No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    বাঙালির ডিম চর্চা: ফ্রান্স থেকে কলকাতা

    বাঙালির ডিম চর্চা: ফ্রান্স থেকে কলকাতা

    Story image

    “প্রেমিকেরা একদিন স্বামী হয়/ স্বামীরা তারপর আর প্রেমিক থাকে না।/ অথচ ওমলেট খায়।” — ভাস্কর চক্রবর্তী

    দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালির রুচির পরিবর্তন ঘটেছে। তবে বাংলার বুকে সময় আর প্রজন্ম যতই বদলাক, বাঙালির রসনায় মামলেট, থুড়ি ওমলেটের জুড়ি নেই।

    মামলেট বা ওমলেট (Omlet), কিংবা আমাদের প্রিয় ডিম টোস্ট বা ডিম পাউরুটি। কলকাতার স্ট্রিট ফুড (Street Food in Kolkata) হিসেবে সবচেয়ে বেশি বিক্রিতে এই ডিম টোস্ট বা শুধু ওমলেটের জুড়ি নেই। এই ডিম টোস্টকে কলকাতার রাস্তায় ফ্রেঞ্চ টোস্ট নামেও বিক্রির চল রয়েছে। যদিও তার সঙ্গে ফ্রান্সের কোনো সম্পর্কই নেই। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, হঠাৎ বাঙালির ডিম পাউরুটিকে খামোখা ফ্রান্সের সঙ্গে জোড়া হয়েছে কেন? তার জন্য ওমলেটের জন্ম বৃত্তান্তে পৌঁছতে হবে। সম্ভবত ইউরোপিয়ানরাই প্রথম ডিম ভাজা করে খাওয়ার পথ প্রদর্শন করেন। কালক্রমে সেটাই বাঙালি আত্মস্থ করেছে। হয়তো বাঙালিদের পক্ষে এটাই স্বাভাবিক ছিল।

    ডিমের পোচ - প্রাতঃরাশে বাঙালির প্রিয় খাবার

    যে বাঙালি একসময় কেবল ভাতের সঙ্গে শাক-মাছেই তৃপ্তি পেত, সেই বাঙালির রসনা নবজাগরণের স্রোতে বিংশ শতাব্দীর মাঝখান থেকে নানারকম প্রথাবিরোধী খাবারে আসক্ত হয়েছে। গোটা ভারতে যখন হিন্দুদের মধ্যে ডিম নিয়ে নানা সংস্কার ছিল, তখন কিন্তু শহুরে বাঙালি এসব সংস্কারের ঊর্ধ্বে। তবে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা হাঁসের ডিম খেলেও মুরগির ডিমে ছিল তাঁদের প্রবল আপত্তি। কলকাতায় ইংরেজি শিক্ষার হাওয়ায় বাঙালি হিন্দু পরিবারের সংস্কার ক্রমশ দূর হচ্ছিল। খাঁটি বৈষ্ণব এমনকি ব্রাহ্মণ বাড়ির জলখাবারে ঢুকে পড়তে শুরু করেছিল ডিমের নানা পদ, তা সে ওমলেট হোক বা পোচ।

    কলকাতায় ইংরেজি শিক্ষার হাওয়ায় বাঙালি হিন্দু পরিবারের সংস্কার ক্রমশ দূর হচ্ছিল। খাঁটি বৈষ্ণব এমনকি ব্রাহ্মণ বাড়ির জলখাবারে ঢুকে পড়তে শুরু করেছিল ডিমের নানা পদ, তা সে ওমলেট হোক বা পোচ।

    পরে অবশ্য সর্বস্তরের বাঙালি সমাজে ডিম সমস্ত সংস্কারের ঘেরাটোপ অতিক্রম করেছে নিজ গুণে, যেহেতু চায়ের দোকানে সস্তায় জলখাবারে ডিমের চেয়ে বিকল্প কিছু ছিল না। কেননা, ততদিনে পুষ্টিগুণে পরিপূর্ণ প্রোটিন জাতীয় খাদ্যের মধ্যে ডিমই সবচেয়ে সস্তা হিসেবে সুনাম কুড়িয়েছে।

    তাই ডিম বা ডিমের সাদা অংশকে ফেটিয়ে তেল বা মাখনে ভেজে খাওয়ার রেওয়াজ যখন একান্তই ইউরোপের, তা বাঙালির হাতে পড়ে অন্যরূপ ধারণ করল। বাঙালির রান্নাঘরেই কড়াই বা তাওয়ায় ওমলেটের রেসিপি-তে ডিমের সঙ্গে পেঁয়াজ, লঙ্কাকুচি মিশেছে। ইউরোপে অবশ্য পেঁয়াজ, কাঁচালঙ্কার মিশ্রণ চলে না। ইউরোপীয় দেশ ফ্রান্স ওমলেটে মাংস সিদ্ধ, চিজ, টমেটো, ক্যাপসিকাম বা হ্যাম ব্যবহার করে। তাতে সামান্য ময়দার ব্যবহার বস্তুটিকে আরও মহার্ঘ্য করে তোলে। কিংবদন্তি অনুসারে, ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট সেনাবাহিনী-সহ দক্ষিণ ফ্রান্স দিয়ে যাত্রা করার সময় বেসিয়েরেসের কাছে এক সরাইখানায় জীবনে প্রথম একটি পুরু ও সুস্বাদু ওমলেট খেয়েছিলেন।

    ফ্রান্সের বেসিয়েরেস-এ ১৫ হাজার ডিম দিয়ে বানানো বিশাল আকৃতির ওমলেট উৎসব

    ওমলেটের তৃপ্তির চোটে সম্রাট পরের দিনই আদেশ করলেন, গ্রামের সব বাড়ি থেকে ডিম সংগ্ৰহ করে তাঁর সেনাবাহিনীর জন্য বিশাল আকারের ওমলেট তৈরি করতে হবে। ইতিহাস সাক্ষী রেখে সে দীর্ঘ ওমলেট তৈরিও হল বটে। তারপর থেকেই ফ্রান্সে ইস্টারে দীর্ঘ ওমলেট খাওয়ার ট্রাডিশন শুরু! এখনও পর্যন্ত বেসিয়েরেস সেই ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। ইস্টার সানডেতে তারা ১৫ হাজার ডিম দিয়ে বানায় বিশাল আকৃতির ওমলেট। কয়েকশো মানুষ এই উৎসবে রান্নায় দায়িত্বে থাকেন। আর উৎসবে অংশ নেওয়া মানুষেরা বিশাল ওমলেটের খানিকটা অংশ পাওয়ার অপেক্ষায় থাকেন।

    ফ্রান্সের আরও কয়েকটি শহরে নিজ উদ্যোগে অনেকেই ওমলেট ফেস্টিভ্যাল করে থাকে। যার মধ্যে অন্যতম লুইসিয়ানা ও আবেভিল। প্রতি বছরের অক্টোবরে ৫ হাজার ডিম দিয়ে উৎসবের প্রস্তুতি নেয় তারা। এছাড়া বেলজিয়ামেও এই উৎসবের আয়োজন হয়। ওমলেটটি সুস্বাদু করতে লবণ, তেল, বাটার, দুধ, লাল মরিচ, কালো মরিচ, তেল ইত্যাদি অনেক কিছুই ব্যবহার করা হয়। এত এত জিনিসের আয়োজন যে দেখে মনে হবে এ কোনো মহাযজ্ঞ।

    কার্যত এই ফরাসি ওমলেট নামক বস্তুটিই বাঙালির হাতে পড়ে কীভাবে যেন মামলেট হয়ে গেছে। যদিও বাঙালির ওমলেটে একটা বা দুটোর বেশি ডিমের ব্যবহার হয় না।

    শুদ্ধ বাঙালি মতে লাল-ঝাল ডিমের কারি

    শীতের সকালে দু-ভাঁজ করা ওমলেট যেন পাটিসাপটার শহুরে সংস্করণ। তাতে জুড়ত বাঙালির ঝাঁঝালো সর্ষের তেলের গন্ধ আর নরম ভাজা পেঁয়াজের মিষ্টত্ব আর কাঁচালঙ্কার ঝাল। সেই স্বাদ বাঙালি বংশ পরম্পরায় বহন করেছে পান্তা ভাত, গরম খিচুড়ি বা ডালভাতের অনুষঙ্গে। এভাবেই বাঙালির নিজস্ব পরিচয়ে পরিচিত হয়েছে ওমলেট। পাশ্চাত্য প্রভাব সরিয়ে বাঙালির আদরে তার নাম হল মামলেট।

    এরপর শহরের মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তের রান্নাঘরে কড়াইয়ের বদলে ঢুকে পড়ল ননস্টিক প্যান। তাতে সর্ষের তেলের বদলে জুড়ে গেল রিফাইন তেল। ওমলেটের রূপ রং বদলে গেল।

    ডিমের সাদা অংশকে ফেটিয়ে তেল বা মাখনে ভেজে খাওয়ার রেওয়াজ যখন একান্তই ইউরোপের, তা বাঙালির হাতে পড়ে অন্যরূপ ধারণ করল। বাঙালির রান্নাঘরেই কড়াই বা তাওয়ায় ওমলেটের রেসিপি-তে ডিমের সঙ্গে পেঁয়াজ, লঙ্কাকুচি মিশেছে।

    এর মাঝখানে বলে রাখি, কলকাতার সাবেকি কেবিনে বা রেস্তোরাঁয় ততদিনে ডিমের ওমলেটের চেয়ে বেশি প্রসিদ্ধ হয়ে উঠেছে কবিরাজি। কাটলেট গরম তেলে ফেলে দিয়ে তার ওপর ডিমের একটা মুচমুচে ফাঁপা আস্তরণ তৈরি হল। যদিও বাড়ির ভেতরে ওমলেটের সিংহাসন অটুট রইল। এমনকি কলকাতার রাস্তায় রাস্তায়, গলিতে গলিতে সন্ধেবেলা ওমলেটের রাজত্ব ছিল সত্তরের দশকেও। হালফিলেও নীল সাদায় ত্রিফলা আলো জ্বলে ওঠার আগে ল্যাম্পপোস্টের নিচে খদ্দেরদের ওমলেট ভেজে দেওয়ার জন্য ডিমের পসরা সাজিয়ে বসতেন কিছু মানুষ।

    একটা ছোট্ট তোলা উনুন, অ্যালুমিনিয়ামের সসপ্যান, মাথায় ফুটো করা এক বোতল সর্ষের তেল, স্টিলের গেলাস, খুন্তি, পেঁয়াজ কুঁচি, লঙ্কা আর নুনের বাটি নিয়ে তাঁরা বসতেন সন্ধের আঁধারে। কলকাতার ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এমন কত বিক্রেতাকে দেখেছি আমরা। চায়ের দোকানের পাশের ফুটপাথে তাঁদের সান্ধ্য আসরে হাজির থাকত পড়ুয়া, স্পোর্টসম্যান থেকে পানশালার খদ্দের সকলেই। সুনিপুণ কায়দায় তাঁরা গেলাসের কানায় ডিম ঠুকতেন। ভাঙা ডিমে চটপট মিশিয়ে নিতেন পেঁয়াজ, কাঁচালঙ্কা আর নুন। মনোনিবেশ করে ডিম গুলে নেওয়ার পর ডিম ভাজার পর্ব চলত। সে এক শিল্প বটে। হাতের দক্ষতায় সসপ্যানে ডিম ফুলে উঠত। তাকে শূন্যে ডিগবাজি দিয়ে খদ্দেরের প্লেটে সস্নেহে পৌঁছে দিতেন বিক্রেতারা।

    পড়ুয়ারা সেই মামলেট খেয়ে টিউশনে রওনা দিত আর স্পোর্টসম্যানরা খেলে ফেরার পথে মামলেট খেত। অনেকে আবার পানশালায় ঢোকার আগে শালপাতায় মুড়ে নিতেন মামলেটখানি। কলকাতা বইপাড়ায় বা ওয়েলিংটনের মোড়ে দাঁড়িয়ে এমনভাবেই হাঁসের ডিমের ওমলেটের স্বাদ নিতেন আদ্যন্ত ফরাসি কমলকুমার মজুমদার। মাঝেমাঝে ওমলেটের প্রশংসায় ফরাসি বলে ফেলতেন তিনি। তখন সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরিহিত কমলকুমারকে ঘিরে জার্মান, ফরাসি শিখতে সুনীল গাঙ্গুলিদের মতো উৎসাহীদের ভিড়। সাহিত্যিক কমলকুমার মজে থাকতেন বাঙালি ওমলেটে আর তরুণ সুনীল গাঙ্গুলিরা মজতেন ফরাসি ভাষায়। ফ্রান্স আর বাংলা তখন এক ছাদের তলায়। তখন ওমলেটের গন্ধে ম-ম করা ওয়েলিংটনের মোড় বা কলেজ স্ট্রিট হয়ে উঠত প্যারিসের পাব বা লাইব্রেরি।

    বাঙালির অতি পছন্দের ডিম পাউরুটি

    কালক্রমে সেই বিক্রেতারা মামলেটের সঙ্গে আমদানি করলেন পাউরুটি। দাম একটু বেশি পড়লেও ডিমটোস্টের জন্মলগ্ন থেকে সেইসব খদ্দের আজও পাল্টায়নি। ডিম নিয়ে নানা সংস্কার থেকে বাঙালি এখন মুক্ত। পাইস হোটেলের কলাপাতায় ডাল-ভাত, মামলেট, লঙ্কা দিয়ে আলুচোখার সঙ্গে যুতসই পাতিলেবু আর কাঁচা পেঁয়াজের ভক্ত বাঙালির জীবনে এখন ফাইভস্টার হোটেলের ইতালিয়ান ওমলেট ফ্রিটাটা, ফ্রায়েড এগের কদর। তবে বাঙালি কিন্তু জানে ফ্রায়েড এগ মানেই তাদের সাধের মামলেট নয়। ফ্রায়েড এগের কুসুম মামলেটের মতো ঘেঁটে বা মিশে যায় না।

    তাই দক্ষিণ কলকাতার রাধুবাবুর চায়ের দোকানে সক্কাল হতে না হতেই ভিড় জমে ওঠে টোস্ট, পোচ, ওমলেটের সঙ্গে চায়ের আড্ডায়। ৭০-৮০-র দশকে জনক রোডে সন্ধ্যাযাপন হত রাধুবাবুর কবিরাজি, কাটলেট দিয়ে। তা সত্ত্বেও দোকানের আসল পরিচয় ছিল সকালের চায়ের ঠেক। আজও খাঁটি রাসবিহারী এলাকা বা হাজরা মোড়ের বাসিন্দাদের কাছে রাধুবাবুর টোস্ট ওমলেটের স্মৃতি অমলিন। এই পরিচয় ছিল কলকাতার পাড়া বাসিন্দাদেরও। পাড়ার কালুদা, রবিদার চা দোকানে বসে ডিমটোস্ট কিংবা মোটা পুরুষ্ট ওমলেটের স্বাদ নিতে নিতে খবরের কাগজ ওল্টানোর মজাটাই ছিল আলাদা। সঙ্গে বেজে উঠত সকালের রেডিও। গেরস্থের উনুনের ধোঁয়ায় ফুটপাথ ভরে যেত। পটলডাঙ্গার টেনিদারা চায়ের আড্ডায় ওমলেটে গোলমরিচের স্বাদ পেলে চেঁচিয়ে উঠত, ‘ডি লা গ্রান্ডি মেফিস্টফিলিস! য়াক! য়াক!’

    সবশেষে বলি, সম্প্রতি পরিচালক শেখর কাপুরের ‘ব্যান্ডিট কুইন’ খ্যাত অভিনেত্রী সীমা বিশ্বাস কলকাতার ফুটপাথে বসেই ডিম পাউরুটি বিক্রি করেছেন আগামী সিনেমার স্বার্থে। সত্যিকারের দোকানদার ভেবে অনেকে চা, ওমলেট, টোস্ট কিনে খেয়েছেন। অভিনেত্রী মহানন্দে এসব বানিয়েওছেন।

    মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি রুগীর অসহায় পরিবার থেকে কলেজ স্ট্রিটে বই কিনতে আসা দূরের জেলার দুর্বল যুবক কিংবা মেসের বাসিন্দা রোগা পাতলা ছাত্রের ভরসা এখনও কলেজ স্ট্রিটের বহু বছরের পুরোনো বসন্ত কেবিন বা ফেভারিট কেবিন। ধোঁয়া ওঠা চা-কফির সঙ্গে ওমলেট, বাটার টোস্ট, পোচ বা ডিমটোস্টের পরিবেশন তাদের সুলভে প্রোটিনের নিরাপত্তার পাশাপাশি এই শহরে হারিয়ে না যাওয়ার ভরসা জোগায়। কলকাতায় কম খরচে বাঙালিকে পুষ্টিকর খাদ্য জোগানোর ভরসা তারাই দিয়েছিলেন।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @