই নিতেন না। ফলে এক সময় চতুষ্পাঠী পরিচালনা অসম্ভব হয়ে পড়ল। তিনি একদিন ছাত্রদের সে কথা জানালে ছাত্ররা বলল, ‘গুরুদেব আমরা বিদ্যার্থী হিসাবে আপনার এসেছি, আহারার্থী হিসাবে আসি নাই। তখন থেকে টোল চালানোর খরচ তারাই বহন করত।
রামনাথের পাণ্ডিত্যের ব্যাপারে প্রচলিত একটি কাহিনির উল্লেখ এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না। কলকাতায় মহারাজ নবকৃষ্ণের সভায় এক দিগ্বিজয়ী পণ্ডিত এসেছেন। নবদ্বীপের প্রধান নৈয়ায়িক শিবনাথ বিদ্যাবাচস্পতি এবং বাঁশবেড়িয়ার ডাকসাইটে পণ্ডিত জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন সেই পণ্ডিতের কাছে একে একে পরাজয় স্বীকার করলেন। বাংলার মান যায় যায়। অনন্যোপায় রাজসভা থেকে খবর গেল বুনো রামনাথের কাছে। রামনাথ সাধারণতঃ পাণ্ডিত্যের ঢক্কানিনাদ পছন্দ করতেন না। কিন্তু স্বভূমির পণ্ডিত সমাজের মান রক্ষায় তাঁকে যেতে হল। তাঁর পরাক্রমী পাণ্ডিত্যের কাছে হার মানলেন সেই দিগ্বিজয়ী পণ্ডিত। নবদ্বীপ এবং বাংলার মুখ রক্ষা হল। রাজা নবকৃষ্ণ খুব খুশি। আপ্লুত মহারাজ প্রচুর ধনরত্ন দিতে চাইলেন রামনাথকে। সেই পুরস্কারকে ‘কাকবিষ্ঠা’ বলে প্রত্যাখ্যান করলেন রামনাথ।
কৃষ্ণনগরের মহারাজার কানে গেল রামনাথের অর্থাভাবের কথা। লোক মারফত সাহায্যের প্রস্তাব পাঠিয়ে ব্যর্থ হওয়ায়, এক দিন রাজা নিজে এসে উপস্থিত হলেন রামনাথের পর্ণ কুটিরে। রাজা এই মহা পণ্ডিতকে সরাসরি অর্থাভাবের কথা বলতে সাহস পেলেন না। প্রারম্ভিক আলাপের পর বললেন, আপনার কি কোনও অনুপপত্তি আছে? অনুপপত্তি কথাটির অর্থ অভাব বা অসুবিধা। পণ্ডিত রামনাথ ভাবলেন, মহারাজ বুঝি জানতে চাইছেন, ন্যায়শাস্ত্রের কোনও জটিল প্রশ্নের সমাধানে তাঁর কোনও অসুবিধা হচ্ছে কি না? রামনাথ বললেন, মহারাজ, চার খণ্ড চিন্তামণি শাস্ত্রের উৎপত্তি করেছি। আমার তো কোনও অনুপপত্তি নেই। আসলে মিথিলার মহাপণ্ডিত গঙ্গেশ উপাধ্যায় এই চিন্তামণি শাস্ত্র রচনা করেছিলেন। এটি ন্যায়শাস্ত্রের একটি আকর বা প্রধান গ্রন্থ। এর যথচিত ব্যাখ্যা, টীকা-টিপ্পনী পণ্ডিত সমাজে ন্যায় শাস্ত্রের আলোচনায় পাণ্ডিত্যের মাপকাঠি হিসাবে গণ্য হত।
রামনাথ পত্নীকে নিয়ে একটি গল্প চালু আছে। কৃষ্ণনগরের মহারানি এসেছেন গঙ্গা স্নানে। ঘাটে তখন কাপড় কাচছিলেন রামনাথ পত্নী। সেই জলের ছিটে গায়ে লাগলে রানি মন্তব্য করেন, হাতের শাখাও তো জোটেনি, লাল সুতো পরা এই মহিলাটি কে? প্রত্যুত্তরে আচার্যানী রানিকে বললেন, শোন মা, এই লাল সুতো আছে বলে নবদ্বীপের মান আছে, যে দিন ছিঁড়ে যাবে, নবদ্বীপ অন্ধকার হয়ে যাবে।
এই লেখার সব তথ্য নেওয়া হয়েছে, ‘কিংবদন্তী বুনো রামনাথ ও নবদ্বীপ বঙ্গবিবুধজননী সভা- একটি মহান ঐতিহ্য পুস্তিকা থেকে।
স্বত্বাধিকারী- নবদ্বীপ বঙ্গবিবুধজননী সভা
প্রকাশ-২০১৭
মূল্য- ৩০ টাকা
বুনো রামনাথের স্মৃতি সংরক্ষণ এবং নবদ্বীপের ঐতিহ্য তুলে ধরতে সক্রিয় একটি সংগঠন, যোগাযোগ- ডাঃ অরুণ কুমার চক্রবর্তী, ৯৭৩৩৭-৩৫৩৮০.