No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি প্রমথেশ বড়ুয়া

    বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি প্রমথেশ বড়ুয়া

    Story image

    ছেলের একটাই শখ। শিকারের। শোনা যায়, জীবনে বাহান্নটি বাঘ শিকার করেছিলেন। জমিদার পিতা প্রভাতচন্দ্র চেয়েছিলেন, তাঁর এই জ্যেষ্ঠপুত্রটিই হোক গৌরীপুরের ভবিষ্যত জমিদার। কিন্তু শিকার, গলফ, বিলিয়ার্ড, টেনিস, হাতি চালানোর মতো রাজা-মহারাজাদের  ঐতিহ্য ছেড়ে প্রভাতবাবুর জ্যেষ্ঠ পুত্র প্রমথেশ বড়ুয়া যোগ দিয়েছিলেন চলচ্চিত্রের জগতে।

    আসামের গৌরীপুরের জমিদার বংশে প্রমথেশের জন্ম। গৌরীপুরে স্কুলের পাঠ শেষ করে ভর্তি হয়েছিলেন কলকাতার হেয়ার স্কুলে। মেধাবী ছাত্র প্রমথেশ পরে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ফিজিক্সে অনার্স নিয়ে বি.এসসি পাশ করেন।

    প্রমথেশের নাটকের প্রতি ঝোঁক ছিল সেই ছেলেবেলা থেকেই। গৌরীপুরে থাকাকালীন তিনি একটি নাটকের দলও গড়েছিলেন - যেখানে পরিচালনা, আলোকসম্পাত, সঙ্গীত সব কিছুই থাকত তাঁর দায়িত্বে।

    প্রমথেশের বয়স তখন আঠারো, মায়ের ইচ্ছায় বিয়ে করলেন বাগবাজারের বীরেন্দ্রনাথ মিত্রের বড় মেয়ে মাধুরীলতাকে।

    মা মারা যাওয়ার পর প্রমথেশ ফিরলেন অসমে। ফিরে পিতাকে জমিদারি পরিচালনার কাজে সাহায্য করতে থাকেন। কিন্তু সে-কাজে বেশিদিন তাঁর মন বসল না। দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল তাঁর। কিছুদিনের মধ্যেই অসম থেকে ফিরলেন কলকাতায়। পরিবারের আপত্তিকে তোয়াক্কা না করে মনের তাগিদে যোগ দিলেন চলচ্চিত্র জগতে।

    এদিকে বাবার মৃত্যু হলে প্রমথেশ জমিদারির ভার ছোটভাইকে দিয়ে পাড়ি দিলেন ইউরোপ। লন্ডন থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য প্রশিক্ষণ নিলেন। প্যারিসে লাইট বয় হিসেবে কাজ করলেন বেশ কিছুদিন। প্যারিসের ফক্স স্টুডিওতে ক্যামেরা ও আলোকসম্পাতের কলাকৌশল শিখলেন। আর এই ব্যাপারে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সুপারিশ তাঁকে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিল। লাইট ব্যবহারের নতুন টেকনিক শিখে প্রমথেশ দেশে ফিরে সিনেমায় সেই প্রযুক্তিকে কাজে লাগাতে চাইলেন। শুধু তাই নয়, প্যারিস থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণের বিভিন্ন আধুনিক সামগ্রী কিনে আনলেন এবং "বড়ুয়া পিকচার্স" নামে একটি ষ্টুডিও স্থাপন করলেন।

    তাঁর নিজের প্রতিষ্ঠিত বড়ুয়া ফিল্ম ইউনিট-এ ১৯৩০ সালে তৈরি হল নির্বাক চিত্র 'অপরাধী'। আগে শুধু সূর্যের আলো ও রিফ্লেকটারের উপর নির্ভর করে ছবি তোলা হত। প্রমথেশ সেটে কৃত্রিম উপায়ে চল্লিশ হাজার ওয়াটের লাইট ব্যবহার করে ছবি তুলে ভারতীয় সিনেমাকে একটি নতুন পর্যায়ে নিয়ে গেলেন। ছবিটির পরিচালক ছিলেন দেবকী বসু আর নায়ক ছিলেন প্রমথেশ বড়ুয়া স্বয়ং। এটিই ছিল প্রমথেশের প্রথম একক ফিল্ম প্রযোজনা। আর ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পে প্রথমবার কৃত্রিম আলোর ব্যবহার হয়েছিল এই সিনেমায়।

    'অপরাধী' ছবি শেষ হবার সময় তিনি অসম বিধান পরিষদে নির্বাচিত হন। সেখানে স্বরাজ্য পার্টির মুখ্য সঞ্চালক হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই রাজনীতি থেকে সরে আসেন। এরপরে প্রমথেশ পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন সিনেমায়।

    ধীরেন গাঙ্গুলির 'দ্য ব্রিটিশ ডমিনিয়ান ফিল্ম লিমিটেড'-এর আটটি ছবির প্রযোজনা করেছিলেন প্রমথেশ। পরে বীরেন সরকারের আমন্ত্রণে প্রমথেশ যোগ দিলেন 'নিউ থিয়েটার্সে'। সেখানেই তিনি তাঁর বহুদিনের স্বপ্ন 'দেবদাস'কে চিত্রায়িত করেন। সুদর্শন প্রমথেশ ছিলেন একাধারে ছবির নায়ক ও পরিচালক।

    সিনেমার ইতিহাসে 'দেবদাস' বিখ্যাত হয়ে থাকবে শুধু সুন্দর উপস্থাপনার জন্য নয়, ভাষার উপর সফল পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্যেও। সময়মত কাট করে নাটকীয় মুহূর্তের সৃষ্টি করা, ক্লোজ-আপের উপযুক্ত ব্যবহার, মন্তাজের সুপ্রয়োগ - সব মিলে 'দেবদাস' প্রমথেশের এক অপূর্ব কীর্তি।

    বিখ্যাত অভিনেত্রী সরযু দেবী প্রমথেশের ‘দেবদাস’ দেখার পর মন্তব্য করেছিলেন - ভাগ্যিস ও ছিল, না হলে বাঙালির জীবনে হয়ত ‘দেবদাস’ কোনোদিন সত্যি হতে পারত না।

    প্রমথেশ একদিন উপস্থিত হলেন সজনীকান্ত দাসের অফিসে। সজনীকান্ত তখন বিভিন্ন পত্রিকায় চলচ্চিত্রের সমালোচনা লিখতেন। একবার সজনীকান্ত নিউ থিয়েটার্সেরও বিরূপ সমালোচনা লেখেন। এদিকে প্রমথেশ সহ নিউ নিউ থিয়েটার্সের কর্মকর্তাদের তাঁর অফিসে দেখে চমকে গেলেন সজনীকান্ত। প্রমথেশ এসে সজনীকান্তকে বললেন -"আমার পিতার জমিদারিতে কিছু বন জঙ্গল এবং কয়েকটা হাতি আছে, পরবর্তী ছবিতে সেগুলিকে কাজে লাগাতে চাই।" গল্পটা হবে, একজন আর্টিস্টের দুঃখময় জীবনের কাহিনি। প্রমথেশ সজনীকান্তকে মুখে-মুখে কিছুটা গল্প বলে গেলেন ও বাকিটা লিখে রাখতে বললেন।

    প্রমথেশের রূপ, ব্যক্তিত্ব, গাম্ভীর্য সকলকে আকর্ষণ করত। একইসাথে তিনি ছিলেন রোমান্টিক এবং বিরহী। মায়ের দেখা পাত্রী মাধুরীলতা ছাড়াও পরে প্রমথেশ বড়ুয়া আরও দুবার বিয়ে করেন, অমলা বালা ও যমুনাকে। আর এই যমুনা  ছিলেন 'দেবদাস' সিনেমার নায়িকা।

    অভিনেতা হিসেবে প্রমথেশ এক সময় খ্যাতির শিখরে ওঠেন। খামখেয়ালি প্রমথেশ একদিন নিউ থিয়েটার্স ছেড়ে দিলেন। পরে কৃষ্ণা মুভিটোন, এম.পি প্রোডাকশনস এর মত বেশকিছু নামীদামী সংস্থার সাথে যুক্ত হয়েছিলেন। এই সময়ে প্রমথেশের বিখ্যাত ছবিগুলির মধ্যে 'শেষ উত্তর' বেশ জনপ্রিয়তা পায়। 'শেষ উত্তরের' হিন্দী ছিল 'জবাব' ছবিটি, যেখানে কাননদেবীর 'তুফানমেল' গানটি সারা ভারতে আসাধারণ জনপ্রিয় হয়।

    প্রমথেশ চৌদ্দটি বাংলা ও সাতটি হিন্দি ছবি পরিচালনা করেন।

    ইউরোপের একটি বিখ্যাত অর্গানাইজেশনের জন্য প্রমথেশ কিছু শিক্ষামূলক ডকুমেণ্টারি বানানোর কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ার জন্য তিনি সেগুলি সম্পূর্ণ করতে পারেননি।

    আর স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ার কারণ ছিল অত্যধিক মদ্যপান। একাকীত্ব প্রমথেশকে ধীরে ধীরে গ্রাস করতে থাকে। একাকীত্বের আশ্রয় খুঁজতে মদ্যপান শুরু করেন। শেষজীবনে প্রমথেশ কমার্শিয়াল সিনেমার প্রতি খানিকটা বীতশ্রদ্ধও হয়ে পড়েন।

    প্রমথেশের মৃত্যুর আগের দিন অভিনেতা প্রভাত মুখোপাধ্যায়, যিনি পরে চিত্র পরিচালক হয়েছিলেন তিনি গেছিলেন প্রমথেশের সাথে দেখা করতে।

    সাক্ষাৎকারের সময়, দিনের শেষে সূর্য তখন অস্ত যাচ্ছে। প্রমথেশ প্রভাতবাবুকে ধীরে ধীরে প্রশ্ন করলেন,

    -"কি দেখবে কালকে? পুরনো দিনে নতুন সূর্য? না নতুন দিনে পুরনো সূর্য?"
    প্রভাতবাবু উত্তর  দিলেন -"হয়তো, নতুন দিনে নতুন সূর্য"।
    "আমিও তাই ভাবতাম", বললেন প্রমথেশ।
    "তোমার মত যখন আমার বয়স ছিল, উদ্দীপনায় যখন ছটফট করতাম সেই আলো আর ছায়ার জগতে ঢোকার মুখে। হ্যাঁ, সেই মেকি সস্তা মেক-বিলিফের জগতে"।
    তারপর একটু থেমে বললেন, "ফিল্মের জগতে!"

    চলে গেলেন প্রমথেশ। বাংলা ছবির কিংবদন্তি নায়ক প্রমথেশচন্দ্র বড়ুয়া যেদিন মারা যান সেদিন ঢাকা বেতার কেন্দ্র এক মিনিট অনুষ্ঠান প্রচার বন্ধ রেখেছিল, যা অন্য কোনো শিল্পীর ক্ষেত্রে কোনোদিনও ঘটেনি।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @