No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    বাংলার ঐতিহ্যবাহী বাঁশের বোনা কুলো

    বাংলার ঐতিহ্যবাহী বাঁশের বোনা কুলো

    Story image

    ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো আর লাগে কিনা জানা নেই। তবে চাষির গেরস্থঘরে ধান-চাল শস্যের ঝাড়া-পাছড়ায় কুলো এখনো লাজবাব। বেতের বোনা ধামাকুলো না হোক, বাঁশের তৈরি কুলোই বা কম কীসে! কুলো তৈরির এই তো সিজিন। সেই অঘ্রান মাসে শুরু হয়েছে বাঁশে বাঁধা জীবন। চলবে ফাগুন মাস পর্যন্ত। শুধু কি কুলো! ডালা চালুনি পেছে খাড়ুই হাঁসচাপা-ঢাকা সবই প্রায় নিঁখুত দক্ষতায় বুনে চলেছেন ডোম বা মালপাড়ার মেয়ে মরদেরা। সাংসারিক কাজের অবসরে শীতের নরম রোদ মেখে ওঁরা কাজ করেন। তারপর হাটে হাটে বা মেলায় মেলায় বিক্রি। এইভাবেই স্বামীদের সঙ্গে কাজ করে বাড়তি দু-পয়সার মুখও দেখেন কেতুগ্রামের মমতা শিখা সান্ত্বনারা।

    বাংলার লোকশিল্পের অন্যতম উপাদান বাঁশ। এই বাঁশ থেকে 'কাবারি' বানিয়ে শুধু ঝুড়ি ঝাঁজুরি ছানি কাটার বাজরা প্রস্তুতি নয়, মাছ ধরার নসি বিত্তি পলুই আড়া ঝোপড়া বুনে চলেছেন স্থানীয় লোকশিল্পীরা। কাবারি থেকে 'ছিলকে' তুলে চালুনি ডালা বিশেষ করে  কুলো বোনা বেশ পরিশ্রমসাধ্য কাজ। এমনিতে গেরস্থঘরে কুলোর ব্যবহার বহুমুখী। শুধুই কি শস্য পাছোড়ার কাজ? ধানের আড়া থেকে কুঁড়ো বা চাল থেকে খুদ বের করার অন্যতম লোকহাতিয়ারের নাম কুলো। একসময় চাষিবাড়ি মানেই ঢেঁকিশাল ছিল। ঢেঁকিতে পাড় দেওয়া ধানভানুড়ির পাশাপাশি কুলোপাছুড়ির চাহিদা ছিল তুঙ্গে। বস্তা থেকে ধান বের করে প্রথম কাজটি ছিল কুলো দিয়ে ধানের আগড়া ঝাড়া। লোকছড়ায় আছে -

    ধান হলাম না আগড়া হলাম।
    কুলোর ডগে নেচেই মলাম।।

    কুলোকে কেন্দ্র করে এক সমৃদ্ধ লোকসংস্কৃতি লক্ষ করা যায়। লোকভাষায় ‘কানে তুলো পিঠে কুলো’, ‘বিষ নেই তার আবার কুলপানা চক্কর’-এর মত লোকপ্রবাদের ব্যবহার প্রায়শ শোনা যায়। কুলো আমাদের পারমার্থিক জীবনে অত্যাবশ্যক দ্রব্য। নবান্নের সময় পিতৃপুরুষদের উদ্দেশ্যে ভুজ্জি বা ভোজ্যপ্রদানে কুলোয় করে নৈবেদ্য সাজানোর বিধি। বিয়ের সময় নতুন চিত্রিত কুলোয় রাখা হয় মাঙ্গলিক দ্রব্যাদি। অনেক স্থানে কালীঠাকুরের জিভ প্রস্তুতিতে নতুন কুলো লাগানো হয়। যেমন পূর্ব বর্ধমান জেলার বড়বেলুন গ্রামের আঠারো হাত বড়মা কালীর জিভ হয় নতুন কুলো কেটে। নদিয়া জেলার গয়েশপুরের সন্নিকটে অপরাধভঞ্জনের পাট হিসাবে পরিচিত কুলিয়ার পাট। পৌষমাসের কৃষ্ণা একাদশী তিথিতে মেলার সময় নতুন কুলোতে সিধে দেওয়ার নিয়ম। আবার ছটপুজোতে পুজার উপচার নতুন কুলোতে সাজিয়ে দেওয়ার নিয়ম।

     

    একটি  ভালো বাঁশ থেকে প্রমাণ সাইজের মোটামুটি পাঁচখানা কুলো বানানো যায়। সঙ্গে চাই তালের ডাঁটি থেকে তোলা বেতি, যা শক্ত দড়ির কাজ করে। প্রথমে বাঁশ কেটে জলে দিয়ে রোদে শুকিয়ে নেওয়া হয়। ইংরেজি 'ডি' আকৃতির কুলোর তিন দিকে থাকে ইঞ্চি দেড়েক চওড়া বাঁশের পাতলা কাবারি থেকে চটা তুলে ঘের। পারিভাষিক নাম সাট-খিল। খিলের সঙ্গে কুলোর বাঁধন হিসাবে ব্যবহার করা হয় তালের বেতি। ভিতরে কাবারির পাতলা আস্তরণ দিয়ে বোনা অংশটি চটি। বুনন তিন রকমের। যেমন তিন পাড়ের খেজুর ছরি। অর্থাৎ খেজুর পাতার মতো বুনন। পুকুর পেড়ে বুনন হল তিনটি বৃত্তাকার নকশা। আর থাকে মই ছরি অর্থাৎ মই-এর আকৃতি বিশিষ্ট বুনন।

    পূর্ব বর্ধমান জেলার কালনার মহাদেবপুরে অনেক কুলোশিল্পী রয়েছেন। কেতুগ্রামের পয়রাকাঁদি কৌড়ি কোমডাঙা হাটপাড়া প্রভৃতি গ্রামে ডোম বা মালপাড়ার অনেকেই এই ‘অবসর-পেশা'য় যুক্ত। লোকশিল্পী হিসাবে সম্মানটুকু দূরে থাক প্রাপ্য মজুরি অনেকসময় পান না। একটা কুলো বিক্রি করে লাভ বলতে মাত্র কুড়ি টাকা। সারা দিনে উপার্জনের অঙ্ক মেরেকেটে পঞ্চাশ টাকা। তাও কুলোর সিজিনে। অন্য সময় চাষের কাজেই ভরসা। শিল্পের খাতায় এমনিতেই ওঁরা ব্রাত্য। সুতরাং আর্টিজেন কার্ড বা ব্যাঙ্ক লোন মিলবে কেমন করে! তবু বংশপরম্পরায় যে কাজ তারা অনায়াস দক্ষতায় করে চলেছেন সেখানে ভালোলাগা বা ভালোবাসার একটা বাড়তি দরদ রয়ে যায় বৈকি। সেই ভালোবাসার টানের জোরেই হয়তো অবহেলিত এই লোকশিল্পটি এখনো বেঁচে রয়েছে।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @